বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বেশির ভাগ মানুষের দেহের তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বা এর নিচে থাকে। এর এক ডিগ্রির ওপরে থাকলেই তা জ্বর হিসেবে বিবেচিত। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া উভয় সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রায়ই প্রথম লক্ষণ এই জ্বর। অর্থাৎ জ্বর হলো যেকোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণ বা শরীরের অন্তর্নিহিত অসুস্থতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চেষ্টার বহিঃপ্রকাশ।
সাধারণ ঠাণ্ডা থেকে শুরু করে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, আর বর্তমানের কভিড-১৯ পর্যন্ত সবই বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণ।
ভাইরাস জ্বর
ভাইরাস জ্বরে তাপমাত্রা সাধারণত ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। অনেক ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ নিম্নমাত্রার জ্বর। কিছু ভাইরাস সংক্রমণ যেমন ডেঙ্গুতে উচ্চমাত্রার জ্বর হতে পারে।
এ ছাড়া ভাইরাস জ্বরে শীত শীত ভাব, ঘাম, মাথা ব্যথা, গা ও পেশি ব্যথা, দুর্বলতা বোধ, ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি সাধারণ লক্ষণ থাকে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাস জ্বরের নির্দিষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। জ্বর ও আনুষঙ্গিক লক্ষণগুলো কমাতে জ্বর ও ব্যথা কমানোর ওষুধ যেমন এসিটামিনোফেন বা প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেন গ্রহণ করা,
যতটা সম্ভব বিশ্রাম নেওয়া এবং ঘামের কারণে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন রোধে প্রচুর পরিমাণ পানি ও তরল পান করলেই হয়।
সাধারণ ঠাণ্ডা, মৌসুমি ফ্লু ও কভিড-১৯
জ্বরের সঙ্গে সর্দি, হাঁচি, কাশি বা গলা ব্যথা থাকলে সেটি সাধারণ ঠাণ্ডা, মৌসুমি ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা কি না তা সব সময় নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কারণ এসব রোগের সব লক্ষণ প্রায় একই রকম। তবু পার্থক্যগুলো বুঝতে চেষ্টা করলে চিকিৎসা সহজ হয়।
সাধারণ ঠাণ্ডা, ফ্লু এবং বর্তমানের কভিড-১৯ এসব ভাইরাস সংক্রমণ শ্বাসযন্ত্রকে আক্রান্ত করে। সাধারণ ঠাণ্ডা ও ফ্লু দুটিই ভিন্ন ভিন্ন ভাইরাস সংক্রমণের কারণে হলেও উভয় অসুস্থতায়ই সর্দি ও নাক বন্ধ হতে পারে। পাশাপাশি জ্বরও থাকতে পারে, যা তিন-চার দিন স্থায়ী হয়। তবে সাধারণ ঠাণ্ডা বা সাধারণ সর্দি-কাশিতে জ্বর তুলনামূলক কম থাকে।
মৌসুমি ফ্লু
মৌসুমি ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের একপ্রকার তীব্র শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণ। চার ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (এ, বি, সি, ডি)-এর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা এ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা বি ভাইরাস দুটিই মৌসুমি মহামারি রোগের কারণ।
ইনফ্লুয়েঞ্জায় সাধারণত জ্বর, কাশি (সাধারণত শুকনো), মাথা ব্যথা, পেশি ও অস্থিগ্রন্থিতে ব্যথা, অসুস্থতাবোধ, গলা ব্যথা ও সর্দির উপসর্গ থাকে। তবে কাশি গুরুতর হতে পারে এবং দুই বা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে পারে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসার তেমন প্রয়োজন হয় না এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যায়। তবে কখনো কখনো বিশেষত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ফ্লু একটি মৌসুমি ও অস্থায়ী সংক্রমণ। সিডিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি মৌসুমে মার্কিন জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ ফ্লুতে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কভিড-১৯ ও ডেঙ্গু
সার্স কোভ ২ বা কভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কারণে সবাই বর্তমানে আতঙ্কিত। দেশে এখন ডেঙ্গুরও প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ সময় তাই দুটি রোগ একসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ভয়ানক চাপের মধ্যে ফেলছে। কভিড-১৯ ও ডেঙ্গু প্রাথমিক লক্ষণ বিবেচনায় একই রোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষত লক্ষণের সূত্রপাত থেকে প্রথম দুই দিনের মধ্যে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, অগুরুতর ডেঙ্গু হালকা থেকে মাঝারি কভিড-১৯-এর চেয়ে বেশি লক্ষণযুক্ত। ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা এবং চোখের পেছনে ব্যথা ডেঙ্গুর অন্যতম প্রধান লক্ষণ।
বিপরীতে পজিটিভ কেসের সংস্পর্শে আসার প্রমাণসহ স্বাদ বা গন্ধ না পাওয়া, দেরিতে উপসর্গের প্রকাশ হওয়া অর্থাৎ তিন দিনের পর উপসর্গের সূচনা ও শ্বাসকষ্ট হলো করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য।
পরীক্ষা
ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ডেঙ্গু থেকে কভিড-১৯-কে পৃথক করতে ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য এবং সাধারণ পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়নের জন্য রক্তের সম্পূর্ণ গণনা পরীক্ষা (সিবিসি) করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং অন্যান্য সংক্রামক অসুস্থতার পার্থক্য জানাটা সঠিক চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তবে কভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন প্রথমেই করোনা টেস্ট করে নিশ্চিত হতে হবে। আর যেহেতু ডেঙ্গুরও প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, তাই তীব্র জ্বরের অসুস্থতার জন্য ডেঙ্গুকেও ভাবনায় আনতে হবে।
জটিলতা
ডেঙ্গু ও কভিড-১৯ আক্রান্ত বেশির ভাগের হালকা অসুস্থতা থাকে এবং তাঁরা বাড়িতে চিকিৎসা নিতে পারেন। লক্ষণগুলো সাধারণত কয়েক দিন স্থায়ী হয় এবং এক সপ্তাহ পর রোগী আরো ভালো বোধ করে। তবে অনেকে এই দুই রোগে আবার মারাত্মক অসুস্থতার দিকে চলে যেতে পারে, ফলে মৃত্যুও হতে পারে।
গুরুতর রোগ বা জটিলতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা হলেন : গর্ভবতী নারী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক, দীর্ঘস্থায়ী রোগী (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ, কিডনি, লিভার রোগ) এবং ইমিউনোসাপ্রেসিভ অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত (যেমন এইচআইভি/এইডস, কেমোথেরাপি বা স্টেরয়েড গ্রহণ, ক্যান্সার)।
যেকোনো বয়সের যেকোনো ব্যক্তি ডেঙ্গু বা কভিড-১৯-এ গুরুতর অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারে। উভয় সংক্রমণ ছাড়াও মৌসুমি ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জায়ও এসব রোগীর জটিলতার আশঙ্কা বেশি থাকে।
ডেঙ্গুর গুরুতর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অবিরাম বমি বমি ভাব, শ্লেষ্মাজনিত রক্তপাত, শ্বাস নিতে অসুবিধা, অলসতা/অস্থিরতা, পাকস্থলীর অম্লতা, লিভার বৃদ্ধি এবং রক্তচাপ কমে যাওয়া, শক ইত্যাদি।
অন্যদিকে কভিড-১৯-এর গুরুতর লক্ষণগুলোর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, অবিরাম বুকে ব্যথা বা চাপ, নতুন বিভ্রান্তি, জাগতে বা জেগে থাকতে অক্ষমতা, ঠোঁট বা মুখ নীল হয়ে যাওয়া অন্যতম।
মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার ফলাফল আসার আগেই ডেঙ্গু ও কভিড উভয়ই জটিল হতে পারে। তাই প্রারম্ভিক চিকিৎসা ক্লিনিক্যাল ধারণার ওপর নির্ভর করেই শুরু করা উচিত।
যখন চিকিৎসক দেখাতে হবে
বেশির ভাগ ভাইরাস জ্বর নিজ থেকেই এক বা দুই দিনের মধ্যেই সেরে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাস জ্বরে চিন্তার তেমন কিছু থাকে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক হয় এবং চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। জ্বর ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
জ্বর যদি ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) বা তার বেশি না থাকে; কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ধরে কিংবা তিন দিনের বেশি তাপমাত্রা থাকে তবু একজন চিকিৎসককে দেখানো বা পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রতিরোধে করণীয়
কভিড-১৯-এর মতো ফ্লু বা অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাস ও বাতাসের মাধ্যমে। মার্কেট, ডে-কেয়ার সেন্টার, স্কুল- কলেজ, মাদরাসাসহ বিয়ের অনুষ্ঠানসহ যেকোনো জনসমাগমপূর্ণ স্থানে শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস ছড়ায় বেশি। কেবল করোনা বা ফ্লু নয়, অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের ভাইরাসও এসবের মধ্যে থাকে।
অন্যদিকে ডেঙ্গু ভাইরাস মশার কামড়ের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এখানে শত্রু দৃশ্যমান, তাই মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা এবং মশা নিধন করতে হবে।
আর ভয়াবহ করোনাকে আমাদের দুইভাবে প্রতিরোধ করতে হবে :
টিকা নেওয়া : রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা। নিরাপদ ও কার্যকর কভিড-১৯-এর টিকা বা ভ্যাকসিনগুলো এখন দেওয়া হচ্ছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে রক্ষা করার জন্য বার্ষিক টিকারও পরামর্শ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সবার উচিত এসব টিকা গ্রহণ করা।
স্বাস্থ্যবিধি মানা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত কিছু সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। যেমন দৈনিক ৬ থেকে ১২ বার ২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব (ন্যূনতম ৬ ফুট) বজায় রাখা, লোকসমাগম এড়িয়ে চলা এবং অহেতুক ঘরের বাইরে না যাওয়া ইত্যাদি।
অনেকে এগুলোকে সামাজিক প্রতিষেধক বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ছোট করে বলা যায় ‘SMS’ (Social Distance, Musk, Sanitation) অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক ও হাত ধোয়া।
এ ছাড়া কিছু সামাজিক শিষ্টাচার যেমন করমর্দন বা হ্যান্ডশেক না করা, কোলাকুলি বা আলিঙ্গন ও গালে গাল লাগিয়ে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন অথবা কাউকে স্বাগত জানানোর অভ্যাস সম্পূর্ণ ত্যাগ করা উচিত। এসব অভ্যাস নিজেকে এবং অন্যকেও করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরিহার্য।