বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ প্রবাদ আছে, ‘নিজের বুদ্ধিতে পেটে ভাত, অন্যের বুদ্ধিতে কপালে হাত।’ বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক, আর্থিক ও কৌশলগত এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে।
চীন বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে আগ্রহী ছিল। কয়েক বছর আগে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় চীন প্রাথমিকভাবে ৫৬ হাজার কোটি টাকা অর্থায়নে গভীর সমুদ্রবন্দর করার প্রস্তাব দিয়েছিল। বাংলাদেশ রাজিও হয়েছিল। তবে শোনা যায়, পরে প্রতিবেশী কোনো দেশের পরামর্শে বলা হয়েছিল, যৌথভাবে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে। আবার বলা হয়, অন্য এলাকায় নির্মাণ হবে। এভাবে সময়ক্ষেপণ করে চীনকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, আমরা তোমাদের এ প্রস্তাবে সম্মত নই। চীনও তার বিনিয়োগ নিয়ে বসে থাকেনি। তারা আমাদের দেয়া সেই প্রস্তাবই এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাস্তবায়ন করার চুক্তি করেছে। অন্যের কূটচালে (একরকম অসহায় প্রজা হয়ে) আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তা হল- বিনিয়োগ, গভীর সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। যাদের বুদ্ধিতে আমাদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হল, বর্তমানে তারা আমাদের পাশে নেই। বাংলাদেশে চীন যে বিশাল বিনিয়োগে আগ্রহী ছিল, তাতে বিনিয়োগ রক্ষার স্বার্থে হলেও তখন হয়তো রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিত।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়া মিয়ানমারের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের অঙ্গীকার ও একগুচ্ছ চুক্তি করে দেশে ফিরেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগর এলাকায় ‘কাইয়ুকপাইউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বিষয়ক চুক্তিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। সফরকালে অং সান সু চির সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি ৩৩টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। এসব চুক্তির মধ্যে তথ্যবিনিময় থেকে শুরু করে শিল্প, কৃষি, নিরাপত্তা এবং চীন সীমান্তে অবস্থিত মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশের গৃহহীনদের পুনর্বাসনের মতো বিষয়ও রয়েছে।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তর অভিযোগ ও অন্যায়কে না দেখার ভান করে চীন নির্লজ্জভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ঢাল হওয়ার বিনিময়ে যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং এবার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্পের তহবিল নিয়ে মিয়ানমারে হাজির। যদিও এসব প্রকল্পে মিয়ানমার যতটা লাভবান হবে, তার চেয়ে বেশি লাভ হবে চীনের। এর মধ্যে রাখাইন রাজ্যের কিয়াউকফুতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকে বলা হচ্ছে ‘চীনা মুকুটের রত্ন’।
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট বলে স্বীকৃত। রাখাইনে ২০১৭ সালের নৃশংসতাকে খোদ জাতিসংঘ গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে। ব্যবসা, সম্পদ আর ক্ষমতার কাছে আজ মানবতা মূল্যহীন! রাজনীতি আর কূটনীতির কোনো সরল হিসাব-নিকাশ নেই। মূল হিসাবটি স্বার্থ। মানবিকতা অর্থহীন বলেই চীন আজ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে।
ইসলামী জঙ্গিবাদের বিপদ মাথায় রেখে ভারত ও চীন যদি মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশও এ বিপদ থেকে মুক্ত থাকবে না। তখন এ বিপদ থেকে কেউই গা বাঁচাতে পারবে না। রোহিঙ্গা বিতাড়নের পরের সমস্যাগুলো কীভাবে আঘাত হানবে তা বিশ্বকে বোঝাতে হবে আমাদের। চীন-ভারতের অর্থনৈতিক লাভের হিসাব-নিকাশ তখন আর মিলবে না।
মোহাম্মদ আবু নোমান : প্রাবন্ধিক
abunoman1972@gmail.com