বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ঘরে-বাইরে মহা সংকটে পড়েছে। পাকিস্তান হঠাৎ করে অকল্পনীয়ভাবে আজাদ কাশ্মীরে গণভোটের কথা বলেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত ১৫ জানুয়ারি ডয়চে ভেলের সাথে সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বাসিন্দারা কি পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চান, নাকি স্বাধীনতা চান, সে ব্যাপারে তাঁদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া উচিত। একই প্রশ্নে কাশ্মীরে গণভোট দিতেও পাকিস্তান প্রস্তুত।’ আজাদ কাশ্মীরে গণভোট এবং স্বাধীনতার কথা এই প্রথম উচ্চারিত হলো। এর আগে পাকিস্তানভুক্ত হওয়ার পর কখনই এ কথা শোনা যায়নি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে। দ্বিতীয়ত: প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে তার দেশে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। তাই অনুমেয়, ইমরান খানের বক্তব্য সমগ্র পাকিস্তানিদেরই বক্তব্য। তা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়েই উচ্চারিত হয়েছে এই যা। অন্যদিকে, আজাদ কাশ্মীরে গণভোটের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে জম্মু-কাশ্মীরে গণভোটের দাবি প্রবল হয়ে উঠবে এবং তা বিশ্ববাসীরও সমর্থন পাবে। জাতিসংঘেরও সিদ্ধান্ত আছে গণভোটের। এই অবস্থায় দুই কাশ্মীর একত্র হয়ে একটি পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিও উঠতে পারে। দুই কাশ্মীর একত্র হয়ে পূর্ণ স্বাধীন হলে তাদের আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ হবে। উপরন্তু পাক-ভারতের চির শত্রুতার অবসান ঘটবে। দেশ দু’টি সামরিক শক্তির অর্থ সার্বিক উন্নতিতে ব্যয় করতে পারবে। সর্বোপরি পাক-ভারতের সম্পকোন্নয়নের প্রভাব সার্কেও পড়বে। সার্ক শক্তিশালী হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সার্বিক কল্যাণ হবে। স্মরণীয় যে, পাক-ভারত চরম বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করছে স্বাধীনতা পর থেকেই। কয়েকবার ভয়াবহ যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে এবং তাতে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হয়েছে উভয় দেশেরই। উপরন্তু ভবিষ্যৎ যুদ্ধে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে দু’টি দেশই পাল্লা দিয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে। এই অবস্থায় চীন এগিয়ে এসেছে পাকিস্তানের আর্থিক ও সামরিক সহায়তায়।
ভারত ও চীনের মধ্যেও সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। এ নিয়ে ১৯৬২ সালে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল। তাই উভয় দেশই সীমান্তে বিপুল সেনা মোতায়েন করে রেখেছে। সা¤প্রতিক বৈরিতা আরও বেড়েছে। কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পর চীনের দখলে থাকা ‘আকসাই’ অঞ্চলকে ভারতের বলে ঘোষণা করেছে দেশটি। চীন এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ভুটানেরও ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকার রাস্তায় ভারতের বিপুল সেনা মোতায়েন ছিল বহুদিন যাবত। গত বছর চীনের কড়া হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সেখান থেকে সেনা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। সে রাস্তা এখন চীন ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে।
ভারতের প্রতিবেশী ও বন্ধু নেপালও ভারতের প্রতি বিমুখ হয়েছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি ওলি গত ১৭ নভেম্বর বলেছেন, ‘কালাপানি এলাকা নেপালের। এখান থেকে তৎক্ষণাৎ ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।সরকার কাউকেই দেশের এক ইঞ্চি জমি দখল করতে দেবে না। প্রতিবেশী দেশের উচিৎ আমাদের ভূখন্ড থেকে অতিসত্বর নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করা।’ নেপাল, ভারত ও তিব্বতের সংযোগস্থল বলে পরিচিত কালাপানিকে ভারত নিজেদের ভূখন্ড হিসেবে মানচিত্রে দেখিয়েছে গত ২ নভেম্বর। ভারত বলেছে, এই মানচিত্রে সঠিকভাবেই ভারতের সার্বভৌম ভূখন্ডের সীমানা দেখানো হয়েছে। মূলত, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ও লাদাখে যে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সৃষ্টি করা হয়েছে তা সঠিকভাবে প্রতিফলিত করতেই নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে ভারত। অর্থাৎ নেপাল-ভারত এখন মুখোমুখি অবস্থায় উপনীত হয়েছে। অথচ ছোট্র ও স্থলবেষ্টিত এই দেশটি স্বাধীনতার পর থেকেই সব কিছুতেই নির্ভরশীল ছিল ভারতের উপর। সে সুযোগে ভারত দেশটির উপর প্রভুত্ব কায়েম করে। নেপাল তাতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও প্রভুত্ব বহাল রাখে ভারত। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় নেপালিরা ভারতের প্রতি চরম নাখোশ হয়ে উঠে। সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে পার্শ্ববর্তী দেশ চীন। নেপালের কল্যাণে এগিয়ে আসে চীন। নেপাল তা সাদরে গ্রহণ করে। এখন দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য এবং নেপালে বিনিয়োগ, রেললাইন স্থাপন ইত্যাদি ব্যাপকভাবে হচ্ছে চীনের সহায়তায়।
শ্রীলংকাও নেপালের মতো ভারতের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং চীনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়া শি গত ১৪ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে বলেছেন, ‘দেশটির সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখন্ডতা ও স্বাধীনতার পক্ষে দঁড়িেিয়ছে চীন। আমরা দেশটিতে বাইরের যেকোনো প্রভাব মেনে নেব না। মূলত শ্রীলঙ্কার যেসব অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে সে সম্পর্কিত বিষয়ে বাইরের কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেব না।’ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার ভাই ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের সঙ্গে বৈঠকের পর এমন কথা বলেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টও বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কা-চীন সম্পর্কের উন্নয়ন, উভয় পক্ষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক শিপিং রুট ও লজিস্টিক হাব হিসেবে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প বাস্তবায়নে যৌথভাবে কাজ করতে তার দেশ সবসময় প্রস্তুত।’ অপরদিকে, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা বলেছেন, ‘বন্দর নগরী কলম্বো এবং হাম্বানটোটা বন্দরের মতো প্রধান প্রকল্পগুলোর উন্নয়নে শ্রীলঙ্কার সরকার সম্পূর্ণ সমর্থন দেবে। এসব প্রকল্প শুধু দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করবে না, একইসঙ্গে মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করবে।’ মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সরকার ২০১৭ সালে হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনকে ইজারা দিয়েছে। স্মরণীয় যে, হাম্বানটোটা বন্দর চীনকে লীজ দেওয়ার কারণে ভারত শঙ্কিত হয়ে পড়েছে বলে মিডিয়ায় প্রকাশ। কারণ, ভারতের ধারণা, এই বন্দরে চীন সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে এবং এখান থেকে ভারত মহাসাগরে খবরদারি চালাবে। তাই অবস্থা বেগতিক দেখে গত ১৯ জানুয়ারি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শ্রীলংকা সফর করেন এবং দেশটির প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক করেন।তাতে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে শ্রীলংকা ও ভারত। সেই সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে সামুদ্রিক ও নৌ যোগাযোগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশ দুটির নেতারা। ইতোমধ্যে অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের লক্ষ্যে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশটিকে ৫ কোটি ডলার সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে নয়াদিল্লি। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ২৬ বছর ধরে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলার পর ২০০৯ সালের মে মাসে এলটিটিকে পরাজিত করে শ্রীলংকার সরকার। এই যুদ্ধে প্রায় এক লাখ লোক নিহত ও প্রায় ২০ হাজার লোক নিখোঁজ হয়।এই নিখোঁজদের সকলেই মারা গেছে বলে প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন সম্প্রতি। এছাড়া, এই যুদ্ধে দেশটির আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ বাঁধিয়েছিল এলটিটি। তামিলদের স্বাধীনতার জন্য তারা এ যুদ্ধ করেছিল। এই এলটিটি সৃষ্টির পেছনে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ইন্ধন ছিল বলে শ্রীলংকানদের ধারণা। বিশ্ব মিডিয়ায়ও তেমন খবর প্রকাশিত হয়েছে বহুবার। সে কারণে দেশটির বেশিরভাগ মানুষ রাজীব গান্ধীর উপর চরম নাখোশ ছিল। যার প্রভাব পড়েছিল তিনি শ্রীলংকা সফরে গেলে। সেখানে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় এক সেনা তাকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করেছিল। তাতে তিনি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন,যা বিশ্বের সব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল তখন।
ভারতের আর এক প্রতিবেশী মিয়ানমারও চীনের উপর নির্ভরশীল। দেশটি স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং রোহিঙ্গা নির্যাতনের কারণে বিশ্বের রোষানলে পড়া মোকাবেলা করছে এবং আর্থিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে চীনের পূর্ণ সহায়তায়। এই অবস্থায় গত ১৭-১৮ জানুয়ারি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন-পিং মিয়ানমার সফর করেন। সে সময় মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ৩৩টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট ও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। এসব চুক্তির মধ্যে রয়েছে চীন থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ইয়াঙ্গুনে একটি নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা। উল্লেখ্য যে, রাখাইনে চীন বন্দর নির্মাণ করলে সেখানে ভারতের নির্মাণ করা বন্দর অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে গত ১৬ জানুয়ারি ডয়চে ভেলের খবরে প্রকাশ, ‘বছর তিনেক আগে ভারত রাখাইনের সিটওয়ে-তে বন্দর তৈরি করেছিল। কালাদান নদী যেখানে সমুদ্রে মিশছে, সেখানেই তৈরি হয়েছে এই বন্দর। অর্থ দিয়েছিল ভারতের বিদেশমন্ত্রক। প্রশ্ন হলো, চীনের বন্দর তৈরি হলে সিটওয়ে বন্দর কি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে ? প্রাক্তন উচ্চপদস্থ আমলা ও পরিকল্পনা বিশারদ অমিতাভ রায় জানিয়েছেন, ‘সেই সম্ভাবনা ষোলআনা আছে। কারণ, আমরা যে বন্দর তৈরি করেছিলাম, সেখান থেকে দুহাত দূরে চীনের বন্দর তৈরি হচ্ছে। এর পাশাপাশি যে বিষয়টা লোকের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে, তা হল, বঙ্গোপসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনের প্রভাব বাঙার ঘটনা।’ ফলে চীনের বন্দর ভারতের কাছে চিন্তার বিষয় হওয়াটাই স্বাভাবিক।উল্লেখ্য যে, মিয়ানমার থেকে গ্যাস-তেল চীনে নেওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
অর্থাৎ বাংলাদেশ ছাড়া অন্য সব প্রতিবেশী দেশের সাথেই সম্পর্ক ভাল নয় ভারতের। তাদের ভালো সম্পর্ক প্রতিদ্ব›দ্বী দেশ চীনের সাথে। বাংলাদেশেরও বেশিরভাগ মানুষ ভারতের প্রতি নাখোশ। কারণ, বাংলাদেশ তার সব ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকেই। অথচ ভারত তার পাওনার সব কিছুই নিয়েছে। যা চেয়েছে তাই-ই পেয়েছে, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে। কিন্তু বিনিময়ে তেমন কিছু আনতে পারেনি। উপরন্তু ভারত এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যখন তখন হস্তক্ষেপ করেছে স্বাধীনতার পর থেকেই। আর সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার তো কোন সীমা নেই। বাণিজ্য ঘাটতিও পাহাড়সম। তবুও দাবি করা হচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে: এ মধুর সম্পর্ক ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নয়, ভারত-আওয়ামী লীগের মধ্যে। কারণ, ভারত শুধুমাত্র এ দেশের আওয়ামী লীগকেই টেষ্টেড এন্ড ট্রাষ্টটেড বন্ধু বলে মনে করে এবং তা প্রকাশ্যে বলেও থাকে। এছাড়া এ দেশের অন্য কোন দলকে পছন্দ করে না ভারত। তাই কোন কোন দল ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এই অবস্থায়ও বাংলাদেশের বর্তমান সরকার চীনের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছে। চীনের আর্থিক সহায়তায় এ দেশের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ ব্যাপারে ভারতের একটু গোস্বা ভাব সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে সরকার বলেছে, চীনের সাথে সম্পর্ক ভাল হলেও তাতে ভারতের কোন অসুবিধা হবেনা। মধুর সম্পর্ক থাকবেই। কিন্তু এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন। তারা চায় ন্যায্য অধিকার আদায় ও সমমর্যাদা এবং দেশ টু দেশ সম্পর্ক। এই অবস্থায় বিজেপি’র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দিলিপ ঘোষ গত ১৯ জানুয়ারি বলেছেন, ‘রাজ্যটিতে অবৈধভাবে বাস করা এক কোটি বাংলাদেশি মুসলিমকে ফেরত পাঠানো হবে।’ এভাবে আসামসহ অনেক রাজ্য হতে বিজেপির নেতারা প্রায়ই মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। ফলে ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলমান চরম শংকার মুখে পড়েছে। এ নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশেও চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মধ্যপ্রাচ্যের ‘গালফ নিউজ’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভারত যে কেন এই নাগরিকত্ব আইনটি আনতে গেল, তা আমার মাথাতেই ঢুকছে না। এর কোনও প্রয়োজনই ছিল না!’ কারণ, ভারতের মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়া হলে তাদের বেশিরভাগেরই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ইতোমধ্যেই কিছু লোক বাংলাদেশে আসা শুরু করেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। কিন্তু ভারতের একজন শরণার্থীও নেওয়ার সামর্থ্য নেই এ দেশের। কারণ, রোহিঙ্গাদের নিয়েই এ দেশ চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তাই ভারতের শরণার্থীদের নেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। সর্বশক্তি দিয়ে এটা ঠেকাতে হবে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকটও প্রকট। সাংবিধানিকভাবে কয়েকটি রাজ্যের মতো কাশ্মীরকেও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সরকার সে বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে গত ৫ আগস্ট এবং সেখানে বিপুল সেনা মোতায়েন করে। কাশ্মীরের মানুষ তা মেনে নেয়নি। তারা প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে দল-মত নির্বিশেষ। ফলে কাশ্মীর সহিংস হয়ে উঠে এবং অচল হয়ে পড়ে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার ও মোবাইল সেবা বন্ধ করে দেয়। সহিংসতায় ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হয়। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দলগুলোও সোচ্চার হয়। অন্যদিকে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর অন্য যেসব রাজ্যে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে,তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে মর্যাদা বাতিলের আশংকায়। তাই সেসব রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যেই মণিপুর রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করেছে লন্ডনে। এই অবস্থায় সরকার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও এনআরসি আইন জারী করেছে। এ নিয়ে সমগ্র ভারত চরম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এই নব আইন দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার করার চেষ্টা বলে সব বিরোধী দল প্রত্যাখান করেছে। উপরন্তু তারা এর প্রতিবাদে সারাদেশে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছে। তাতে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, সুধীমহল তথা সর্বশ্রেণীর মানুষ শামিল হয়েছে। এ নিয়ে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন কংগ্রেসের থিঙ্কট্যাংক কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিস’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সিএএ ভারতের ২০ কোটি মুসলিম নাগরিকের সার্বিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলবে।’ ভারতের পার্লামেন্টেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। কয়েকটি রাজ্যে এই আইন বাতিলের বিরুদ্ধে বিল পাশ হয়েছে। হাইকোর্টে রিট হয়েছে মোট ১৪৪টি। যার শুনানি হয়েছে গত ২২ জানুয়ারি। শুনানিতে স্থগিতাদেশ দেননি সুপ্রিম কোর্ট। তবে, সিএএ আইনের বিরোধিতা করে যত শুনানি সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টে জমা পড়েছে, সেগুলো সম্পর্কে কেন্দ্রের অভিমত জানাতে চার সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সিএএ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। তাতে কোথাও কোথাও ব্যাপক হানাহানিও হচ্ছে। তবুও কোনও পরিস্থিতিতেই সিএএ বাতিল করা হবে না বলে গত ২১ জানুয়ারি ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ফলে দেশটির রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে, দেশটিতে আর্থিক মন্দাভাব চলছে। প্রবৃদ্ধি কমে ৪.৫% দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগ নেই, তাই নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না তেমন। ফলে বেকারত্ব প্রকট হয়েছে। স¤প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে, উন্নত দুনিয়ার সঙ্গে তুলনা তো দূরের কথা, দক্ষিণ এশিয়ায়ও কাজের সুযোগ তৈরিতে পিছিয়ে পড়েছে ভারত। শিক্ষা, কাজ বা কোনও প্রশিক্ষণে যুক্ত নয় এমন মানুষের হার ৪০ শতাংশের বেশি ভারতে। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনে দুজন আক্ষরিক অর্থেই বেকার ভারতে। স¤প্রতি দেশটির এনএসএস রিপোর্টেও বলা হয়েছে, ‘বেকারত্ব ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।’ তথাপিও একের পর এক উৎপাদনস্থল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাতে বেকারত্ব আর বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স¤প্রতি এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ‘এ বছর ১৬ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে।’ অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতি ব্যাপক। গত ডিসেম্বরে ছিল ৭.৩৫%, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধির কারণে শঙ্কা দেখা দিয়েছে স্ট্যাগফ্লেশনের বলে এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। স¤প্রতি আইএমএফও বলেছে, ‘ভারতের অর্থনীতি তলানিতে ঠেকেছে। এমনকি দেশটির আর্থিক সংকট এতোটাই প্রবল আকার নিয়েছে যে রিজার্ভ ব্যাংকের তহবিলে হাত পড়েছে।’ অন্যদিকে, বিজেপি জোটে ফাটল ধরেছে। তাই একের পর এক রাজ্য নির্বাচনে বিজেপি পরাজিত হচ্ছে।
এই অবস্থায় সরকার মুসলিম দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই মালয়েশিয়ার পাম অয়েল তেল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। তুরস্ক থেকেও আমদানি বন্ধ করে দিবে বলে জানিয়েছে ভারত সরকার। কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন আইন বাতিল ও সিএএ এর বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া ও তুরস্ক উচ্চকণ্ঠ হওয়ায় ভারত এই পদক্ষেপ নিয়েছে। একই অবস্থা হয়েছে পাকিস্তান ও চীনের সাথেও। কারণ, এই দু’টি দেশও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন আইন বাতিলের ঘোর বিরোধী। এমনকি তারা বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিশেষ বৈঠকেরও ব্যবস্থা করেছিল। এ নিয়ে মুসলিম দেশগুলোতেও প্রচন্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ওআইসি এর তীব্র নিন্দা করেছে। এই অবস্থায় মালয়েশিয়া ও তুরস্কের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেশ দু’টি সহজে মেনে নিবে বলে মনে হয় না। তারাও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে এবং তাতে আরও অনেক মুসলিম দেশ শামিল হতে পারে। আর সেটা হলে ভারত চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।