বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ কিন্তু মানুষ হচ্ছি কি? মানুষ জাতির মধ্যেও রয়েছে অনেক ভিন্নতা। ভিন্নতার ধরনগুলো হলো ধর্মগত পার্থক্য, অর্থের দিক থেকে উচ্চ ও নিম্নতার দিক। বিবর্তনের সামঞ্জস্যতার জন্যই হয়তো সৃষ্টিকর্তার এমন পরিকল্পনীয় ব্যবস্থা। তবে আমরা যে ধর্মেরই অনুসারী হই না কেন, সব ধর্মের মূলনীতি শান্তি ও সম্প্রীতি। কিন্তু মানবজাতি এই শান্তি বা সম্প্রীতি কি আসলেই বজায় রাখতে পারছে? বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) ইত্তেফাক পত্রিকার নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ফারহানা নওশিন তিতলী
নিবন্ধে আরও জানা যায়, যত সময় যাচ্ছে আমরা যেন ততই সহিংস জাতিতে পরিণত হচ্ছি। সামান্য স্বার্থে বিবেক ও নৈতিকতার জলাঞ্জলি দিয়ে দিচ্ছি মুহূর্তেই। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের সবার মধ্যে যদি একটু হলেও বিবেক বোধ থাকত তাহলে সন্তান বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে পারত না, মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করতে পারত না, রাস্তা-ঘাটে প্রতিবন্ধী শিশুসহ মা-বোনদের ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হতে হতো না। বাবাতুল্য শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীকে নিগৃহীত হতে হতো না।
মানুষের মধ্যে যদি আজ বিন্দুমাত্র নৈতিকতা থাকত তাহলে ডাক্তারির মতো মহান পেশাকে ব্যবসা হিসাবে দেখা হতো না, মা তার সদ্য জন্মানো সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে পারত না। মানুষ জাতির এমন বিকৃত কার্যকলাপের জন্যই হয়তো অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘মানুষ বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী, যখন সে আইন ও বিচার ক্ষমতাসম্পন্ন থাকে, তখন সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব, আর যখন সে আইন ও বিচারক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন সে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম প্রাণী।’
অ্যারিস্টটলের কথার সঙ্গে বাস্তব সমাজচিত্রের শতভাগ মিল এখন সবার চোখে চোখে। সরকার ও ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৩.৯ শতাংশ। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার মোটামুটি সহনীয় বলা চলে। কিন্তু সাক্ষরতার হার এবং শিক্ষা এই দুটি শব্দ কি এক? একটি দেশের সাক্ষরতার হার ভালো থাকলেই সেই দেশটির জনগণকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত বলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আমাদের দেশে ঘরে ঘরে এখন শিক্ষার আলো জ্বলতে শুরু করেছে।
কিন্তু খুব ভালো না শোনালেও বাস্তবতায় শিক্ষার আলো যত জ্বলছে, নৈতিকতা ও বিবেকের আলো তার ব্যস্তানুপাতিক হারে কমছে। কোথায় আমরা শিক্ষা অর্জন করে আমাদের নীতি, নৈতিকতা ও বিবেকের পথ আরো সম্প্রসারিত করব কিন্তু তার পরিবর্তে আমাদের অন্তরের আন্তরিকতার ইতি ঘটেই চলছে আমাদের আশপাশের কিছু মানুষের কর্মকাণ্ডে। প্রকৃত শিক্ষা যে খাতা-কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তা তখনই উপলব্ধি করা যায়, যখন সরকারি বড় বড় মহলের উচ্চ শিক্ষিত ও উচ্চ পদস্থ কর্মব্যক্তিদের দ্বারা সাধারণ মানুষ ও দেশের চরম অবক্ষয়ের মতো ঘটনা আমাদের সামনে আসে। ক্ষমতার লোভে মানুষ হিংস্র পশুতে পরিণত হচ্ছে। আমরা আমাদের নানি-দাদিদের মুখে প্রায়ই একটা কথা শুনি যে, যুগ পালটেছে। এই কথাটির বিশ্লেষণ করলে অনেক কিছুই ধারণা করা যায়।
যেমন দেশের মানুষ শিক্ষিত হয়ে দেশের অনেক উন্নয়ন করেছে আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষগুলো উগ্র হয়ে গেছে। কোনটা বেশি গ্রহণযোগ্য? আগের যুগের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে জানা যায় তখন মানুষ মানুষের প্রতি এত সহিংস ছিল না। তখন গ্রাম ও শহরের উভয় মানুষই একে অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলাফেরা করত। একজন কোনো বিপদে পড়লে সবাই একসঙ্গে সেই সমস্যার সমাধান করত। কিন্তু বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগের যুগে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার কম থাকলেও মানুষের মধ্যে নৈতিকতার আলো ছিল। তাহলে বর্তমানের এই ব্যাপক পরিধিতে সাক্ষরতার হার বেড়ে কী লাভ হচ্ছে, যদি সেই শিক্ষা কোনো কাজেই না আসে। তবে স্বস্তির বিষয় হলো আমাদের আশপাশে এখনো অনেকে রয়েছে যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এখনো আওয়াজ তুলছেন।
মানবিকতা এখনো যে একটু হলেও বেঁচে আছে তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ এই মানুষগুলো। কিন্তু খারাপ মানুষের চেয়ে ভালো মানুষের সংখ্যা লঘু হওয়ায় ভালো মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলায় তাদের বিপদে পড়তে হচ্ছে। আমরা না হয় সেই ভালো মানুষগুলোর মতো সাহসিকতা না-ই বা দেখালাম, অন্তত তাদের এমন মহত্ কাজে যাতে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়—সেটুকুর জন্য চেষ্টা করি। ভালো মানুষ না হয়েও যদি অন্তরে একটু মানবিকতাকে স্থান দিই তাহলেই দেখবেন পৃথিবীটা আবার বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেছে। দিন দিন আমাদের মাঝে ছাড় দেওয়ার মনোভাব কমে যাচ্ছে। পরিবারপরিজন থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধবের সম্পর্কগুলোর পেছনেও এখন স্বার্থের টান রয়েছে। এক কথায় আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের গ্রাস করছে। পৃথিবীতে যদি একাই টিকে থাকা সম্ভব হতো তাহলে মানুষ নিঃসঙ্গতায় ভুগত না। তাই শুধু একা নয় সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শিখুন। শুধু মুখে নয় আপনার প্রতিনিয়ত কর্মকাণ্ডে মানবিকতার চর্চা করুন। ভয় দিয়ে নয়, মানবিকতা দিয়ে জয় করি এই পৃথিবীকে।