ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাবেক বিমানবাহিনী প্রধানের বই নিয়ে থলের বিড়াল বের হলো

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বিশ্ববিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কেনান ডয়াল বলেছেন, ‘অপরাধী যত চতুর ও কুশলী হোক, তার কৃত অপরাধের একটা প্রমাণ তার অজান্তে সে রেখে যাবেই। আজ হোক কাল হোক, সে ধরা পড়বেই।’ এই কথাটার সত্যতা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও প্রমাণিত হলো অত্যন্ত আকস্মিকভাবে। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ নেতা এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার ২০১৪ সালে একটি বই লেখেন- ‘১৯৭১ :ভেতরে বাইরে’। বের করেছে প্রথমা প্রকাশন।

তার মতো স্বনামখ্যাত ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বই লিখবেন এবং তা দেশে-বিদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে না, তা তো হয় না। এই বইও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তবে তা অন্য কারণে। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু বিতর্কমূলক বক্তব্য রাখার পর তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছেন।’ দেশের অধিকাংশ মানুষ সন্দেহাতীতভাবে জানে, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেননি। কিন্তু ‘৭১-এর পরাজিত শক্তি এবং তাদের মিত্র বিএনপি বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের জন্য তিনি ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন বলে মিথ্যা  প্রচার চালায়।

এই প্রচারণার কাজে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধেয় এবং বিশ্বাসভাজন কিছু বুদ্ধিজীবীকেও তারা ব্যবহার করে। ব্যবহূতদের মধ্যে প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলীও একজন। তিনি ছিলেন আমার কাছে শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের মতো; তথাপি আমি তার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। কারণ ৭ মার্চের ভাষণের দিন আমি রমনার মাঠে হাজির ছিলাম। শেলী ভাই আমার প্রতিবাদটি পাঠ করে বিব্রত হন এবং আমাকে জানান, তিনি কানকথা শুনে কথাটি লিখেছেন এবং তিনি তার খুবই কাছের একজন সম্পাদকের কথা বিশ্বাস করেছিলেন।

আমি বিস্মিত হয়ে ভেবেছি, পত্রিকাটি বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ সমর্থক নয়। পত্রিকার সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা এবং বামপন্থি ছিলেন। তিনি এবং তার সহযোগীরা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতির বিরোধী হতে পারেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুসারী এবং পরেও বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। তারা কী করে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হরণ এবং ইতিহাস-বিকৃতির চক্রান্তে যোগ দিতে পারেন? পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি, এই বামপন্থি ড. জাকিলদের মধ্যে মি. হাইডদের আবির্ভাব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তারা এখন বিএনপি-জামায়াতের অঘোষিত মিত্র। হয়তো নিরপেক্ষতার আবরণে ফিফ্‌থ কলাম।

তবে তাদের বড় সাফল্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের এক শীর্ষ সেনানী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম প্রধান এবং ‘৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকায় পরাজিত পাকিস্তানি সেনা ও সেনাপতিরা মিত্রপক্ষের যে অধিনায়কদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, তাদের একজন এ কে খন্দকারকে এমনভাবে বিভ্রান্ত করা এবং তাদের অসত্য প্রচারণার কাজে লাগানো।

কিন্তু এই সাফল্য শেষ পর্যন্ত টিকল না। আমি আগেই আর্থার কেনান ডয়ালের বক্তব্যের উদ্ৃব্দতি দিয়ে লিখেছি, কোনো অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যতই চতুর ও কুশলী হোক, নিজেদের অজান্তেই তারা তাদের অপরাধের কোনো না কোনো প্রমাণ রেখে যায়। ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইটিতে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার এবং তার সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যে অপরাধ করা হয়েছে, তার নেপথ্যের কারিগরদের নামধাম দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর জানা গেল এবং কৃত অপরাধের জন্য বইটির লেখক, যাকে ব্যবহার করা হয়েছে, তিনি বঙ্গবন্ধু ও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি সাংবাদিক সভা ডেকে সব গুমর ফাঁক  করে দিয়েছেন।

আমার সহৃদয় পাঠকদের কারও স্মরণে আছে কি-না জানি না, ২০১৪ সালে এ কে খন্দকারের বইটি যখন প্রথম প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোয়, তখনই আমি আমার একটি কলামে তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম। আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ শেষে জয় পাকিস্তান বলেছেন- এ কথা এ কে খন্দকারের মতো মুক্তিযুদ্ধের একজন সামনের কাতারের সেনানী লিখতে পারেন না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারিগরের কারসাজি আছে।

এই কারসাজিটি প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলীকে দিয়েও করানো হয়েছিল। তাকে দিয়ে বলা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেছিলেন। বিচারপতিকে দিয়ে আরও মারাত্মক কথা বলানো হয়েছিল। যে মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে, কয়েক লাখ নারী সল্ফ্ভ্রম হারিয়েছে, প্রয়াত বিচারপতিকে দিয়ে সেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলানো হলো, ‘এটা ছিল পাকিস্তানের সৈন্যদের লাঠিবাজি।’ বিচারপতি শেলীর সরলতার সুযোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ও মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার জন্য কীভাবে তাকে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং কারা করেছিলেন, তিনি বেঁচে থাকতে তার মুখেই তা জানতে পেরেছি।

এ কে খন্দকারের বইটি ঢাকায় বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে আমার এক বন্ধুর সৌজন্যে হাতে পাই এবং পড়ে ফেলি। বিস্মিত হই, তিনিও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো একই ধরনের ভুল করেছেন। তিনিও লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে জয় পাকিস্তান বলেছেন। এবং এর চাইতেও মারাত্মক ও অসত্য মন্তব্য করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা তিনি মনে করেন না।’

‘সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়, এটা সত্য নয়’ বলা হলে যেমন মহামূর্খতার পরিচয় দেওয়া হয়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পেছনে ৭ মার্চের ভাষণের কোনো ভূমিকা নেই, এটা বলা তেমনি মহামূর্খতা। এই মন্তব্যটি এ কে খন্দকারের, তা আমার বিশ্বাস হয়নি। আমার মনে হয়েছে, বিচারপতি শেলীকে নিয়ে যারা খেলেছিলেন, এই খেলাটিও তাদের। দশচক্রে ভগবান ভূত হয়েছেন।

এয়ার ভাইস মার্শালকে আমি মুজিবনগর থেকে চিনি। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তিনি শুধু একজন সাহসী সৈন্য নন, সরল মানুষও। ‘৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার সৈন্যেরা রমনার রেসকোর্সের মাঠে আত্মসমর্পণ করে। তখন সেখানে ভারতীয় বাহিনীপ্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের অধিনায়কেরও উপস্থিত থাকার কথা। জেনারেল ওসমানী উপস্থিত থাকতে পারেননি। তখন উপসেনাপতি হিসেবে এ কে খন্দকার রমনার মাঠে এসে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করার জন্য একটি নেপথ্য চক্রান্ত হয়েছিল। সে কাহিনী বিস্তারিত জানেন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর ক্যাপ্টেন রহমান। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। তার কাছেই আমি এ কে খন্দকারের তৎকালীন ভূমিকার  কথা জেনেছি।

এ কে খন্দকারের বয়স হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে খুবই সহজ ও সরল মানুষ। সমাজে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত কিছু মানুষকে তিনি বন্ধু ভাবেন এবং বিশ্বাসও করেন। তার বইটি লেখার ব্যাপারে তারা সাহায্য করেছেন। সে কথা তিনি সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন এবং নামও বলেছেন। কিন্তু তাদের নাম জানার আগে অর্থাৎ সাড়ে চার বছর পূর্বে তার বইটি পড়ার পড়েই মনে হয়েছে, যারা এক বিচারপতিকে ইতিপূর্বে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করেছেন, সেই একই গ্রুপ রয়েছেন এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকারকে বিভ্রান্ত করা ও তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কাজে। আমার সেই অনুমান এখন সঠিক প্রমাণিত হলো।

এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) খন্দকার সাংবাদিকদের তার বইয়ের ভুল তথ্য এবং তা সংশোধন না করার ব্যাপারে দায়ী কয়েক ব্যক্তির নাম করেছেন। আগেই এই নামগুলো আমার সন্দেহের তালিকায় ছিল। আরও সন্দেহ ছিল, বয়সাধিক্যে খন্দকার নিজ হাতে বইয়ের সবটা লিখতে পারেননি। কিছু ঘোস্ট রাইটার ছিল। এই ঘোস্ট রাইটার কে বা কারা এবং কারা তাদের মনোনীত করেছিলেন, তা জানা দরকার।

এ কে খন্দকার অভিযোগ করেছেন, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত অসত্য মন্তব্যগুলো সংশোধনের জন্য তিনি বইটির প্রকাশককে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি আরেকজনের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে কাজটা করেননি। খন্দকার মারাত্মক অভিযোগ করেছেন, তিনি যাতে বইয়ের ভুল তথ্য সংশোধন করতে না পারেন, সে জন্য তাকে কয়েকদিন রীতিমতো পাহারা দিয়ে রেখেছিলেন। এই পাহারাদার কারা ছিল, তাদের নামও প্রকাশ হলে এই বই সম্পর্কিত আসল রহস্য জানা যাবে। যে বইটি প্রথমা প্রকাশন সাড়ে চার বছর ধরে সংশোধিত হতে দেয়নি অথবা বইটিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য আছে তা জেনেও প্রত্যাহার করেনি, এখন থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতেই সঙ্গে সঙ্গে তা বাজার থেকে প্রত্যাহার করেছে। অপরাধ ঢাকার এই তাড়াহুড়া থেকেই অপরাধীর আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ছে।

‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ‘ভেতরে বাইরে’ বইটিতে মন্তব্য রয়েছে, ‘৭ মার্চের ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা প্রাক্তন ভাইস মার্শাল মনে করেন না।’ এই মন্তব্যটি পাঠ করেই আমার সন্দেহ হয়েছে, এটি লেখকের নিজের মন্তব্য নয়। এটা সাজিয়ে-গুছিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করে বইটিতে ঢোকানো হয়েছে। এই মন্তব্যের  উৎস মইদুল হাসানের লেখা একাত্তরের  মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা। ‘মূলধারা ‘৭১’ নামেই সমধিক পরিচিত।

এই বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ তথ্য ও বিবরণ আছে। কিন্তু একপাত্র দুধে এক ফোঁটা ময়লা ঢোকালে যা হয়, এই বইটিতেও তেমনি মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা খাটো ও গৌণ করার প্রবণতা লক্ষণীয়। অনেকটা বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলনের বইয়ের মতো। দু’জনেই অসামান্য পণ্ডিত। কিন্তু মুজিব-ফোবিয়ায় আক্রান্ত।

মইদুল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সাংবাদিকতাতেও সহকর্মী। আগে প্রায়ই লন্ডনে আসতেন। এলেই কোনো পাবে বা রেস্টুরেন্টে মিলিত হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতাম। তখনও দেখতাম, দেশ সম্পর্কে কথা উঠলেই বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে তার কণ্ঠে অবজ্ঞার ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠত। আমি প্রতিবাদ করতাম না। কারণ আমি জানি, আমার দুই বন্ধু মইদুল ও উমরের মন থেকে মুজিব-ফোবিয়া দূর করতে পারব না। এটা তাদের প্যাথোলজিক্যাল অবসেশন।

এ কে খন্দকার ভদ্র মানুষ, ভালো মানুষ। বই লিখতে গিয়ে তিনি একাধিকজনের পাল্লায় পড়েছিলেন, আমার এই সন্দেহটি সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় সুখী এবং দুঃখিত দুই-ই হয়েছি। সুখী হয়েছি একজন ভালো মানুষের ভাবমূর্তি কালিমামুক্ত হতে চলেছে। আর দুঃখিত হয়েছি এই ভেবে যে, এসব বুদ্ধিজীবী দেশকে সত্যের আলো দেখাবার বদলে এখনও বিভ্রান্তির কুয়াশায় ঢেকে রাখতে চাইছেন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

সাবেক বিমানবাহিনী প্রধানের বই নিয়ে থলের বিড়াল বের হলো

আপডেট টাইম : ০৭:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ জুন ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বিশ্ববিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কেনান ডয়াল বলেছেন, ‘অপরাধী যত চতুর ও কুশলী হোক, তার কৃত অপরাধের একটা প্রমাণ তার অজান্তে সে রেখে যাবেই। আজ হোক কাল হোক, সে ধরা পড়বেই।’ এই কথাটার সত্যতা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও প্রমাণিত হলো অত্যন্ত আকস্মিকভাবে। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ নেতা এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার ২০১৪ সালে একটি বই লেখেন- ‘১৯৭১ :ভেতরে বাইরে’। বের করেছে প্রথমা প্রকাশন।

তার মতো স্বনামখ্যাত ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বই লিখবেন এবং তা দেশে-বিদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে না, তা তো হয় না। এই বইও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তবে তা অন্য কারণে। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু বিতর্কমূলক বক্তব্য রাখার পর তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছেন।’ দেশের অধিকাংশ মানুষ সন্দেহাতীতভাবে জানে, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেননি। কিন্তু ‘৭১-এর পরাজিত শক্তি এবং তাদের মিত্র বিএনপি বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের জন্য তিনি ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন বলে মিথ্যা  প্রচার চালায়।

এই প্রচারণার কাজে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধেয় এবং বিশ্বাসভাজন কিছু বুদ্ধিজীবীকেও তারা ব্যবহার করে। ব্যবহূতদের মধ্যে প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলীও একজন। তিনি ছিলেন আমার কাছে শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের মতো; তথাপি আমি তার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। কারণ ৭ মার্চের ভাষণের দিন আমি রমনার মাঠে হাজির ছিলাম। শেলী ভাই আমার প্রতিবাদটি পাঠ করে বিব্রত হন এবং আমাকে জানান, তিনি কানকথা শুনে কথাটি লিখেছেন এবং তিনি তার খুবই কাছের একজন সম্পাদকের কথা বিশ্বাস করেছিলেন।

আমি বিস্মিত হয়ে ভেবেছি, পত্রিকাটি বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ সমর্থক নয়। পত্রিকার সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা এবং বামপন্থি ছিলেন। তিনি এবং তার সহযোগীরা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতির বিরোধী হতে পারেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুসারী এবং পরেও বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। তারা কী করে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হরণ এবং ইতিহাস-বিকৃতির চক্রান্তে যোগ দিতে পারেন? পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি, এই বামপন্থি ড. জাকিলদের মধ্যে মি. হাইডদের আবির্ভাব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তারা এখন বিএনপি-জামায়াতের অঘোষিত মিত্র। হয়তো নিরপেক্ষতার আবরণে ফিফ্‌থ কলাম।

তবে তাদের বড় সাফল্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের এক শীর্ষ সেনানী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম প্রধান এবং ‘৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকায় পরাজিত পাকিস্তানি সেনা ও সেনাপতিরা মিত্রপক্ষের যে অধিনায়কদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, তাদের একজন এ কে খন্দকারকে এমনভাবে বিভ্রান্ত করা এবং তাদের অসত্য প্রচারণার কাজে লাগানো।

কিন্তু এই সাফল্য শেষ পর্যন্ত টিকল না। আমি আগেই আর্থার কেনান ডয়ালের বক্তব্যের উদ্ৃব্দতি দিয়ে লিখেছি, কোনো অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যতই চতুর ও কুশলী হোক, নিজেদের অজান্তেই তারা তাদের অপরাধের কোনো না কোনো প্রমাণ রেখে যায়। ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইটিতে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার এবং তার সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যে অপরাধ করা হয়েছে, তার নেপথ্যের কারিগরদের নামধাম দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর জানা গেল এবং কৃত অপরাধের জন্য বইটির লেখক, যাকে ব্যবহার করা হয়েছে, তিনি বঙ্গবন্ধু ও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি সাংবাদিক সভা ডেকে সব গুমর ফাঁক  করে দিয়েছেন।

আমার সহৃদয় পাঠকদের কারও স্মরণে আছে কি-না জানি না, ২০১৪ সালে এ কে খন্দকারের বইটি যখন প্রথম প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোয়, তখনই আমি আমার একটি কলামে তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম। আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ শেষে জয় পাকিস্তান বলেছেন- এ কথা এ কে খন্দকারের মতো মুক্তিযুদ্ধের একজন সামনের কাতারের সেনানী লিখতে পারেন না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারিগরের কারসাজি আছে।

এই কারসাজিটি প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলীকে দিয়েও করানো হয়েছিল। তাকে দিয়ে বলা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেছিলেন। বিচারপতিকে দিয়ে আরও মারাত্মক কথা বলানো হয়েছিল। যে মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে, কয়েক লাখ নারী সল্ফ্ভ্রম হারিয়েছে, প্রয়াত বিচারপতিকে দিয়ে সেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলানো হলো, ‘এটা ছিল পাকিস্তানের সৈন্যদের লাঠিবাজি।’ বিচারপতি শেলীর সরলতার সুযোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ও মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার জন্য কীভাবে তাকে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং কারা করেছিলেন, তিনি বেঁচে থাকতে তার মুখেই তা জানতে পেরেছি।

এ কে খন্দকারের বইটি ঢাকায় বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে আমার এক বন্ধুর সৌজন্যে হাতে পাই এবং পড়ে ফেলি। বিস্মিত হই, তিনিও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো একই ধরনের ভুল করেছেন। তিনিও লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে জয় পাকিস্তান বলেছেন। এবং এর চাইতেও মারাত্মক ও অসত্য মন্তব্য করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা তিনি মনে করেন না।’

‘সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়, এটা সত্য নয়’ বলা হলে যেমন মহামূর্খতার পরিচয় দেওয়া হয়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পেছনে ৭ মার্চের ভাষণের কোনো ভূমিকা নেই, এটা বলা তেমনি মহামূর্খতা। এই মন্তব্যটি এ কে খন্দকারের, তা আমার বিশ্বাস হয়নি। আমার মনে হয়েছে, বিচারপতি শেলীকে নিয়ে যারা খেলেছিলেন, এই খেলাটিও তাদের। দশচক্রে ভগবান ভূত হয়েছেন।

এয়ার ভাইস মার্শালকে আমি মুজিবনগর থেকে চিনি। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তিনি শুধু একজন সাহসী সৈন্য নন, সরল মানুষও। ‘৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার সৈন্যেরা রমনার রেসকোর্সের মাঠে আত্মসমর্পণ করে। তখন সেখানে ভারতীয় বাহিনীপ্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের অধিনায়কেরও উপস্থিত থাকার কথা। জেনারেল ওসমানী উপস্থিত থাকতে পারেননি। তখন উপসেনাপতি হিসেবে এ কে খন্দকার রমনার মাঠে এসে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করার জন্য একটি নেপথ্য চক্রান্ত হয়েছিল। সে কাহিনী বিস্তারিত জানেন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর ক্যাপ্টেন রহমান। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। তার কাছেই আমি এ কে খন্দকারের তৎকালীন ভূমিকার  কথা জেনেছি।

এ কে খন্দকারের বয়স হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে খুবই সহজ ও সরল মানুষ। সমাজে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত কিছু মানুষকে তিনি বন্ধু ভাবেন এবং বিশ্বাসও করেন। তার বইটি লেখার ব্যাপারে তারা সাহায্য করেছেন। সে কথা তিনি সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন এবং নামও বলেছেন। কিন্তু তাদের নাম জানার আগে অর্থাৎ সাড়ে চার বছর পূর্বে তার বইটি পড়ার পড়েই মনে হয়েছে, যারা এক বিচারপতিকে ইতিপূর্বে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করেছেন, সেই একই গ্রুপ রয়েছেন এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকারকে বিভ্রান্ত করা ও তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কাজে। আমার সেই অনুমান এখন সঠিক প্রমাণিত হলো।

এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) খন্দকার সাংবাদিকদের তার বইয়ের ভুল তথ্য এবং তা সংশোধন না করার ব্যাপারে দায়ী কয়েক ব্যক্তির নাম করেছেন। আগেই এই নামগুলো আমার সন্দেহের তালিকায় ছিল। আরও সন্দেহ ছিল, বয়সাধিক্যে খন্দকার নিজ হাতে বইয়ের সবটা লিখতে পারেননি। কিছু ঘোস্ট রাইটার ছিল। এই ঘোস্ট রাইটার কে বা কারা এবং কারা তাদের মনোনীত করেছিলেন, তা জানা দরকার।

এ কে খন্দকার অভিযোগ করেছেন, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত অসত্য মন্তব্যগুলো সংশোধনের জন্য তিনি বইটির প্রকাশককে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি আরেকজনের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে কাজটা করেননি। খন্দকার মারাত্মক অভিযোগ করেছেন, তিনি যাতে বইয়ের ভুল তথ্য সংশোধন করতে না পারেন, সে জন্য তাকে কয়েকদিন রীতিমতো পাহারা দিয়ে রেখেছিলেন। এই পাহারাদার কারা ছিল, তাদের নামও প্রকাশ হলে এই বই সম্পর্কিত আসল রহস্য জানা যাবে। যে বইটি প্রথমা প্রকাশন সাড়ে চার বছর ধরে সংশোধিত হতে দেয়নি অথবা বইটিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য আছে তা জেনেও প্রত্যাহার করেনি, এখন থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতেই সঙ্গে সঙ্গে তা বাজার থেকে প্রত্যাহার করেছে। অপরাধ ঢাকার এই তাড়াহুড়া থেকেই অপরাধীর আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ছে।

‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ‘ভেতরে বাইরে’ বইটিতে মন্তব্য রয়েছে, ‘৭ মার্চের ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা প্রাক্তন ভাইস মার্শাল মনে করেন না।’ এই মন্তব্যটি পাঠ করেই আমার সন্দেহ হয়েছে, এটি লেখকের নিজের মন্তব্য নয়। এটা সাজিয়ে-গুছিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করে বইটিতে ঢোকানো হয়েছে। এই মন্তব্যের  উৎস মইদুল হাসানের লেখা একাত্তরের  মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা। ‘মূলধারা ‘৭১’ নামেই সমধিক পরিচিত।

এই বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ তথ্য ও বিবরণ আছে। কিন্তু একপাত্র দুধে এক ফোঁটা ময়লা ঢোকালে যা হয়, এই বইটিতেও তেমনি মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা খাটো ও গৌণ করার প্রবণতা লক্ষণীয়। অনেকটা বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলনের বইয়ের মতো। দু’জনেই অসামান্য পণ্ডিত। কিন্তু মুজিব-ফোবিয়ায় আক্রান্ত।

মইদুল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সাংবাদিকতাতেও সহকর্মী। আগে প্রায়ই লন্ডনে আসতেন। এলেই কোনো পাবে বা রেস্টুরেন্টে মিলিত হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতাম। তখনও দেখতাম, দেশ সম্পর্কে কথা উঠলেই বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে তার কণ্ঠে অবজ্ঞার ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠত। আমি প্রতিবাদ করতাম না। কারণ আমি জানি, আমার দুই বন্ধু মইদুল ও উমরের মন থেকে মুজিব-ফোবিয়া দূর করতে পারব না। এটা তাদের প্যাথোলজিক্যাল অবসেশন।

এ কে খন্দকার ভদ্র মানুষ, ভালো মানুষ। বই লিখতে গিয়ে তিনি একাধিকজনের পাল্লায় পড়েছিলেন, আমার এই সন্দেহটি সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় সুখী এবং দুঃখিত দুই-ই হয়েছি। সুখী হয়েছি একজন ভালো মানুষের ভাবমূর্তি কালিমামুক্ত হতে চলেছে। আর দুঃখিত হয়েছি এই ভেবে যে, এসব বুদ্ধিজীবী দেশকে সত্যের আলো দেখাবার বদলে এখনও বিভ্রান্তির কুয়াশায় ঢেকে রাখতে চাইছেন।