ঢাকা , শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোরগঞ্জের কীর্তিমান কর্মযোগী ডা. আবু আহম্মদ ফজলুল করিম

ডা. আবু আহম্মদ ফজলুল করিম একজন আধুনিক ও অগ্রসর চেতনার মানুষ ছিলেন। যেমন সফল চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তেমনি একজন সৎ রাজনীতিবিদের মডেল ছিলেন। এই কৃতী ব্যক্তিত্বের জন্ম হয় ১৯২৮ সালে কিশোরগঞ্জ সদর থানাধীন চৌদ্দশত ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামে। তাঁর পূর্বপুরুষ মজলিসুল করিম ছিলেন বীর ঈসা খাঁর ঢালী শ্রেণীর সৈনিকদের প্রধান।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তিনি ভাগ্যান্বেষণে সুদূর ইয়েমেন থেকে এ দেশে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে অবসর গ্রহণের পর ঈসা খাঁর তরফ থেকে বাৎসরিক ১৪০০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বর্তমান চৌদ্দশত মৌজার তালুকদারি লাভ করেছিলেন। সেই থেকেই এলাকার নাম হয়েছে ‘চৌদ্দশত’।

ডা. ফজলুল করিম একজন সফল চিকিৎসক, আদর্শ সমাজকর্মী, অগ্রসর চিন্তার রাজনীতিক ও কৃতী ক্রীড়াবিদ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। তাঁর পিতার নাম ইব্রাহীম ভূঞা ও মাতার নাম রওশন আরা বিনু।

ডা. করিম ছেলেবেলাতেই তাঁর বাবা ও মাকে  হারান। চাচা আবদুল আহাদ ভুঁইয়ার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষে তিনি কোদালিয়া এস.আই. হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৪৫ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক, ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

ছাত্রজীবনেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি কারাবরণ করেছেন।

১৯৭৫ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ভাসানী) যোগদান করেন ও ১৯৭৬ সালে এর কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব নেন। এ সময় তিনি ন্যাপ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য পদ লাভ করেন।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠিত হলে ভাসানী ন্যাপ বিলুপ্ত করে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা শাখা জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ন্যাপ-এর সভাপতি ও বিএনপির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে দলকে পরিচালনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

জনসম্পৃক্ততা ও সাংগঠনিক কর্মতৎপরতার কারণে তাঁকে বিএনপি সদর আসনে নির্বাচনের জন্য (১৯৭৯) মনোনীত করে। ওই সাধারণ নির্বাচনে তিনি বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে কিশোরগঞ্জ সদর আসনে জয়লাভ করেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য করেন এবং তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। পরে তাঁকে ১৯৮০ সালে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় ও ১৯৮২ সালে আবার তাঁকে পূর্বের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দেয়া হয়।

পরবর্তীকালে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হলে তাঁকে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী করা হয়। মন্ত্রণালয় পরিচালনাকালে তাঁর সততা ও নিষ্ঠার কথা আজো অনেকেই স্মরণ করেন।

পেশাগত জীবন শুরুর সময় তাঁকে হয়রানির শিকার হতে হয়। ডাক্তারি পাস করে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাস করা সত্ত্বেও তাঁকে চাকরিতে যোগদান করতে দেয়া হয়নি তাঁর বিরুদ্ধে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।

এ কারণে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেডিকেল অফিসার হিসেবে তাঁকে যোগ দিতে হয়। পরে তিনি চিটাগাং স্কিন হাসপাতালে ১৯৬২ সালে পর্যন্ত চাকরি করেন। এ দুই স্থানেই তিনি যথেষ্ট সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনীতির কারণে তাঁর ভাগ্যে সরকারি চাকরি জোটেনি। অবশেষে তিনি নিজ শহর কিশোরগঞ্জে চলে আসেন এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। এখানে তিনি একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক হিসেবে নাম ও যশ করেন। গরিব ও অসহায় রোগীদের তিনি ছিলেন সহায়ক চিকিৎসক।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সাধারণ মানুষের প্রতি সেবার মনোভাব তাঁর স্বভাবজাত ছিল। বর্তমান সময় রাজনীতি যখন অনেকাংশে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত, সে সময় ডা. করিম নিজেকে জনগণের কল্যাণ ও দেশের উন্নয়নে নিবেদন করেছিলেন। অর্থের পেছনে অন্ধের মতো ছুটে যাননি।

একজন প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহজ ও সাধারণের মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া গ্রামের পৈতৃক বাড়ি, শহরের ক্ষুদ্র চেম্বার ও মাত্র কয়েক হাজার টাকাই এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

ডা. ফজলুল করিম একজন পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। অর্থের মোহ তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। পেশাদারিত্বের পাশাপাশি সেবার ব্রত নিয়ে সবসময় চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।

এছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির কিশোরগঞ্জের ডেলিগেট এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে দুই বার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

১৯৭৯-৮৭ সালে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সমিতির কেন্দ্রীয় ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ১৯৭৯-৮২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কিশোরগঞ্জ সরকারি মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন।

তিনি ১৯৮০ সালে থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তাঁর সময় নিয়াজ মোর্শেদ দাবায় গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব লাভ করেন। তিনি নিজেও একজন ভালো ফুটবলার, লন টেনিস খেলোয়াড় ও কৃতী দাবারু ছিলেন। অহংবোধহীন, সুন্দরমনা ও সৎ ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন সকলের নিকট পরিচিত।

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে স্থানীয় আজিমউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে যে ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল সেখানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেনা সদস্যদের মেডিকেল টিমের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি মুক্তিবাহিনীকে নানাভাবে তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করেন এবং বহু ঝুঁকির মধ্যেও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ সরবরাহ করেন। নয় মাস যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর কিশোরগঞ্জ শহরে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ প্রবেশে যে কজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন।

ডা. ফজলুল করিম ছিলেন কিশোরগঞ্জের একজন কৃতী সন্তান। তাঁর কর্মময় জীবন, নিষ্ঠা ও সততা সকলের জন্য আদর্শ ও অনুপ্রেরণাদায়ক। এই মহৎপ্রাণ কৃতী ব্যক্তিত্ব ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল সকলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

কিশোরগঞ্জের কীর্তিমান কর্মযোগী ডা. আবু আহম্মদ ফজলুল করিম

আপডেট টাইম : ০৩:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ অক্টোবর ২০২০

ডা. আবু আহম্মদ ফজলুল করিম একজন আধুনিক ও অগ্রসর চেতনার মানুষ ছিলেন। যেমন সফল চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তেমনি একজন সৎ রাজনীতিবিদের মডেল ছিলেন। এই কৃতী ব্যক্তিত্বের জন্ম হয় ১৯২৮ সালে কিশোরগঞ্জ সদর থানাধীন চৌদ্দশত ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামে। তাঁর পূর্বপুরুষ মজলিসুল করিম ছিলেন বীর ঈসা খাঁর ঢালী শ্রেণীর সৈনিকদের প্রধান।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তিনি ভাগ্যান্বেষণে সুদূর ইয়েমেন থেকে এ দেশে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে অবসর গ্রহণের পর ঈসা খাঁর তরফ থেকে বাৎসরিক ১৪০০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বর্তমান চৌদ্দশত মৌজার তালুকদারি লাভ করেছিলেন। সেই থেকেই এলাকার নাম হয়েছে ‘চৌদ্দশত’।

ডা. ফজলুল করিম একজন সফল চিকিৎসক, আদর্শ সমাজকর্মী, অগ্রসর চিন্তার রাজনীতিক ও কৃতী ক্রীড়াবিদ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। তাঁর পিতার নাম ইব্রাহীম ভূঞা ও মাতার নাম রওশন আরা বিনু।

ডা. করিম ছেলেবেলাতেই তাঁর বাবা ও মাকে  হারান। চাচা আবদুল আহাদ ভুঁইয়ার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষে তিনি কোদালিয়া এস.আই. হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৪৫ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক, ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

ছাত্রজীবনেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি কারাবরণ করেছেন।

১৯৭৫ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ভাসানী) যোগদান করেন ও ১৯৭৬ সালে এর কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব নেন। এ সময় তিনি ন্যাপ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য পদ লাভ করেন।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠিত হলে ভাসানী ন্যাপ বিলুপ্ত করে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা শাখা জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ন্যাপ-এর সভাপতি ও বিএনপির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে দলকে পরিচালনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

জনসম্পৃক্ততা ও সাংগঠনিক কর্মতৎপরতার কারণে তাঁকে বিএনপি সদর আসনে নির্বাচনের জন্য (১৯৭৯) মনোনীত করে। ওই সাধারণ নির্বাচনে তিনি বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে কিশোরগঞ্জ সদর আসনে জয়লাভ করেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য করেন এবং তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। পরে তাঁকে ১৯৮০ সালে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় ও ১৯৮২ সালে আবার তাঁকে পূর্বের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দেয়া হয়।

পরবর্তীকালে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হলে তাঁকে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী করা হয়। মন্ত্রণালয় পরিচালনাকালে তাঁর সততা ও নিষ্ঠার কথা আজো অনেকেই স্মরণ করেন।

পেশাগত জীবন শুরুর সময় তাঁকে হয়রানির শিকার হতে হয়। ডাক্তারি পাস করে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাস করা সত্ত্বেও তাঁকে চাকরিতে যোগদান করতে দেয়া হয়নি তাঁর বিরুদ্ধে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।

এ কারণে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেডিকেল অফিসার হিসেবে তাঁকে যোগ দিতে হয়। পরে তিনি চিটাগাং স্কিন হাসপাতালে ১৯৬২ সালে পর্যন্ত চাকরি করেন। এ দুই স্থানেই তিনি যথেষ্ট সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনীতির কারণে তাঁর ভাগ্যে সরকারি চাকরি জোটেনি। অবশেষে তিনি নিজ শহর কিশোরগঞ্জে চলে আসেন এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। এখানে তিনি একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক হিসেবে নাম ও যশ করেন। গরিব ও অসহায় রোগীদের তিনি ছিলেন সহায়ক চিকিৎসক।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সাধারণ মানুষের প্রতি সেবার মনোভাব তাঁর স্বভাবজাত ছিল। বর্তমান সময় রাজনীতি যখন অনেকাংশে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত, সে সময় ডা. করিম নিজেকে জনগণের কল্যাণ ও দেশের উন্নয়নে নিবেদন করেছিলেন। অর্থের পেছনে অন্ধের মতো ছুটে যাননি।

একজন প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহজ ও সাধারণের মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া গ্রামের পৈতৃক বাড়ি, শহরের ক্ষুদ্র চেম্বার ও মাত্র কয়েক হাজার টাকাই এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

ডা. ফজলুল করিম একজন পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। অর্থের মোহ তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। পেশাদারিত্বের পাশাপাশি সেবার ব্রত নিয়ে সবসময় চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।

এছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির কিশোরগঞ্জের ডেলিগেট এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে দুই বার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

১৯৭৯-৮৭ সালে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সমিতির কেন্দ্রীয় ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ১৯৭৯-৮২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কিশোরগঞ্জ সরকারি মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন।

তিনি ১৯৮০ সালে থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তাঁর সময় নিয়াজ মোর্শেদ দাবায় গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব লাভ করেন। তিনি নিজেও একজন ভালো ফুটবলার, লন টেনিস খেলোয়াড় ও কৃতী দাবারু ছিলেন। অহংবোধহীন, সুন্দরমনা ও সৎ ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন সকলের নিকট পরিচিত।

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে স্থানীয় আজিমউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে যে ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল সেখানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেনা সদস্যদের মেডিকেল টিমের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি মুক্তিবাহিনীকে নানাভাবে তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করেন এবং বহু ঝুঁকির মধ্যেও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ সরবরাহ করেন। নয় মাস যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর কিশোরগঞ্জ শহরে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ প্রবেশে যে কজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন।

ডা. ফজলুল করিম ছিলেন কিশোরগঞ্জের একজন কৃতী সন্তান। তাঁর কর্মময় জীবন, নিষ্ঠা ও সততা সকলের জন্য আদর্শ ও অনুপ্রেরণাদায়ক। এই মহৎপ্রাণ কৃতী ব্যক্তিত্ব ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল সকলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।