একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আমাদের বুক চিতিয়ে বলার মতো তেমন কোনো নিরঙ্কুশ বিজয় নেই। আমাদের ভূস্বামীরা মাঝেমধ্যে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জনগণ কখনো স্বাধীন ছিল না। রাজা বাদশাহ জমিদার কেউ কখনো মুক্তি পাননি। শেষের দিকে ইংরেজরা ভারতে বাদশাহি বা রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশ সৃষ্টি করে। একসময় সারা দুনিয়া ছিল ব্রিটিশের পদানত। বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। সেই ব্রিটিশ আমাদের নানা ষড়যন্ত্রের শিকার করে ভারতবর্ষ ছেড়ে যায় ’৪৭ সালের মধ্য আগস্টে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যারা স্বাধীনতা আন্দোলন করেছেন স্বাধীন ভারতে তারা অনেকেই নেতৃত্ব করলেও পাকিস্তানে অনেকেই সেই সুযোগ পাননি। যারা ব্রিটিশের পদলেহন করেছিলেন তারাই পাকিস্তানে কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব করেছেন। সেখানে আইয়ুব খান, ইস্কান্দার মির্জা কেউ বাদ যাননি। পৃথিবীতে অপসংস্কৃতির দানবীয় কোনো দেশ থাকলে সেটা পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যে বৈষম্য পাকিস্তান করেছে ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। যে কারণে বিক্ষুব্ধ বাঙালি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ’৪৭-এ পাকিস্তান-ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে অনেকবার সাধারণ নির্বাচন হয়। কিন্তু পাকিস্তানে একবারও নয়। পাকিস্তানে সর্বশেষ নির্বাচন হয় ’৭০-এর ৭ ডিসেম্বর। মানুষ যে কত বিক্ষুব্ধ ছিল তার প্রমাণ ভোটের ফলাফল। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের ১৬৭টিতে বিজয়ী হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। আর যে ২টি অন্যরা পান তারাও পশ্চিমা সমর্থক ছিলেন না। একজন পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি নেতা রাজা ত্রিদিব রায়, অন্যজন বৃহত্তর ময়মনসিংহের নান্দাইলের জনাব নুরুল আমিন। পাকিস্তান সরকার বাঙালির ভোটের অধিকার মেনে নেয়নি। তারা ব্যালটের রায় বুলেটে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কোনো রাজনৈতিক দলের আগে থেকে কোনো সশস্ত্র প্রস্তুতি ছিল কিনা বলতে পারব না। কিন্তু যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ একেবারে মাটির কাছে থেকে দেখেছি, সেহেতু এখন কেউ কেউ এটাওটা বানিয়ে বলার চেষ্টা করলেও বাস্তবে বিকোবে না। আমাদের নিরস্ত্র আন্দোলন ২৫ মার্চে পাকিস্তানিদের ভয়াবহ আক্রমণের জবাবে আপনাআপনিই সশস্ত্র রূপ নিয়েছিল। সমগ্র বাঙালি জাতির ওপর বঙ্গবন্ধুর সে যে কী দুর্নিবার প্রভাব ছিল এখন কাউকে বলেকয়ে বোঝানো যাবে না। সেই সাহসী বাঙালিরা পাকিস্তানিদের আকস্মিক আক্রমণকে সহজভাবে নেয়নি। জাতির সম্মান, মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম বাঁচাতে মরিয়া হয়ে রাস্তায় নেমেছিল। যারা একদিন শক্ত হাতে লাঠি ধরতে পারত না, তাদের হাত রাইফেল-কামানের চেয়ে তেজি হয়ে উঠেছিল। আমাকে দিয়েই বিচার করা যায়। আমার জ্ঞান-গরিমা, শক্তি-সাহস কী ছিল। তেমন কিছুই না। আক্রান্ত হলে প্রতিটি মানুষ যেমন বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, প্রথমত আমরাও তেমনটাই হয়েছিলাম। দ্বিতীয়ত ভালোবাসার সঙ্গে ঘৃণা থাকতে হয়, অন্যায়-অত্যাচার-অসত্যের বিরুদ্ধে ঘৃণা ভালোবাসার অন্যরূপ। পাকিস্তানিদের আক্রমণ কোনো বাঙালি ন্যায্য মনে করেনি। সেহেতু প্রায় সবাই ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। মার্চের আগে দু-চার জন পাকিস্তান সমর্থক থাকলেও ২৫ মার্চের পর তেমন কেউ ছিল না। হয়তো সবাই রুখে দাঁড়াতে সাহস করেনি। প্রকাশ্যে না হলেও তারা মনে মনে পাকিস্তানকে ঘৃণা করেছে, আল্লাহর দরবারে তাদের পরাজয় কামনা করেছে। সবাই হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন না, তবু বলব আল্লাহ রাজি-খুশি না হলে কোনো কাজে জয়ী হওয়া যায় না। জোর করে জুলুমবাজরা কোনো কোনো সময় সাময়িক বিজয় অর্জন করে। কিন্তু তা কখনো স্থায়ী হয় না। তাই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের চেয়ে যুদ্ধক্ষমতা বা অস্ত্রবল হাজার গুণ বেশি থাকার পরও পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের কাছে নির্মমভাবে পরাজিত হয়েছে। অনেকে অনেক কথা বলতে পারেন, কিন্তু তাদের এই যুদ্ধপরাজয় অত্যাচারের ফসল, নারী নির্যাতনের ফল, অগণিত হত্যা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পিঁপড়ে পুড়ে মারাও যে অপরাধ তারই ফল অমন দুর্দান্ত পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয়।
হ্যাঁ, বাংলাদেশের দামাল সন্তানরা অনেকেই জীবনের পরোয়া করেনি। যে কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাকিস্তানি হানাদারদের যুদ্ধকৌশল কোনো কাজে আসেনি। হয়তো কোনো বিরাট পাকিস্তানি বাহিনী চলাফেরার পথে অতি সামান্য নগণ্য শক্তি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাতে বিপুল হানাদার হতাহত হওয়ায় স্তম্ভিত হয়েছেন পাকিস্তানি যুদ্ধবিশারদরা। কারণ কোনো দিকে কোনো ব্রিগেড এগোলে তাকে বাধা দিতে অমন একটা পরিকল্পিত শক্তির দরকার হয়। কোনো কোনো জায়গায় ব্রিগেডের স্থলে ডিভিশন মুভ করলে ইচ্ছা করলেই যত্রতত্র বাধা দেওয়া যায় না। যারা অপরিণামদর্শীর মতো যেখানে সেখানে বাধা দেয় তাদের মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানিরা আমাদের যে মিশিয়ে দেয়নি তা নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদেরও মিশিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যেখানে সেখানে প্রতিরোধ গড়ে ওঠায় হানাদাররা কোথাও শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। এজন্য কোনো নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের খুব একটা ভূমিকা ছিল না।
ছোট্ট একটা ঘটনা, ১২ জুন বল্লায় আমরা সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদারদের বিপুল ক্ষতি করেছিলাম। আমার ৭০-৮০ গজের মধ্যে পড়ে থাকা কয়েকটি লাশ উঠিয়ে নেওয়ার জন্য হানাদাররা মরিয়া হয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা গুলি চালিয়েছিল। আমাদের অবস্থান ভীষণ অনুকূলে থাকায় তারা তেমন কিছু করতে পারছিল না। কিন্তু তারা আহত-নিহতদের উদ্ধারের জন্য মরিয়া ছিল। বল্লা থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে দেওপাড়ায় কাদেরিয়া বাহিনীর লোকমান কমান্ডার অবস্থান করছিল। সে যখন খবর পায় কাদের সিদ্দিকী বল্লায় বহু হানাদার মেরে অনেককে বন্দী করেছে— সে নাচতে নাচতে দেওপাড়া থেকে কস্তূরীপাড়া আউলিয়াবাদ হয়ে বল্লার দিকে ছোটে। বল্লা চারানের কাছাকাছি তিন মোহনায় উভয় পক্ষের গোলাগুলি শুনে তারা অযথাই এদিক-ওদিক কিছু গুলি চালিয়ে যেমন এসেছিল তেমনি দেওপাড়া দে ছুট। সেদিন লোকমানের অপরিকল্পিত কয়েকটা গুলি অসাধারণ ফল দিয়েছিল। আমরা দুই-আড়াই ঘণ্টা গোলাগুলি করে যেখানে হানাদারদের সরাতে পারছিলাম না, সেখানে লোকমানের ওই কয়েকটা গুলিতে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে লাশ ফেলে তারা চম্পট দিয়েছিল। এমন ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই ঘটেছে। আমরা অনেক প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করেছি। হানাদাররা তাদের শক্তি ব্যবহার করেছে, আমরা আমাদের সম্পূর্ণ সামর্থ্য দিয়ে কোনো কোনো জায়গায় ঠেকিয়ে দিয়েছি। কোনো কোনো জায়গায় আমাদের কাছে তারা হেরে গেছে। যে যাই বলুক, পাকিস্তানি হানাদারদের পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সংগঠিত আকারে প্রচুর শক্তি খরচের ক্ষমতা ছিল না। ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল মিলে তারা কখনো দুটি আবার কখনো তিনটি ব্রিগেডের বেশি একসঙ্গে ব্যবহার করতে পারেনি। কিন্তু কাদেরিয়া বাহিনী যে অঞ্চলে লড়াই করেছে সেখানে পাকিস্তানিদের অনেক সময় সৈন্য এবং শক্তির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর কখনো তেমন হয়নি। হানাদারদের রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত নিরাপদ রাখতে যে শক্তি বা লোকবল ব্যয় করতে হয়েছে, আমাদের তা করতে হয়নি। আমাদের এলাকায় পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়মিত সৈন্য ছাড়া আগস্টের পরে গ্রামেগঞ্জে অন্যরা দাঁড়াতে পারেনি। যুদ্ধ একবার শিখে গেলে, কীভাবে আক্রমণ করতে হয় অথবা শত্রুসেনা মোকাবিলা করতে হয় তা জানা হয়ে গেলে আর বুকে সাহস থাকলে পাকিস্তানি বাহিনী কেন হিটলারের জার্মান বাহিনীকেও ঠেকিয়ে দেওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। হ্যাঁ, অস্ত্রবল সব সময়ই পাকিস্তানিদের বেশি ছিল। একটা মেশিনগান নিয়ে কেউ হয়তো সামনে সবকিছু কচুকাটা করছে, গাছের পাতা ফারা ফারা করে ফেলছে সেই মেশিনগানের সামনে দাঁড়ানো হয়তো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
কিন্তু যে মেশিনগান চালাচ্ছে তার আশপাশ কিংবা পেছন থেকে গিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলে বা দিতে পারলে মেশিনগান কোনো কাজ দেওয়ার কথা নয়। একটা থ্রি নট থ্রি অথবা চাইনিজ রাইফেলের গুলিতে মেশিনগান যে চালায় তার ভবলীলা শেষ করে দেওয়া যায়। যদিও একটা মেশিনগানের সামনে আর্মির একটা কোম্পানিরও টিকে থাকা মুশকিল। আমার বাহিনী যেদিন মাটিকাটায় জাহাজ দখল করেছিল সেদিন দুটি পাকিস্তানি জেট মাটিকাটার গাছপালার একটি পাতাও রাখেনি। তাদের ফাইভ ও ব্রোনিংয়ের গুলিতে গাছের ডালপালা এবং পাতা ছিঁড়ে ফারা ফারা হয়ে গিয়েছিল। খেতের ধান মাটিতে ঝরে পড়েছিল। কৃষক যেমন লাঙ্গল দিয়ে হাল বায়, কোনো কোনো জায়গায় এয়ার স্ট্র্যাপিংয়ে সে রকম মাটি সরে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের কারও কিছু হয়নি। যতক্ষণ আকাশে ফাইটার ততক্ষণ তারা দাপটে, ফাইটার চলে গেলেই দাপট শেষ। মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। সেই অচেনা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা অসম্মান ও বৈষম্যের শিকার। আমার একটা বাস্তব উপলব্ধি থেকে বলতে পারি, স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কখনো তেমন মূল্যায়ন হয় না। পরাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন। কারণ তারা বন্দী মানুষকে, অসহায় মানুষকে মুক্ত করার জন্য জীবনের পরোয়া করে না। তারা রক্তের হোলি খেলে। কিন্তু স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অবর্ণনীয় অবহেলা সহ্য করতে হয়, সেটা প্রায় সব দেশে। যুদ্ধ করে দেশ মুক্ত করে কিউবা, ভিয়েতনাম, কোরিয়ার মতো মুক্তিযোদ্ধারাই যদি দেশ চালায় সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমাদের মতো জাতীয় নেতার নেতৃত্বে নিরস্ত্র আন্দোলন যখন সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়, তখন সেই যোদ্ধাদের যুদ্ধ শেষে জাতীয় নেতৃত্বদানকারী অনেকেই চেনেন না, জানেন না, বোঝেন না। আমাদের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।
গত কয়েক সপ্তাহ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা, সম্মানী নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। প্রথমেই আসা যাক যে প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হচ্ছে সেটা তেমন বিশুদ্ধ নয়। সত্যিকার অর্থেই কিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এখনো মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তিতে বাদ পড়ে আছে। তাদের যাচাই-বাছাই হাটুরা গরুচোরের মতো সন্দেহ নিয়ে করা খুব একটা যুক্তিযুক্ত নয়। আর যাচাই-বাছাইতে দলীয় রাজনীতির যে প্রভাব তা সর্বনাশ ডেকে আনবে। তা ছাড়া আরেকটা ব্যারাম সংক্রমণের মতো কাজ করছে, কোনো তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাকে দয়া করে কেউ যদি একবার বলে বসে ভুয়া তাহলেই হলো। কে বলল, কাকে বলল, কেন বলল আসল আর নকলের বিচারের সে কি যোগ্য? কাউকে আসল মুক্তিযোদ্ধা বলতে হলে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে আশপাশে থাকতে হবে। চিটাগাংয়ের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বগুড়ার কেউ ইচ্ছা করলেই আসল বা নকল বলতে পারে না। কেউ সেটা খেয়াল করে না। কোনোরকমে একবার ভুয়া বলতে পারলেই হলো। কোনো তালিকাভুক্ত রাজাকারও যদি কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে নকল বা ভুয়া বলতে পারে তাহলেই হলো। তার সব শেষ। কয়েক বছর ধরে টাঙ্গাইল কোর্টে এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মামলা চলেছে। সিরাজুল ইসলাম সিদ্দিকী, বাড়ি জশিহাটি। টাঙ্গাইল আকুর টাকুর পাড়ায় তার বাস। মান্নাফ মিয়ার ছেলে তার নামে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোর্টে মামলা দিয়েছে। মনে হয় মামলাটি ১০-১৫ বছর ধরে চলছে। কয়েক বছর আগে লোকটি আমার কাছে এসেছিল। কাদেরিয়া বাহিনীর আঞ্চলিক প্রশাসক এনায়েত করিমের হাত ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের কিছু কাগজপত্র এখনো আমার কাছে আছে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবক নেতৃবৃন্দ মিলে কয়েক হাজার লোকের নামধাম রয়েছে। ভাগ্য কাকে বলে, খুঁজতে খুঁজতে দেখি ৭০-৮০ জনের একটি তালিকায় সিরাজুল ইসলাম সিদ্দিকীর নাম আছে। জশিহাটি প্রত্যন্ত অঞ্চল টাঙ্গাইল শহর থেকে ৮-১০ মাইল দূরে। যুদ্ধের সময় ছিল আমাদের দখলে। অভিযোগকারী মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইল শহরে বাস করেছে। গ্রামের কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে নয় তা তার জানার কথা নয়। নিজে শহরে থেকেছে, বাপে সরকারি কর্মচারী হিসেবে শেষ দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের অনুগত থাকায় যাদের হওয়ার কথা শাস্তি, তারা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভুয়া বলে অভিযোগ করে পেরেশান করেছে। আমি বলেছি, কবে কোর্টে তারিখ পড়ে জানাবে। আমি যাব, মাননীয় বিচারককে আসল-নকল দেখাব। এমনি কত শত হাজারো বিড়ম্বনা শুধু রাজনৈতিক মত-পথ, পছন্দ-অপছন্দের কারণে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে। যুদ্ধ শেষে তারই পায়ের কাছে অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের জাতীয়ভাবে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হবে। যে জাতি তার বীর সন্তানদের সম্মান করে না, মর্যাদা দেয় না, সে জাতিতে কোনো দিন বীরের জন্ম হয় না। আমরা বড় আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। যদি পিতা বেঁচে থাকতেন হয়তো তার কথা সত্য হতো। কিন্তু অকালে তিনি চলে যাওয়ায় আমরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। অপমানিত-অপদস্থ হয়েছি আরও বেশি।
স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের জন্য সম্মানী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে যুদ্ধাহতদের ভাতা ছিল ৭৫, শহীদ পরিবারের ১০০ টাকা। এটা চলে ’৭৭ সাল পর্যন্ত। ’৭৭-’৮০-র দিকে যুদ্ধাহত ৭০০, শহীদ পরিবারের ২০০ টাকা। এইভাবে ’৯০-’৯১ সালে যুদ্ধাহত সম্মানী ১৩৬০, খাদ্য ৯০০, চিকিৎসা ৫০০, সাহায্যকারী ৫০০, ঈদের জন্যে ১৩৬০— মোট ৩২৬০ টাকা। এটা আরও পরে ২০১২ সালে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
পুরোপুরি যুদ্ধাহত ১৫,০০০, চিকিৎসা ১৭০০, সাহায্যকারী ৭,০০০, খাদ্য ৪০০০, অন্যান্য ২২০০— মোট ৩০,০০০ টাকা। আংশিক যুদ্ধাহত কাউকে কাউকে ২০,০০০, আবার কাউকে কাউকে ১৬,০০০ টাকা। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবার ১৫,০০০ টাকা। এইভাবে চলে আসছিল কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে যুদ্ধাহত এবং শহীদ পরিবারের ভাতা প্রদান কার্যক্রম। (চলবে)
লেখক : রাজনীতিক।