ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরের কৃষি ও দুর্গত মানুষের পুনর্বাসন

বেশক’সপ্তাহ থেকে সবার উত্কণ্ঠা ও মনোযোগ বন্যাপ্লাবিত হাওর অঞ্চলের দিকে। এর কারণ, এবারের হাওর এলাকার প্রাক-বর্ষা বন্যা পূর্ববর্তী বছরগুলো থেকে ভয়াবহ। আর ক্ষতির মাত্রা আমাদের অনুমানকে ছাড়িয়ে গেছে। অপ্রত্যাশিত আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এ অঞ্চলের প্রধান ও অনেকটা একক ফসল ধান কাটবার সুযোগ পাননি কৃষকরা। ফলনের সিংহভাগই তলিয়ে গেছে পানিতে। পালিত পশুপাখি, ঘরবাড়ি ও নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সবকিছু হারিয়ে অনেকেই দিশেহারা আজ।

 

বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিভিন্ন সূত্রের পরিসংখ্যান মতে, দেশে হাওরের সংখ্যা প্রায় ৪২৩টি এবং আয়তন প্রায় ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। হাওর এলাকায় প্রাক-বর্ষা বন্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়। যতটুকু জানা যায়, ২০০৩ সালের পরে এটিই হাওর এলাকায় সবচে’ ভয়াবহ প্রাক-বর্ষা বন্যা। বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের সবকটি মডেল ব্যবহার করে দেখেছেন যে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি বন্যার সময়ও এগিয়ে আসবে। এ বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপকতার সাথে যোগ হয়েছে দুর্নীতি, অদক্ষ পানি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা— যার দায়িত্ব সরকারের বেশ ক’টি সংস্থার।

 

ধান চাষই হাওর অঞ্চলের মানুষের উপার্জনের প্রধান মাধ্যম। কয়েক বছর আগের একটি রিপোর্টে দেখেছি, হাওর অঞ্চলের সাতটি জেলায় প্রায় সোয়া ১২ লাখ হেক্টর জমি চাষের আওতায় রয়েছে। আর এর দুই-তৃতীয়াংশই পড়েছে হাওর এলাকায়। এ এলাকার ৮০ শতাংশেরও অধিক জমিতে চাষ করা হয় আধুনিক জাতের বোরো ধান। এক ফসলি জমি হবার কারণে কৃষকরা অধিক ফসল পাবার আশায় এই উন্নত জাতগুলোর ধান চাষ করেন এবং মে মাসের মধ্যেই ফসল ঘরে তোলেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের পাশাপাশি অবস্থাদৃষ্টে এখন প্রতীয়মান যে আগাম বন্যার কারণে আমাদের প্রয়োজন ধানের আরো উন্নত জাত যা চাষ করে আরো কম সময়ে ফসল তোলা সম্ভব। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু আগাম ও কম সময়ে ফলন পাওয়া যায় এমন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে কিন্তু সেগুলোর ফলন কিছুটা কম। আর এজন্যে হাওরের কৃষকরা এ জাতগুলো আবাদে আগ্রহী নয়।

 

হাওরের আবহাওয়া, বন্যার ধরন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে হাওরের উপযোগী আগাম ও কম সময়ে বেশি ফলন দেয় এমন ধানের জাত উদ্ভাবনে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছে যেসব আগাম ধানের জাত রয়েছে আপাতত সেগুলো চাষ করে অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে ফলন পাওয়া সম্ভব। হাওরের উপযোগী আগাম ও অল্প সময়ে বেশি ফলন দেয় এমন জাত বের করার মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত এসব জাত আগামী বছরগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাষ করা যেতে পারে।

 

কৃষকের কাছে বীজ সহজলভ্য করার জন্য কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দ্রুত এসব জাতের ধানের বীজ উত্পাদন করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এভাবে কৃষকদের ফসল হারাবার মতো অযাচিত বিভীষিকা থেকে বাঁচানো সম্ভব। কৃষকরা যাতে এবারের বন্যার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারেন সে জন্যে উদ্ভাবনী ও জুতসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা দরকার। যেমন— কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কৃষকদের এখনই দ্রুত ফলনশীল সবজি আবাদে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকায় সরিষা কিংবা ক্যানোলার সাথে মৌ-চাষ করে বাড়তি আয় করা সম্ভব— যা সহজেই কৃষকদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে দেবে। ফসল আবর্তন একটি ফলপ্রদ কার্যক্রম হতে পারে। নিয়ন্ত্রিত একোয়াকালচারের মাধ্যমে সহজেই কৃষকরা হাওরে মাছ চাষ করে লাভবান হতে পারেন। হাওরের জনজীবন স্বাভাবিক করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। এ জন্য দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষ বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সহজে মোকাবিলা করতে পারলেও বন্যা পূর্বাভাস ও নদী মনিটরিং-এর মতো প্রয়োজনীয় কাজগুলোতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো প্রায়শ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এজন্যে এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আন্তর্জাতিক মাপের করে গড়ে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক ও ট্রান্স-বর্ডার নদী প্রশাসনকে আক্ষরিক অর্থেই কার্যকর করতে হবে। প্রতিবেশী দেশের বন্যা ও নদী মনিটরিং নেটওয়ার্কের সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।

 

এবারের হাওরের প্রাক-বর্ষা বন্যায় গৃহপালিত প্রাণির সাথে অসংখ্য মাছ ও বন্যপ্রাণি মারা গেছে—  যা আমাদের জীব-বৈচিত্র্যের বেঁচে থাকার জন্য এক চরম হুমকি। এটা রোধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা আশা করি। সর্বোপরি হাওর অঞ্চলের বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে সরকারের সাথে সাথে বেসরকারি সংস্থা, বিত্তবান ব্যক্তি ও সমাজের সচেতন মানুষ এগিয়ে আসবেন এটা সবার কাম্য।

 

এবারের অকাল বন্যার জন্যে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতি ও কর্মে অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে। দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নেবার জন্য দুর্নীতিবাজদের যথাযথ শাস্তি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

হাওরের কৃষি ও দুর্গত মানুষের পুনর্বাসন

আপডেট টাইম : ০৫:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ মে ২০১৭
বেশক’সপ্তাহ থেকে সবার উত্কণ্ঠা ও মনোযোগ বন্যাপ্লাবিত হাওর অঞ্চলের দিকে। এর কারণ, এবারের হাওর এলাকার প্রাক-বর্ষা বন্যা পূর্ববর্তী বছরগুলো থেকে ভয়াবহ। আর ক্ষতির মাত্রা আমাদের অনুমানকে ছাড়িয়ে গেছে। অপ্রত্যাশিত আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এ অঞ্চলের প্রধান ও অনেকটা একক ফসল ধান কাটবার সুযোগ পাননি কৃষকরা। ফলনের সিংহভাগই তলিয়ে গেছে পানিতে। পালিত পশুপাখি, ঘরবাড়ি ও নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সবকিছু হারিয়ে অনেকেই দিশেহারা আজ।

 

বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিভিন্ন সূত্রের পরিসংখ্যান মতে, দেশে হাওরের সংখ্যা প্রায় ৪২৩টি এবং আয়তন প্রায় ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। হাওর এলাকায় প্রাক-বর্ষা বন্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়। যতটুকু জানা যায়, ২০০৩ সালের পরে এটিই হাওর এলাকায় সবচে’ ভয়াবহ প্রাক-বর্ষা বন্যা। বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের সবকটি মডেল ব্যবহার করে দেখেছেন যে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি বন্যার সময়ও এগিয়ে আসবে। এ বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপকতার সাথে যোগ হয়েছে দুর্নীতি, অদক্ষ পানি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা— যার দায়িত্ব সরকারের বেশ ক’টি সংস্থার।

 

ধান চাষই হাওর অঞ্চলের মানুষের উপার্জনের প্রধান মাধ্যম। কয়েক বছর আগের একটি রিপোর্টে দেখেছি, হাওর অঞ্চলের সাতটি জেলায় প্রায় সোয়া ১২ লাখ হেক্টর জমি চাষের আওতায় রয়েছে। আর এর দুই-তৃতীয়াংশই পড়েছে হাওর এলাকায়। এ এলাকার ৮০ শতাংশেরও অধিক জমিতে চাষ করা হয় আধুনিক জাতের বোরো ধান। এক ফসলি জমি হবার কারণে কৃষকরা অধিক ফসল পাবার আশায় এই উন্নত জাতগুলোর ধান চাষ করেন এবং মে মাসের মধ্যেই ফসল ঘরে তোলেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের পাশাপাশি অবস্থাদৃষ্টে এখন প্রতীয়মান যে আগাম বন্যার কারণে আমাদের প্রয়োজন ধানের আরো উন্নত জাত যা চাষ করে আরো কম সময়ে ফসল তোলা সম্ভব। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু আগাম ও কম সময়ে ফলন পাওয়া যায় এমন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে কিন্তু সেগুলোর ফলন কিছুটা কম। আর এজন্যে হাওরের কৃষকরা এ জাতগুলো আবাদে আগ্রহী নয়।

 

হাওরের আবহাওয়া, বন্যার ধরন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে হাওরের উপযোগী আগাম ও কম সময়ে বেশি ফলন দেয় এমন ধানের জাত উদ্ভাবনে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছে যেসব আগাম ধানের জাত রয়েছে আপাতত সেগুলো চাষ করে অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে ফলন পাওয়া সম্ভব। হাওরের উপযোগী আগাম ও অল্প সময়ে বেশি ফলন দেয় এমন জাত বের করার মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত এসব জাত আগামী বছরগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাষ করা যেতে পারে।

 

কৃষকের কাছে বীজ সহজলভ্য করার জন্য কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দ্রুত এসব জাতের ধানের বীজ উত্পাদন করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এভাবে কৃষকদের ফসল হারাবার মতো অযাচিত বিভীষিকা থেকে বাঁচানো সম্ভব। কৃষকরা যাতে এবারের বন্যার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারেন সে জন্যে উদ্ভাবনী ও জুতসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা দরকার। যেমন— কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কৃষকদের এখনই দ্রুত ফলনশীল সবজি আবাদে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকায় সরিষা কিংবা ক্যানোলার সাথে মৌ-চাষ করে বাড়তি আয় করা সম্ভব— যা সহজেই কৃষকদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে দেবে। ফসল আবর্তন একটি ফলপ্রদ কার্যক্রম হতে পারে। নিয়ন্ত্রিত একোয়াকালচারের মাধ্যমে সহজেই কৃষকরা হাওরে মাছ চাষ করে লাভবান হতে পারেন। হাওরের জনজীবন স্বাভাবিক করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। এ জন্য দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষ বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সহজে মোকাবিলা করতে পারলেও বন্যা পূর্বাভাস ও নদী মনিটরিং-এর মতো প্রয়োজনীয় কাজগুলোতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো প্রায়শ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এজন্যে এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আন্তর্জাতিক মাপের করে গড়ে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক ও ট্রান্স-বর্ডার নদী প্রশাসনকে আক্ষরিক অর্থেই কার্যকর করতে হবে। প্রতিবেশী দেশের বন্যা ও নদী মনিটরিং নেটওয়ার্কের সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।

 

এবারের হাওরের প্রাক-বর্ষা বন্যায় গৃহপালিত প্রাণির সাথে অসংখ্য মাছ ও বন্যপ্রাণি মারা গেছে—  যা আমাদের জীব-বৈচিত্র্যের বেঁচে থাকার জন্য এক চরম হুমকি। এটা রোধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা আশা করি। সর্বোপরি হাওর অঞ্চলের বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে সরকারের সাথে সাথে বেসরকারি সংস্থা, বিত্তবান ব্যক্তি ও সমাজের সচেতন মানুষ এগিয়ে আসবেন এটা সবার কাম্য।

 

এবারের অকাল বন্যার জন্যে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতি ও কর্মে অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে। দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নেবার জন্য দুর্নীতিবাজদের যথাযথ শাস্তি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।