সত্তরের দশকের শেষ দিকে, লন্ডনে মধ্যম মানের একটি ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানির প্রধান ছিলাম আমি। হঠাৎ করে মাথায় ভূত চাপলো মোহাম্মদ আলীকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার। দেশটি তখনও নতুন। দরকার ছিল বৈশ্বিক স্বীকৃতি। বহুবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আমরা আলীকে রাজি করলাম। তবে এক্ষেত্রে একটি ছোট কাহিনীও ছিল।
লিও স্পিঙ্কসের সঙ্গে একটি লড়াইয়ের কথা ছিল আলীর। আমরা ভেবেছিলাম, আলী না খেলায় স্পিঙ্কস ওয়াকওভার পেয়ে জিতে যাবেন। কিন্তু আসলে তা হয়নি। আলী খেলেছিলেন এবং তাকে পরাজিত করেছিলেন স্পিঙ্কস। এ ঘটনায় বিমর্ষ হয়ে যান আলী।
লস এঞ্জেলেস থেকে আমাকে তিনি ফোন দিয়ে বলেন, যেহেতু হেরেছেন, তাই বাংলাদেশের ভক্তদের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না তিনি। আমি বলি, ‘না, ভাই। তারা এখনও তোমাকে ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ হিসেবে ভালোবাসে। প্রেসিডেন্ট থেকে চাষাভুষা- অর্থাৎ গোটা বাংলাদেশ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে তোমার বিশ্বাস করতেই হবে।’
আলী ঠাট্টাচ্ছলে তার কণ্ঠ নিচু করলেন। অনেকটা চুপিসারে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই রেগ, তুমি কি সিরিয়াস?’
‘আল্লাহর নামে বলছি, আই অ্যাম ডেড সিরিয়াস,’ জবাব দিলাম আমি। আলীর পাল্টা জবাব, ‘ঠিক আছে, আমি আসবো। বাট ডোন্ট ডাই জাস্ট ইয়েট।’
আমরা আলীর সফর ফিল্মবদ্ধ করলাম। তখন তার পাশে ছিলেন তৎকালীন স্ত্রী ভেরোনিকা। আশপাশে ছিল একদল বন্ধুবান্ধব ও দেহরক্ষী। তথ্যচিত্রটির নাম দেয়া হলো ‘বাংলাদেশ আই লাভ ইয়ু’। লন্ডনে শেষ হলো সম্পাদনার কাজ। লর্ড গ্রেড কোম্পানি এর ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ সারে।
কয়েক বছর পর, আমি একই কায়দায় ‘ইন্ডিয়া আই লাভ ইয়ু’ নামে একটি তথ্যচিত্র বানাতে চাইলাম। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সব ঠিকঠাক, চিত্রধারণের তারিখও নির্ধারিত হলো। কিন্তু এরপর আন্তর্জাতিক রাজনীতির বলি হতে হলো তথ্যচিত্রটিকে। আমরা তখন মাদ্রাজে (এখন চেন্নাই) ছিলাম।
আমার রুমে একটি কল এলো। আমেরিকান অ্যাকসেন্টে অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো, ‘আমি আলীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ আমি বললাম, ‘আলী তার সুইটে বিশ্রাম নিচ্ছে। ভারতের এদিকটায় খুব গরম।’ অপর প্রান্ত থেকে আরো ভরাট গলায় বলা হলো, ‘ওয়েল, তার কাছে যান। তাকে বলুন যে, আমি জিমি কার্টার, হোয়াইট হাউস থেকে, যিনি এখনই তার সঙ্গে কথা বলতে চান!’
আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোনকলটা আলীর রুমে ট্রান্সফার করলাম। দৌড়ে গেলাম তার সুইটের দিকে। আমি যখন আলীর রুমে পৌঁছালাম তখন তাকে টেলিফোন ধরা অবস্থায় বলতে শুনলাম, ‘জ্বি, মি. প্রেসিডেন্ট। আমি এখানে সব বাদ দিচ্ছি।’
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টার আলীকে প্রত্যেকটি মুসলিম দেশ সফর করতে বলেছিলেন, যাতে তারা আসন্ন মস্কো অলিম্পিক বয়কট করে। কারণ, ঘণ্টা কয়েক আগেই আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া।
কথা শেষে আলী আমাকে বললেন, ‘আমার প্রেসিডেন্ট আমাকে আদেশ দিয়েছেন। অবশ্যই এ কথা শুনতে হবে আমার।’ মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে, একটি বিমান চলে আসে। ভেতরে মার্কিন কমান্ডো দল। আলী ও তার পরিবার ঢুকে যান বিমানে। আমার তথ্যচিত্র নির্মাণ শেষ!
(রেজিনাল্ড ম্যাসি একজন বিশ্ববিখ্যাত বৃটিশ লেখক, কবি ও সাংবাদিক। এ লেখাটি দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত তার ‘হাউ মোহাম্মদ আলী শোড হিজ লাভ ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধ থেকে অনূদিত।