কাল রাত থেকে অনেক কিছু লেখার চেষ্টা করছি, পারছি না – যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে তাতে কিছু লেখার চেষ্টা করা নিছক বোকামি বলা চলে। অনুভূতিহীন মানুষ হতে পারলে হয়তো ভালো হতো, সবকিছু দেখেও না দেখার মত করে আর দশ জনের মত নিজের পরিবার পরিজন কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থেকে হয়তো সবকিছু ভুলে থাকা যেতো। কিন্তু পারছি না! এ কী পড়লাম! হ্যাঁ পড়লাম কারণ পুরোটা দেখার মত সাহস আমার হয়নি, হবেও না। শুধু এটুকু শুনেছি একজন মানুষ-একজন নারী-একজন স্ত্রী কিছু পশুকে ‘বাবা’ ডেকেও পারেনি নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে, রেহাই পায়নি পিশাচদের নারকীয় অত্যাচার থেকে।
ঘটনাটি ঘটেছে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার একলাশপুর এলাকায়, সেটিও আজ থেকে ৩২ দিন আগে। একজন নারীর সঙ্গে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বরতা চালাচ্ছে মানুষ নামক কিছু পশু, জানি না এভাবে বলাও সমীচীন নাকি কারণ আজকাল কিছু মানুষের কর্মকাণ্ড পশুকেও হার মানাচ্ছে। সেক্ষেত্রে পশুর সঙ্গে এদের তুলনা করে হয়তো পশুকেও ছোট করা হয়। এতদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি হঠাৎ সামনে আসার কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই নৃশংস ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনায় যাবো না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে হয়তো অনেকেই দেখেছেন ইতোমধ্যেই। প্রশ্ন হচ্ছে যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ‘ভাইরাল’ না হতো তাহলে কি কেউ জানতে পারতো? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টনক নড়তো? আমরা ধীরে ধীরে যে ‘ভাইরাল সংস্কৃতি’তে প্রবেশ করছি তাতে কিছুদিন পর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত কি কোন বিষয়ে বিচার পাওয়া যাবে?
যে মানুষটির সঙ্গে ঘটনাটি ঘটেছিলো তার আর্তচিৎকার কি পাড়া-প্রতিবেশী কারো কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি? কেউ কি এগিয়ে এসেছিলো? তাদের ই বা দোষ দেই কি করে, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর বিপক্ষে এসে বেঘোরে নিজের প্রাণটা কেই বা হারাতে চায়। শুধুমাত্র অস্ত্রধারী হলেও কথা ছিলো, ফেসবুকে দেখতে পেলাম এই পিশাচদের প্রধান দেলোয়ার স্থানীয় সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ, তার সঙ্গে ফুল হাতে ছবিও ভেসে বেড়াচ্ছে। রাজনীতিবিদদের অনেকের সঙ্গেই ছবি তুলতে হয়, মানুষের মন যুগিয়ে চলতে কিন্তু দায়ভার কি কেউ এড়াতে পারে?
করোনা মহামারীর শুরুতে ভেবেছিলাম এবার হয়তো মানুষ বুঝতে পারবে জীবন কতটা ক্ষুদ্র, তুচ্ছ। আজ আছি কাল নেই এই বোধ থেকে হয়তো মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ব আরো প্রগাড় হবে, মানুষ বুঝতে পারবে এই পৃথিবীর অল্প সময়ে হিংসা-বিদ্বেষ এর চেয়ে ভালোবাসা অনেক বেশি অর্থপূর্ন। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম হলো ঠিক উলটো। দিনের পর দিন ধর্ষণ বেড়েই চলছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে কেবল মাত্র এপ্রিল থেকে আগস্টহ মাসের মধ্যেই ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে ৬৩২ টি, যার অর্থ প্রতিদিন গড়ে ধর্ষিত হচ্ছে ৪ জন নারী। এদের মধ্যে অনেককে ধর্ষনের পর মেরে ফেলা হচ্ছে, কেউ কেউ শারীরিক-মানসিক অত্যাচার সইতে না পেরে নিজে আত্মহত্যা করছে, কেউ সীমাহীন যন্ত্রনায় দিন কাটাচ্ছে। এই মহামারীর মধ্যেও ধর্ষনের সংখ্যা এতোটা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়া আমাদের কি কোন বার্তা দিচ্ছে না? কেবলমাত্র সামাজিক- পারিবারিক-ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবেই এমন ঘটনা ঘটছে নাকি আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ নেই নাকি এই মহামারী তে অনেকেই মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে?
করোনার মত ধর্ষণ মহামারি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ার আগেই প্রয়োজন আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হোক। আইনের মারপ্যাঁচ গলে কোনো ধর্ষক যেনো বের না হতে পারে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি দেয়া হোক। একজন ধর্ষক যত বড় ক্ষমতাবানই হোক না কেনো দ্রুত বিচার আইনের মাধ্যমে তার দৃষ্টান্তমূলক সাজা প্রদানের মাধ্যমে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হোক যে ধর্ষকের কোনো প্রশ্রয় নেই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা সকল বিষয়ে কথা বললেও ধর্ষণের মত একটি সামাজিকব্যাধি নিয়েখুব বেশি কিছু বলেন না। ধর্ষণের বিরুদ্ধে দল মত নির্বিশেষে তীব্র সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এই বাংলাদেশ ধর্ষকদের না, হতে পারে না।
লেখক: প্রকৌশলী ও সমাজকর্মী