বাংলাদেশে চা শিল্পের বিকাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ১৯৫৭-১৯৫৮ সময়ে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ছিলেন চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান। বঙ্গবন্ধু চা শ্রমিকদের কল্যাণে অত্যন্ত মনোযোগী ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার প্রদান করেছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন চা চাষাবাদ, কারখানা উন্নয়ন, অবকাঠামো এবং শ্রমকল্যাণের ক্ষেত্রে চা শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সময়োপযোগী কার্যকর উদ্যোগের ফলে চা’এর উৎপাদন এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে এ দেশের চা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। তাঁর অভিজ্ঞতা, দুরদর্শীতা ও দেশাত্ববোধের কারণে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত চা শিল্প পুনরায় নব-উদ্যমে যাত্রা শুরু করতে পেরেছিল।
বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বাধীনতাত্তোর চা শিল্পের সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য চা বাগানগুলোর পুনর্বাসন, নতুন চা এলাকা সম্প্রসারণ, চা কারখানা আধুনিকীকরণ, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ জোরদারকরণের লক্ষ্যে কয়েকটি সম্ভাব্য সমীক্ষা পরিচালনা করে। এ সময়ে চা শিল্পের পুনর্বাসন ও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কারিগরী সহায়তা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথ সচিবালয়কে অনুরোধ জানান। চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২-৭৪ সন পর্যন্ত চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। চা কারখানাগুলো পুনর্বাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ৩০ লাখ ভারতীয় মুদ্রা মূল্যের ঋণ নিয়ে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। বঙ্গবন্ধু চা বাগান মালিকদেরকে ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি প্রদান করেন।
চা বোর্ডের নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার ঢাকার ১১১-১১৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ০.৩৭১২ একর জমি বরাদ্দ দেয়। বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন এ ভবনের নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত হয়। ১৯৫৯ সালে অফিস ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চা বোর্ড চায়ের আবাদ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম আরো বেগবান করতে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান টি লাইসেন্সিং কমিটি বিলুপ্তির জন্য পাকিস্তান টি অ্যাক্ট ১৯৫০ এর ৭ নং ধারায় সংশোধন আনেন এবং কমিটির কার্যক্রম চা বোর্ডে ন্যস্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
১৯৫৭ সালে চা বোর্ডের অধীন পাকিস্তান টি রিসার্চ স্টেশন (বর্তমানে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট) শ্রীমঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি হস্তক্ষেপ ও তৎপরতায় এ প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হয়। চা শিল্পের উন্নয়নে নবগঠিত টি রিসার্চ স্টেশন সম্প্রসারণ, গবেষণা কার্যক্রম ত্বারান্বিত করা, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয়, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের জন্য আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বঙ্গবন্ধুই তৎকালীন চা গবেষণা কেন্দ্রে একজন বাঙালি গবেষক যেন এ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান হতে পারেন, সে লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. কে. এ. হাসানকে চা গবেষণা কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তিনিই উর্দুভাষী পাকিস্তানী পরিচালক ড. এফ. এইচ. আব্বাসীর স্থলাভিষিক্ত হন।
বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন চায়ের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৭-৫৮ এবং ১৯৫৮-৫৯ সালের বাৎসরিক রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৫৭-৫৮ অর্থবছরে চায়ের একর প্রতি উৎপাদন ছিল ৬২১ পাউন্ড। ১৯৫৮-৫৯ অর্থবছরে একর প্রতি উৎপাদন ১২৪ পাউন্ড বৃদ্ধি পেয়ে ৭৪৫ পাউন্ডে দাঁড়ায়। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি চায়ের রপ্তানিও এ সময় বৃদ্ধি পায়। এ অঞ্চলের চা যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানী, বাহরাইন সহ বেশ কিছু দেশে রপ্তানি হতে থাকে। তৎকালীন চা বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৫৭-৫৮ অর্থবছরে চা রপ্তানি করে আয় হয় ১৬ মিলিয়ন টাকা। ১৯৫৮-৫৯ অর্থবছরে ১১৭৩৬৮১২ পাউন্ড চা রপ্তানি করে আয় হয় ৩০ মিলিয়ন টাকা।
বঙ্গবন্ধুর সময় চা বাগানের উন্নয়ন ও উন্নত জাতের চা উদ্ভাবনে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। চায়ের উচ্চতর ফলন নিশ্চিতকরণ, সর্বোচ্চ গুণগতমান অর্জন ও রোগবালাই দমনে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। আর এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলি এবং সিলেটের ভাড়াউড়া চা বাগানে ‘রেসিস্টেন্ট ক্লোন’ জাতের চারা লাগানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথমে ক্লোন এবং পরবর্তীতে ক্লোন থেকে ক্লোনাল সীডবাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। উল্লেখ্য ভারতের টোকলাইতে ১৯৪৯ সালে ক্লোন উদ্ভাবন করা হলেও বঙ্গবন্ধুর আগে পাকিস্তানে এ উদ্যোগটি কেউ গ্রহণ করেননি।
বঙ্গবন্ধু টি অ্যাক্ট এ সংশোধনীর মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরী প্রভিডেন্ট ফান্ড (CPF) চালু করেছিলেন-যা এখনও চালু রয়েছে। এছাড়া তার প্রচেষ্টায় বোর্ডে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রাচুয়েটি প্রদানসহ অন্যান্য সুবিধা চালু হয়।