বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ পাঁচ দশকে খাদ্য উৎপাদন চারগুণ বাড়ালেও কৃষক এর সুবিধা পাচ্ছেন না। মৌসুমে সস্তায় ফসল বিক্রি করে, ক’দিন পর তাদের বেশি দামে খাবার কিনতে হয়; এ দুষ্টচক্র থেকে যেন কৃষকের মুক্তি নেই। সরকারি পরিসংখ্যানও বলছে, খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও গ্রামের মানুষ আগের চেয়ে কম খেতে পাচ্ছে। শুধু মাছ-মাংস নয়, ভাতও কম পাচ্ছে তারা।
কৃষকের পাতের খবর নিতে কাঁঠালতলী যাওয়া। রাজধানী থেকে হাত বাড়ানো দূরত্বে কেরানীগঞ্জ উপজেলার তারানগর ইউনিয়নে এ গ্রাম। আর দশটি গ্রামের মতো কাঁঠালতলীর অধিকাংশ বাসিন্দার পেশাও কৃষি। মাজেদ আলী তাদের একজন। চাষ করেন পরের জমি পত্তন (ভাড়ায়) নিয়ে। গেল শীতে ধনেপাতা চাষ করেছিলেন ১০৪ শতাংশ জমিতে। এবার ৯১ শতক জমিতে ধান ও বাকি অংশে পাটশাক চাষ করেছেন।
পত্তনের ভাড়া, বীজ, পানি, সার, কীটনাশকসহ ধনেক্ষেতে খরচ হয়েছিল আট হাজার টাকা। পাতা বিক্রি করেছিলেন ১৪ হাজার টাকার। ছয় হাজার টাকাকে মুনাফা বলতে রাজি নন মাজেদ আলী। কারণ জমিতে এক মাস শ্রম দিয়েছেন। কাঁঠালতলীতে বর্তমানে কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি চারশ’ টাকা। হিসাব দিলেন, এক মাসে পরের জমিতে কাজ করলেও ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা পেতেন। সারা মাস খেটে ধনেক্ষেত থেকে পেয়েছেন ছয় হাজার টাকা। ঘামের দামই ওঠেনি।
মাজেদ আলী ধানের ক্ষেতে এরই মধ্যে খরচ করেছেন ১১ হাজার টাকা। মৌসুমে ধানের দরের পতন হলে লাভ থাকবে কি-না তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। লোকসান পোষাতে ১৩ শতাংশ জমিতে পাট চাষ করেছেন। খরচ হয়েছে ৬০০ টাকা। নিয়মিত তাকে শ্রম দিতে হচ্ছে ক্ষেতে। গত মঙ্গলবার দুপুরে কাঁঠালতলীর শুঁটকিরটেকে পাটক্ষেতে মাজেদ আলীর সঙ্গে দেখা। শাক তুলে আঁটি বাঁধতে ব্যস্ত তিনি। এক ফাঁকে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলেন। বাড়ি থেকে ভাত ও যৎসামান্য ছোট মাছের তরকারি নিয়ে আসেন। ঝোলে ভাত ভেজে না, এত সামান্য তরকারি। তাই দিয়ে খেয়ে ওঠেন, আবার কাজে লেগে যান।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে কাজ শেষ হলো। ক্ষেত থেকে ২০০ আঁটি শাক তোলেন তিনি। তাতেই ক্ষেতের এক-তৃতীয়াংশ ফাঁকা। অবশিষ্ট পাটে ৪০০ থেকে ৫০০ আঁটি শাক হবে। শাক নিয়ে গেলেন কাঁঠালতলী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। ৮০ টাকা পিকআপ ভাড়ায় শাক নেন রায়েরবাজার আড়তে। দুই টাকা ধরে ৪০০ টাকায় সব শাক বিক্রি করেন। পাইকাররা এ শাক কেনেন আড়াই থেকে তিন টাকায়। খুচরা বিক্রেতারা কেনেন চার থেকে সাড়ে চার টাকায়। সাধারণ ক্রেতা কেনেন সাত থেকে ১০ টাকায়!
এক আঁটি শাক শেষ পর্যন্ত ১০ টাকায় বিক্রি হলেও মাজেদ আলীর মতো সাধারণ কৃষক পাচ্ছেন দুই টাকা। কিন্তু তার বড় অংশই চলে যাচ্ছে ফসল উৎপাদনে। ঘামের দাম পাচ্ছেন না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কৃষকের খাদ্য তালিকায়। মাজেদ আলীর প্রতিদিনের খাবার তালিকা একই রকম; ভর্তা, ভাজি, শাক, ভাত, ডালে দিন কাটে। বড় মাছ, মাংস খান কালেভদ্রে।
গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬’ও সে কথা বলছে। জরিপ বিশ্নেষণে দেখা যায়, গ্রামের মানুষের থালায় খাবার কমছে দিন দিন। গ্রামেই শতভাগ কৃষকের বাস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে গ্রামের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৫ গ্রাম খাবার গ্রহণ করতেন। ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯৭৪ গ্রামে। শুধু শর্করা (চাল, গম, আলু) নয়, আমিষ গ্রহণও কমেছে। কমেছে দুধ ও ফলজাতীয় খাবারও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খুরশীদ জাহান বলেন, গ্রামের মানুষ কায়িক পরিশ্রম বেশি করেন। তাদের জন্য পুষ্টিকর খাবার বেশি জরুরি। কিন্তু কৃষক তা যে পাচ্ছেন না, তা মাজেদ আলীর দিনলিপি থেকেই স্পষ্ট। কৃষিতে লোকসান ও পরিশ্রমের দাম না পাওয়ায় জমির মালিকরা চাষ ছেড়ে ব্যবসায় ঝুঁকছেন। জমি ভাড়া, বর্গা দিচ্ছেন প্রান্তিক ভূমিহীন কৃষককে। তারা চাষের খরচ তুলতে পারলেও ঘামের দাম তুলতে পারছেন না, তাই অভুক্ত থেকে যাচ্ছেন।
উৎপাদিত পণ্যের দাম না পেয়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। গত ২৯ মার্চ নাটোরের বড়াইগ্রামের মাঝগাঁও ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামের কৃষক রহুল আমিন গলায় দড়ি দেন। ঋণ করে দেড় বিঘা জমিতে রসুন চাষ করেছিলেন। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায় ঋণ শোধ করতে পারবেন না, এ আশঙ্কায় আত্মহত্যা করেন। রহুল যখন আত্মহত্যা করেন, তখন বড়াইগ্রামের আড়তে রসুনের দাম ছিল ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ। কিন্তু সেই সময়েও ঢাকায় রসুন বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কৃষক ও ভোক্তা বরাবর ঠকছে। কৃষক দাম পায় না, আবার ভোক্তাকে চড়া দামে খাদ্য কিনতে হয়। এ দ্বিমুখী অনিয়ম বন্ধে আইন থাকা প্রয়োজন।
সমতলে কার্তিক-চৈত্রে অভাব কমলেও, পাহাড়ে প্রায় প্রতি বছর খাদ্য সংকট হচ্ছে জুমের ফলন কমে যাওয়ায়। সাজেক, থানচি, রুমার মতো দুর্গম এলাকায় মানুষ অনাহারে দিন কাটায় চৈত্র-বৈশাখ মাসে। ‘গেল্গাবাল সিকিউরিটি ইনডেক্স’-এ খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে ১০৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯তম।
হতদরিদ্রদের খাদ্য সহায়তায় ১০ টাকায় চাল, ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখার মতো কর্মসূচি রয়েছে। সেবামূলক এসব কর্মসূচির মাধ্যমে খাদ্য অধিকার বাস্তবায়ন করা যায়নি। খাদ্য অধিকার বাস্তবায়নে ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আইনের খসড়া আইন ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, খসড়াটি পরিবর্তন, পরিমার্জন করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। খাদ্য নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এর আইনি রূপ দিতেই ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ করা হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, দেশে খাদ্য সংকট নেই। খাদ্যের সুষম বণ্টনের অভাব রয়েছে। তাই সবার খাদ্যপ্রাপ্যতা নিশ্চিতে আইন করা হচ্ছে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, দরিদ্র পরিবার মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য ভর্তুকি মূল্যে পাবে। গর্ভবতী ও দুগ্ধদাত্রী মায়েরা সন্তান জন্মের ছয় মাস পর্যন্ত বিনামূল্যে পুষ্টিকর খাবার পাবেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী সমকালকে বলেন, সংবিধানেও খাদ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাই সবার খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদন ব্যয় তুলতে কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তাকেও ন্যায্য দামে খাবার দিতে হবে। এই দুই দামের মাঝে কতটা ব্যবধান থাকবে, তা নির্ধারণ করে দিতে হবে আইনে।
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের (খানি) সভাপতি ও ইরি বাংলাদেশের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. জয়নুল আবেদিন বলেন, বর্তমানে দেশে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক ১ হাজার ৮০৫ ক্যালরি গ্রহণের জন্য খাবার কিনতে প্রয়োজনীয় আয় করতে পারেন না। বর্তমানে খাবারের জন্য মানুষ মারা যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটে না, কিন্তু পুষ্টিহীনতা, পর্যাপ্ত সুষম খাবার না পাওয়া মানুষকে কর্মক্ষমতা এবং আয়ু কমিয়ে দেয়। এ জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয়ের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু ‘ভাত’ নয়, বরং নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা, খাদ্যের জোগান থাকা খুবই জরুরি। জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়টিকে দান বা সেবামূলক কর্মসূচি হিসেবে না দেখে ‘অধিকারভিত্তিক’ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দেখা প্রয়োজন। অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের স্বীকৃতি থাকলে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয় বিধায় খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি আইনি কাঠামো প্রণয়ন করা জরুরি।