বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ আমাদের দেশে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ- এ রকম অনেক পেশাজীবী রয়েছে। এ পেশাজীবীরা দেশের উন্নয়ন, কৃষি, যোগাযোগ, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, জনকল্যাণ, প্রশাসন খাতে কাজ করে থাকে, যার সুফল সাধারণ জনগণ ভোগ করে। আজ ১৩ ফেব্রæয়ারি কৃষিবিদ দিবস। এ দিবসে অন্যান্য পেশার সাথে কৃষিবিদদের দেশ উন্নয়নে অবদানের কথা তুলে ধরতে আমার এ প্রয়াস।
আমরা জানি, ডাক্তারি অনেক বড় মাপের মহৎ পেশা। সামান্য মাথাব্যথা থেকে শুরু করে যে কোনো অসুখ-বিসুখে আমরা ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই। ডাক্তারের মুখের কথার ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। ডাক্তাররা সমাজের সেবক, মানুষের সেবক। তারা অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলেন। তেমনি ভেটেরিনারি চিকিৎসকও অসুস্থ পশুকে সুস্থ করে তুলেন। একজন কৃষিবিজ্ঞানী কৃষির উৎকর্ষের জন্য গবেষণা করেন, গবেষণা করে উদ্ভাবন করেন নতুন প্রযুক্তি, আর সে প্রযুক্তি মাঠে সম্প্রসারণও করেন কৃষিবিদরা।
বিগত দিনে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু সাফল্য রয়েছে। প্রসূতি ও নবজাতকের উন্নত চিকিৎসা প্রদানের ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া ভিটামিনের সঠিক প্রয়োগে প্রসূতি ও নবজাতকের ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ উল্লেখযোগ্য হারে নেমে এসেছে। এখন প্রতি বছর ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট তারিখে শিশুদের হেপাটাইটিস বি, হাম, কৃমি, পোলিওসহ নানা রোগের প্রতিষেধক ওষুধ খাওয়ানো হয়। কিন্তু চিকিৎসা পেশার সাথে সংশ্লিষ্টদের গবেষণা, আবিষ্কার আমাদের দেশে খুবই নগন্য।
আমাদের সমাজের একেবারে উচ্চশ্রেণীর পেশাগুলোর মধ্যে একটি হল প্রকৌশলী পেশা। এই পেশার যেমনটা সম্মান রয়েছে তেমন রয়েছে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা। এই পেশার মানুষজন একটি সমাজের নির্মাতা হিসেবে কাজ করে। আর এই কারণেই এই পেশাটি অনেক বেশি জনপ্রিয়। জনপ্রিয় হলেও এ পেশাজীবীদের আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হাতে গোণা। আমরা যদি অন্যান্য পেশার সঙ্গে কৃষি পেশাকে তুলনা করি তাহলে দেখব কৃষিবিদদের গবেষনা সরাসরি দেশ উন্নয়নে কাজ করছে।
আজ সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে, বর্তমান সময় এ দেশের উন্নতির জন্য বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত কৃষিবিদরাই বেশি অবদান রেখেছে এবং রেখে চলেছে। কৃষিবিদদের হাতেই সৃষ্টি হচ্ছে ফসলের নতুন জাত কিংবা ফসলের উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি। শুধু ফসল কেন, ফসলের পাশাপাশি গবাদিপশুর উন্নয়ন, দুধের মান ও পরিমাণ বাড়ানো, মাংসের জন্য উন্নত জাতের পশুপালন প্রযুক্তি, বিভিন্ন ধরনের মাছের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি খামারের বিভিন্ন প্রকার যান্ত্রিকীকরণ কিংবা কৃষির সব ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণÑ এসবই কৃষিবিদদের হাতের স্পর্শে প্রাণ পায়। উজ্জীবিত হয় সংশ্লিষ্ট সবাই। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার সুবাদে কৃষিবিদগণ এদেশে আজ এক মর্যাদাবান পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃত। কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণা ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে দেশ আজ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিভিন্ন সূচকে বিশ্বের জন্য পথিক।
ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ অবস্থানে। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। কেবল সবজি আর ধানেই নয়; মাছ, ছাগল উৎপাদনেও বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ, আমে সপ্তম, আলুতে অষ্টম এবং ফলে দশম। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হয় তার ৮৬ শতাংশই হয় আমাদের দেশে। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বø্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। আম উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অবস্থানে। আর আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ দশ দেশের কাতারে এসেছে দেশ। বাংলাদেশ থেকে আলু, সবজি আর আম রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ।
এসব সম্ভব হয়েছে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষনার মাধ্যমে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ৮৮ টি ইনব্রিড ও ৬ টি হাইব্রিড উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। পরমাণু শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের মোট ১০৮টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে এবং দেশের কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলছে। এছাড়াও, বিনা সাফল্যের সাথে উদ্ভাবন করেছে শিম, ডাল ও তেল জাতীয় ৮ টি ফসলের জন্য জীবাণুসার, যা মাটির গুণাগুণ রক্ষাসহ ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
দেশের জলবায়ু ও কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এই পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের ৫৪৫টি উচ্চ ফলনশীল জাত এবং ৫০৫টি ফসল উৎপাদনের প্রযুক্তিসহ মোট ১০৫০ টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ডাল, তৈলবীজ, সবজি, ফলের দশ হাজারে এর অধিক কৌলি সম্পদ (জার্মপ্লাজম) জিন ব্যাংকের মাধ্যমে সংরক্ষণ করছে। পাট জাতীয় ফসলের ৪৫টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যার মধ্যে দেশি পাট ২৪টি, তোষা পাট ১৫টি, কেনাফ ৪টি ও মেস্তা ২টি। উক্ত ৪৫টি জাতের মধ্যে বর্তমানে ৯টি দেশী, ৬টি তোষা, ৩টি কেনাফ এবং ২টি মেস্তা জাতের বীজ বানিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ও আবাদ হচ্ছে। এ ছাড়া সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ৪৬ টি জাত অবমুক্ত করেছে। এর বাইরে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো গবেষনা করে বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন করেছে।
সরকারের ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশের উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে। চিংড়ি রফতানি থেকে প্রতি বছর আমাদের আয় ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া পুষ্টির অন্যান্য উৎপাদন ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদনও বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে বৃদ্ধি পেয়েছে এসব পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জনপ্রতি প্রাপ্যতা।
সরকারের সুপ্রসারিত কৃষিনীতি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাণিজ্যিক কৃষির উন্নয়ন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং উন্নয়নসহ কৃষির আধুনিকীকরণ, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে গবেষণা সুবিধা বৃদ্ধিসহ নানামুখী পদক্ষেপের কারণে কৃষিতে ঘটছে নীরব বিপ্লব। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। আরও কত নিত্যনতুন সফলতার হাতছানি আমাদের ডাকছে শুভ সুন্দর আগামীতে। সবই কৃষিবিদদের ঐকান্তিক চেষ্টার সফলতা পেয়েছে।
এক সময় কৃষক যেমন শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হতেন, তেমনই কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু কৃষিবিদরাও সামাজিক অবহেলা তথা অমর্যাদার শিকার হতেন। স্বাধীনতার আগে স্নাতক শেষ করে চাকরিতে যোগদানের সময় কৃষিবিদদের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হতো। ফলে স্বাধীনতার আগে থেকেই চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীদের মতো কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়ার দাবি ওঠে। এ সময় দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে মারা যায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মলয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব ভালো করেই জানতেন, কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির সম্পূর্ণ বিকাশ ও উৎকর্ষ ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। অবশেষে সেই আন্দোলনের সফল সমাপ্তি হয়েছে জাতির জনকের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির হিসেবে আখ্যায়িত করে পে-স্কেল সংশোধনের ব্যবস্থা করেন। এর পর থেকে প্রথম শ্রেণির সুবিধাগুলো পে-স্কেলের মাধ্যমেও স্বীকৃত হয়। এর ফলে কৃষিবিদরা যেমন সম্মানিত হয়েছেন, তেমনি দেশে কৃষিরও ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাতে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
দেশের অঞ্চভিত্তিক আরও নতুন জাত উদ্ভাবন, কৃষককে ফসলি উৎপাদণে আগ্রহীকরণ,অঞ্চলভিত্তিক কৃষিসেবা প্রদান, বিভিন্ন কৃষি সংস্থার যথাযথ সহযোগিতা এবং কৃষিবিদদের নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষিতে আরো উন্নয়ন সম্ভব। এছাড়া কৃষি ইপিজেড ও কৃষির যান্ত্রিকীকরণই হবে আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের হাতিয়ার যার ফলে সকল কৃষিসেবা পৌঁছে যাবে কৃষকের দ্বোরগোড়ায়। আশা করি, বর্তমান সরকারের ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়ন হলে এই দেশের সর্বত্র বিশেষ করে উপকূলীয় কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন হবে এবং ফসল উৎপাদণ বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ হারে।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে বার্ষিক খাদ্যশস্য উৎপাদন হতো দেড় কোটি মেট্রিক টন। অথচ বর্তমানে বার্ষিক খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে তিন কোটি মেট্রিক টনের বেশি। আর এই উৎপাদন চার কোটি মেট্রিক টনে পৌঁছাতে চলছে নানা পরিকল্পনা। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত নানা কারণে দেশের কৃষিজমি কমেছে অর্ধেকের বেশি। তারপরেও কৃষিতে এই সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে সাধারণ কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কৃষিবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণার ফলে। কৃষিবিদরা নিজেদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্যই নিজ নিজ দায়িত্বে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকুক, এগিয়ে যাক আমাদের কৃষি, বাংলাদেশ খাদ্যশস্য রপ্তানীকারক দেশে পরিণত হোক- কৃষিবিদ দিবসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়