বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ আমার বাবা প্রয়াত সিদ্দিকুর রহমান এবং ছোট চাচা, সাবেক মন্ত্রী, প্রয়াত মেজর জেনারেল শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য একই সময়ে একইসঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে তারা অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসে নিজ নিজ চাকরিতে যোগদান করেন।
১৯৭৬ সালে বাবা চাঁদপুরে মহকুমা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আমি তখন ৮ম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের সময়ে বাবা-মা’র সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনার চল ছিল না। তারপরও যেটুকু মনে পড়ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি নিয়ে বাবার সঙ্গে যৎসামান্য কথা হয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার বিষয়ে নিরুৎসাহিত ছিলেন। তার মতে, ‘চাল থেকে ধান বাছতে হয়, ধান থেকে কেউ চাল বাছে না।’ আমাদের ছোটবেলায় এত পরিষ্কার চাল পাওয়া যেত না, প্রতি কেজি চালে ২০-২৫টা ধান থাকত।
মা’কে দেখেছি কুলোয় চাল ঢেলে তা থেকে ধান বাছাই করতে। বাবার কথা ছিল, আমাকে যে যুবক রাতের অন্ধকারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পার করে দিয়েছিলেন, আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন, তার সার্টিফিকেট কে দেবে? সুতরাং গুটিকয়েক রাজাকার-আলবদর ছাড়া সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধা। তাই রাজাকারের তালিকা করাটাই শ্রেয়, তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ভেতর বিভাজন তৈরি হতে পারে। কথাটা আমার মনে ধরেছিল। একথা আজ থেকে প্রায় ৪৩ বছর আগের। যেহেতু এখন মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে তাই তালিকা প্রণয়নও জরুরি। কিন্তু রাজাকারের তালিকার আবেদনটি ফুরিয়ে যায়নি। সঙ্গত কারণেই বিজয় দিবসের প্রাক্কালে সরকার যখন রাজাকারের তালিকা প্রকাশের কথা বলল, তখন বাবার অনুভূতির কথা মনে পড়তেই শিহরণ বোধ করলাম। কিন্তু হায়, তা কেবলই কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র। প্রকাশিত তালিকা দেখে সব শিহরণ ক্ষোভে পরিণত হল। স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধাকেও রাজাকার বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকারের পক্ষে এ ধরনের একটি বিতর্কিত তালিকা তৈরি করা কী করে সম্ভব হল?
সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে, সব ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতার উদ্বেগজনক অবনতি ঘটেছে। ক্ষমতার দম্ভ স্বাভাবিক চেতনার ধার কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে অনেক বড় ধরনের সমস্যাকেও মামুলি বাক্য দ্বারা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তালিকা প্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এবং পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং ভুলটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করেছেন। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের দিক বিবেচনায় এটি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য নিবেদন। গল্পের এখানেই ইতি টানা যেত। কিন্তু আমরা তারপরও দু’কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি। কারণ ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর’। ক্ষত সৃষ্টির কারণ উদ্ঘাটন না করে দু’পয়সার মলম লাগিয়ে সেরে তোলার চেষ্টা করলে সে জায়গায় আবার ক্ষত হবে। ভুল, অসতর্কতা আর অন্যায় সমার্থক নয়। কোনো রাজাকারের নাম যদি হয় রহিম মিয়া আর আপনি যদি লেখেন রহিম মিজি তাহলে তা ভুল। এমন লোক আছেন যিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধও করেননি আবার রাজাকারও ছিলেন না। তার নাম যদি তালিকায় আসে তবে সেটা অসতর্কতা। কিন্তু একজন কীর্তিমান মুক্তিযোদ্ধা, এলাকায় অতি পরিচিত ব্যক্তিত্ব, তার নাম কী করে রাজাকারের তালিকায় আসে? এটা কি ভুল, অসতর্কতা, নাকি অন্যায় বা মহাঅন্যায়?
বরিশালের প্রখ্যাত আইনজীবী সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অপরাধে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে তার ছেলে অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি বাংলাদেশ সরকারের গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। রাজাকারের তালিকায় তার এবং তার প্রয়াত মা ঊষা চক্রবর্তীর নামও আছে। এটাকে আপনি কী বলবেন- ভুল নাকি অন্যায়? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম রাজাকারের তালিকায় উঠে এসেছে। অথচ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের মালদহ এলাকায় সাংগঠনিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। তার ভাগ্যেই যদি এমনটি ঘটে তাহলে সাধারণ মানুষের কপালে কী থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
‘কোনো যাচাই-বাছাই না করেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি পুরনো নথি রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকা হিসেবে প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রথম ধাপের এ তালিকায় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীদের নাম নেই। অথচ এখন পর্যন্ত অন্তত ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেছে, যারা রাজাকারের তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
এর বাইরে আছে বেশকিছু আওয়ামী লীগ নেতার নাম, যাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পরিচিত। নারী রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন ৩৮ জন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ৯২ জনের নামও এসেছে তালিকায়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার, বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যের নামও যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে’ (প্রথম আলো, ১৮.১২.২০১৯)। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আমরা এমনতর দায়িত্বহীনতা প্রত্যাশা করি না। তাদের এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই ফতোয়া দেয়া শুরু করেছেন। তারা বলছেন, ৪৮ বছর পর কেন এ রাজাকারের তালিকা? এটা হচ্ছে রাজাকারদের কলঙ্কিত অতীতকে ধামাচাপা দেয়া। হ্যাঁ, আরও আগে হলে ভালো হতো। কিন্তু ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’। বিলম্বিত তালিকা কোনো দোষের নয়, সমস্যাটা হল বিতর্কিত তালিকা নিয়ে। সেদিকটিতেও সরকারকে খেয়াল করতে হবে।
এত গেল রাজাকারের তালিকা। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটিই কি বিতর্কের ঊর্ধ্বে? সেখানেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার পাহাড় জমেছে। ২০১৭ সালে ভাতা বাড়ানোর সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, ‘The country has a list of 2,30,000 freedom fighters. We are continuing scrutiny to select real freedom fighters’ (The Daily Star, 04.12.2017). তার মানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে একটা চলমান বাছাই প্রক্রিয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন তিনি। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই আছে।
কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাটা কত? এ নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়ে থাকে, বিএনপি আমলে তা ২২ হাজার ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে যে অতিরিক্ত ১১ হাজার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার বেশিরভাগই ভুয়া বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। তাহলে সব মিলিয়ে ৩৩ হাজার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী তার আমলে ৮ হাজার ভুয়া সনদ বাতিলের কথা বলেছেন। তাহলে এখনও ২৫ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় রয়ে গেছেন। সরকার বদল মানেই কি মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বদল? গত ৪৮ বছরে ৬ বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। এটি হতে পারে, কেননা একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়তো একসময় নাম অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবেননি, এখন ভাবছেন। তার উত্তরসূরিদের সুযোগ-সুবিধা দিতে চাইছেন, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি মানুষের বিশ্বাসে অভাব তৈরি করে। মানুষ কোনো উদ্দেশ্যকে ইঙ্গিত করতে চায়। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ডের দোলাচলও সন্দেহের বাইরে নয়। এ পর্যন্ত ১১ বার পাল্টানোর পর বয়স ৬ মাস কমিয়ে কমপক্ষে সাড়ে বারো বছর করা হয়েছে। এগুলো হয়তো স্বাভাবিক ব্যাপার; কিন্তু আমাদের মাঝে স্বচ্ছতার অভাব থাকায় তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, মনে হয় ব্যক্তিস্বার্থে এ ধরনের পরিবর্তন ঘটানো হয়। সেক্ষেত্রে নেতিবাচক ভাবনার মানুষকে দোষ দেয়া যাবে না।
২০১৮ সালের শুরুতে প্রকৃত ও নির্ভুল তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কয়েক মাস কাজ করার পর নানা জটিলতায় সে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘এটা ঠিক, আমরা সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করতে পারিনি বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারিনি। তবে আমরা কোনো অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানাইনি।’ দুর্বলতা স্বীকার করা রাজনৈতিক উদারতা, তবে আমরা চাই দুর্বলতা দূর করার দৃঢ়তা। হাতের কাছে আইন আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফৌজদারি আইনের ৪১৬ ধারা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নিলে ৩ বছরের এবং সুযোগ-সুবিধা নিলে ৭ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তাহলে তা প্রয়োগ করতে বাধা কোথায়? আন্তরিকতা থাকলে এর সমাধান খুব একটা কঠিন বলে মনে হয় না। বিষয়টিকে রাজনৈতিক কুটিলতা থেকে দূরে রাখতে হবে।
তার মানে হল, কোনো কাজই ঠিকমতো চলছে না। কিংবা আরও খোলাসা করে বললে, কোনো কাজই কায়েমি স্বার্থের ঊর্ধ্বে হচ্ছে না। প্রকৃত সত্য হল, আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষমতার মোহে পেয়ে বসেছে। ’৭৫-এর ৩ নভেম্বর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে জেলখানায় হত্যা করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগে ত্যাগের রাজনীতির অবসান ঘটে। একসময় আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। এখন আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে অনেকেই বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন, এখানে ভালোবাসার কিছু নেই। আজকে খোদ প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন- ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন ধানমণ্ডিতে পড়ে ছিল তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোথায় ছিলেন? অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। ১৯৭৫ সালে সারা বাংলাদেশের নীরবতা দেখে আমার মতো ১১ বছরের শিশুর মনেও সেদিন এ প্রশ্নই জেগেছিল। তাই শেখ হাসিনার উচিত তার মনে জাগা প্রশ্নের যথার্থ উত্তর খুঁজে বের করা। তার সঙ্গে শান্ত মননে খুঁজে বের করতে হবে কারা রাজাকারদের এ বিতর্কিত তালিকা তৈরি করেছে। তা না হলে অল্পদিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ ভেতর থেকে ক্ষয়ে যাবে। আর মানুষ সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে।