বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উপস্থিতি নিয়েও রয়েছে গোঁজামিল।
ফলে কোমলমতি শিশুরাও বিদ্যালয়ে আসে নিজেদের ইচ্ছামতো। আবার অনেক বিদ্যালয় চলে ভাড়াটিয়া শিক্ষক দিয়ে। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের ‘সয়ার ধোলাইঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ ও ‘সয়ার শ্যামগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ ঘুরে পাওয়া গেছে এমন অনিয়মের বাস্তব চিত্র। ওই দুই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাসে আসেন নিজেদের মনমতো। চলেও যান সময়ের তোয়াক্কা না করেই।
তারাগঞ্জ সয়ার ধোলাইঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মাত্র দুজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন। অন্য ক্লাসে শিক্ষক না থাকায় তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা স্কুল মাঠে খেলাধুলায় ব্যস্ত। শিক্ষার্থী কৈলাস রায় ও মুন্না মিয়া বলে, এত বেলা হইছে স্যারেরা এখনো স্কুলোত আইসে নাই। ওই জন্যে আমরা বাইরোত খেলা করুচ্চি।
এ সময় দেখা যায়, রমানাথ চন্দ্র রায় নামের এক ব্যক্তি চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। এর পাশের কক্ষে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নিতে দেখা যায় নুরুল হুদা নামের এক কিশোরকে। সে ভাড়াটিয়া হিসেবে ওই বিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছে।
নুরুল হুদা বলে, ‘আমি বিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষক নই। প্রধান শিক্ষক আমাকে দেড় মাস আগে মৌখিক চুক্তিতে পাঠদান করাতে অনুরোধ করেন। ’ প্রধান শিক্ষিক মাসে কত টাকা বেতন দেন জানতে চাইলে সে বলে, ‘চুক্তি হয়নি। এখনো টাকা পাইনি। ’ খবর পেয়ে বিদ্যালয়ে আসেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার বেগম। যথাসময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এক শিক্ষার্থী অসুস্থ। তাকে দেখার জন্য ঘণ্টাখানেক আগে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। এ কারণে বিদ্যালয়ে আসতে কিছুটা দেরি হয়েছে। ’
স্থানীয় সূত্র জানায়, সয়ার ধোলাইঘাট প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৯৫ সালে স্থাপিত হয়। সেখানে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাত্র ১৬৫ জন শিক্ষার্থী আছে। প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষকের পদ রয়েছে চারটি। ওই দিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত অবস্থান করেও সহকারী শিক্ষক সুজাউল হক ও আরজিনা বেগমকে বিদ্যালয়ে পাওয়া যায়নি। বিদ্যালয়ে দুই শিক্ষক না থাকার কারণ জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘সকালের দিকে দুই শিক্ষকই স্কুলে ছিলেন। দুপুর ১২টায় শিক্ষক সুজাউল বিদ্যালয়ের কাজে উপজেলা শিক্ষা কার্যালয়ে গেছেন। আর সহকারী শিক্ষক আরজিনার সন্তান অসুস্থ হওয়ায় তিনি টিফিনের পর ছুটি নিয়েছেন। ’ তবে আরজিনার ছুটির কোনো আবেদনপত্র দেখাতে পারেননি প্রধান শিক্ষক। অনিয়মের চিত্র এতেই শেষ নয়। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতীয় সংগীত গাইতে পারে না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিদ্যালয়ে নিয়মিত পিটি প্যারেড হয় না। অনেক শিক্ষার্থী নিজের ক্লাসের নামও বাংলায় লিখতে পারে না। তৃতীয় শ্রেণির কৈলাস চন্দ্র রায়কে বাংলায় তৃতীয় বানান লিখতে বলা হলে সে ‘তৃথিয়’ লিখে দেয়। একই অবস্থা অন্য শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও। এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘আজ হয়তো শিশুরা ভয় পাচ্ছে। অন্য এক দিন আসেন। ঠিকই তারা সব কিছু লিখে দিতে পারবে। প্রতিদিন অ্যাসেম্বলি হয়। তবে তিন-চার দিন ধরে তা হচ্ছে না। ’ তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার বলে, ‘স্যারেরা ঠিকভাবে ক্লাস নেয় না। আমাদের স্কুলে জাতীয় সংগীতও হয় না। ’ একই কথা বলে, পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহেবুবা ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী তিলক চন্দ্র।
এদিকে শ্যামগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৭২ সালে। সেখানেও শিক্ষক রয়েছেন চারজন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫৭। বিদ্যালয়ে গিয়ে দুজনকে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নিতে দেখা যায়। এর মধ্যে একজন লুঙ্গি পরিহিত কিশোর। তার নাম শিপন মিয়া। সে তারাগঞ্জ ফাজিল মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছে। শিপন বলে, ‘মুই (আমি) শিক্ষক নোয়াও (নই)। স্কুলের মুর্শিদা আপা আইজ আইসে নাই। সেই জন্যে তার পরিবর্তে ক্লাস নেওচি। ’ একই সময় তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস নিতে দেখা যায় বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোতাহার হোসেনকে।
তিনি বলেন, ‘বিদ্যালয়ে চারজন শিক্ষক। এর মধ্যে শিল্পী বেগম নামের একজন সহকারী শিক্ষক দেড় বছরের প্রশিক্ষণের জন্য রংপুরে গেছেন। প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন সরকার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা শিক্ষা অফিসে গেছেন বিদ্যালয়ের কাজে। সহকারী শিক্ষক মুর্শিদা বেগমের সন্তান হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় তিনি টিফিনের সময় চলে গেছেন। লুঙ্গি পরা ছেলেটি ক্লাস নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মুর্শিদা বেগমের নির্দেশে ওই ছেলে ক্লাস নিচ্ছে। ’ সহকারী শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মোটরসাইকেলে চড়ে বিদ্যালয়ে আসেন প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন সরদার। তিনি এসে সরাসরি পঞ্চম শ্রেণির ক্লাসে ঢোকেন। তাত্ক্ষণিকভাবে তিনি লুঙ্গি পরা ছেলেটিকে বিদ্যালয় ত্যাগ করতে বলেন।
শিক্ষক না হয়েও ওই তরুণ ক্লাস নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আপনারা ভুল দেখেছেন। ওই তরুণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নয়। সে কেন ক্লাস নেবে ? ওই তরুণের ক্লাস নেওয়ার ভিডিও চিত্র ও তার বক্তব্য শোনানো হলে প্রধান শিক্ষক কিছুটা বিব্রত বোধ করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘ওই তরুণ আগামী বছর জেডিসি পরীক্ষা দেবে। সে গরিব ঘরের সন্তান। বিদ্যালয়ে সে বেশির ভাগ সময় ঘর ঝাড়ু দেয়। আমরা তাকে লেখাপড়া করার জন্য কিছু টাকা-পয়সাও দিই। এতে দোষের কী?’ বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মনিরুজ্জামান ও তানজিনা খাতুন বলে, স্যারেরা স্কুলে আসার পর দু-এক ঘণ্টা থেকেই চলে যায়। স্যারেরা না থাকলে শিপন স্যার (ভাড়াটিয়া শিক্ষক) ক্লাস নিয়ে আমাদের ছুটি দিয়ে দেয়।
তারাগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রমিতা ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিদ্যালয়ে ভাড়াটিয়া শিক্ষক রাখার কোনো বিধান নেই। বিষয়টি শুনেছি। দুই প্রধানকে শোকজ করা হয়েছে। জবাব পাওয়ার পর তদন্ত সাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’ বক্তব্য জানতে তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিলুফার সুলতানার মোবাইলে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।-কালেরকন্ঠ