চলতি বছর বেসরকারি পর্যায়ে হজ কার্যক্রম পরিচালনায় ৯৪২টি হজ এজেন্সিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জাতীয় হজ ও ওমরা আইন অনুযায়ী, প্রতিটি এজেন্সির হজযাত্রীর সংখ্যা হবে ১০০ থেকে ৩০০ জন। কিন্তু সৌদি সরকার এবার সেই আইন মানছে না। তারা প্রতিটি এজেন্সির হজযাত্রীর কোটা নির্ধারণ করেছে ১ হাজার জন।
বাংলাদেশি হজ এজেন্সিগুলো ১ হাজার জনের কোটা পূরণ করতে না পারায় মাত্র ৭০ হজ এজেন্সি দিয়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজ কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থাৎ হিসাব বলছে, চলতি বছর মাত্র ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ এজেন্সি হজ কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবে। অবশিষ্ট ৯২ দশমিক ৫৬ শতাংশ হজ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে না। তারা হজযাত্রীগুলো অন্য এজেন্সির কাছে হস্তান্তর করবে।
বিষয়টি নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ হজ এজেন্সির মালিকরা। তারা বলেছেন, চলতি বছর বেসরকারি হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। এ বিশৃঙ্খলা রোধে জরুরি ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। বিভিন্ন এজেন্সি মালিক ও হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বাংলাদেশি হজ এজেন্সিগুলোর ১ হাজার হজযাত্রী না হওয়ায় একাধিক এজেন্সি মালিককে সতর্ক করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। গত ১৫ জানুয়ারি কোটা পূরণ করতে না পরায় ৪টি হজ এজেন্সিকে চিঠি দেওয়া হয়। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মামুন আল ফারুক স্বাক্ষরিত চিঠিতে কোটা পূরণ করে লিড এজেন্সি নির্ধারণে ব্যর্থতায় হজ ব্যবস্থাপনায় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
হজ এজেন্সি মালিকরা জানান, হজযাত্রীর চূড়ান্ত নিবন্ধন করার শেষ সময়ে সৌদি সরকার বাংলাদেশি এজেন্সির কোটা ১ হাজার নির্ধারণ করে দেয়। বিষয়টি জানার পর প্রতিবাদ করেন এজেন্সি মালিকরা। তারা হজের কোটা ২৫০ জনে বহাল রাখতে গত ৩ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম আফতাব উদ্দিন প্রামাণিক, হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদ, সাবেক মহাসচিব ফরিদ আহমেদ মজুমদার, সাবেক মহাসচিব গোলাম সারোয়ার বক্তর্য রাখেন। বৈঠকে তারা হজযাত্রীর কোটা ৫০০ জনের বেশি না করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। তাদের দাবি না মানা হলে চলতি বছর হজ কার্যক্রম পরিচালনা থেকে বিরত থাকবেন এমন হুমকিও দেন। ধর্ম উপদেষ্টা বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে সৌদি সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করে সমাধানের আশ^াস দেন। কিন্তু সৌদি সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরেনি। ফলে বিষয়টি নিয়ে হজ এজেন্সি মালিকরা ক্ষুব্ধ। একইসঙ্গে চলতি বছর হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছেন তারা।
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সাবেক একজন মহাসচিব দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৯৪২টি এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ১০ থেকে ২০টি হজ এজেন্সির ১ হাজার হজযাত্রী মিলিয়ে একটি লিড এজেন্সি নির্ধারণ করতে হয়েছে। লিড এজেন্সি এসব হজযাত্রী নিতে চায়নি। কারণ এতগুলো এজেন্সির যাত্রী একটি এজেন্সির পক্ষে মেনটেইন করা খুবই কঠিন। আবার কোনো একটি এজেন্সি যদি লিড এজেন্সির কাছে টাকা ঠিকমতো পরিশোধ না করে, সংশ্লিষ্ট এজেন্সির সঙ্গে হজযাত্রীর যে চুক্তি হয়েছে লিড এজেন্সি সেই চুক্তিমতো কাজ না করে। এসব বিষয় নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তাই সরকারের কাছে এজেন্সি মালিকদের দাবি, এটি নিয়ে যেন দ্রুত সময়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। নীতিমালায় সব অন্তর্ভুক্ত করা না হলে বিশৃঙ্খলা ঠেকানো যাবে না।
হাবের সাবেক একজন প্রেসিডেন্ট দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, আমাদের জাতীয় হজ ও ওমরা নীতি অনুযায়ী প্রতিটি এজেন্সির কোটা ছিল ৫০ জন। সেটি পরে বাড়িয়ে ১০০ থেকে ৩০০ জন করা হয়েছে। হজ এজেন্সিগুলো এই নিয়ম মেনেই কাজ করছিল। কিন্তু গেল বছর সৌদি সরকার হজের কোটা ২৫০ জন নির্ধারণ করে। এজেন্সিগুলো সেটি মেনে নিয়ে কাজ করেছে। হঠাৎ করে সৌদি সরকার এবার হজযাত্রীর সংখ্যা ১ হাজার নির্ধারণ করে দেয়। একটি হজ এজেন্সির পক্ষে ১ হাজার হজযাত্রী জোগাড় করা কঠিন। ফলে অনেকগুলো এজেন্সির হজযাত্রী মিলিয়ে ১ হাজার নির্ধারণ করে একটি লিড এজেন্সি বানিয়ে হজের কাজ করতে হয়। সব এজেন্সির সেবার মান এক নয়, আবার একটি এজেন্সি তার হজযাত্রী অন্য এজেন্সিতে হস্তান্তর করতেও আগ্রহী নয়। ফলে হজ কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে বিশৃঙ্খলা হবে। বাংলাদেশি হজযাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হবেন।
তিনি আরও বলেন, এজেন্সি মালিকরা বারবার হজযাত্রীর কোটা কমিয়ে ২৫০ জনে বহাল রাখার দাবি জানিয়ে আসছে সরকারের কাছে। কিন্তু সরকার বিষয়টি নিয়ে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আমাদের দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে কোটা পাওয়ার কথা ১ লাখ ৮০ হাজার। সেখানে বর্তমানে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন কোটা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু এবার বেসরকারি পর্যায়ে হজ পালনের জন্য নিবন্ধন করেছেন ৮১ হাজার ৯০০ জন। যা নির্ধারিত কোটা থেকে অনেক কম। বেসরকারি হজ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৭০টি লিড এজেন্সি নির্ধারণ করা হয়েছে। বাকি ৮৭২টি হজ এজেন্সি হজ কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারছে না। আমাদের যে পরিমাণ এজেন্সি রয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ এজেন্সি সরাসরি হজ কার্যক্রমে জড়িত থাকছে না। এসব মালিকদের মনে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
হজ এজেন্সি মালিকরা জানান, চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১ জুন পবিত্র হজ পালিত হওয়ার কথা রয়েছে। গত ১৩ জানুয়ারি সৌদি সরকারের সঙ্গে হজ চুক্তি সম্পন্ন হয়। চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছর ৮৭ হাজার ১০০ জন বাংলাদেশি হজ পালনের সুযোগ পাবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনার ৫ হাজার ২০০ জন ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনার ৮১ হাজার ৯০০ জন হজযাত্রী রয়েছেন। এসব এজেন্সির হজযাত্রীর মাত্র ৭০টি লিড এজেন্সি হজ কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এর আগের বছর ২০২৪ সালে হজ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১ হাজার ৫৩৩টি হজ এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে ২৫৯টি হজ এজেন্সি হজ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে।
হজযাত্রী ভোগান্তির নাম রুট টু মক্কা : হজ এজেন্সি মালিকরা বলেছেন, হজ পালনে বাংলাদেশ থেকে যারা সৌদি আরব যান তাদের ইমিগ্রেশন ঢাকার আশকোনা হজক্যাম্পে হয়ে থাকে। এখান থেকেই হজযাত্রীদের লাগেজ ফ্লাইটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হজযাত্রীরা যখন সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তখন তাদের কাছে লাগেজ দেওয়া হয় না। হজযাত্রী যে বাসে করে মক্কার হোটেলে যান, সে বাসে লাগেজগুলো পাঠানো হয় না। লাগেজগুলো অন্য বাসে করে একটি হোটেলে নিয়ে রাখা হয়। একটি এজেন্সির সব হজযাত্রীকে রাখতে একাধিক হোটেলের প্রয়োজন হয়। ফলে হজযাত্রী হোটেলে উঠে লাগেজ পান না। অপরিচিত জায়গা হওয়ায় যে হোটেলে লাগেজ রাখা হয় সেটিও তারা চেনেন না। লাগেজ না পেয়ে হজযাত্রীরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। লাগেজ পেতে তারা চরম ভোগান্তির শিকার হন। হজযাত্রীদের এই ভোগান্তি থেকে রক্ষা করতে রুট টু মক্কা বাতিল করতে হবে। হজযাত্রীদের লাগেজ জেদ্দা বিমানবন্দরে বুঝিয়ে দিতে হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. তওফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অপর এক চিঠিতে বলা হয়, প্রতি হজ এজেন্সির হজ গাইড ও অতিরিক্ত বরাদ্দকৃত কোটার হজযাত্রীর প্রাক-নিবন্ধন সম্পন্ন করে আগামী ২০ জানুয়ারি মধ্যে লিড এজেন্সির ব্যাংক হিসাবে ৩ লাখ টাকা করে অবশ্যই জমা দিতে হবে। এই টাকা থেকে সৌদি অংশের খরচের টাকা প্রেরণ করা হবে এবং অবশিষ্ট টাকা ফ্লাইটের টিকিটের জন্য লিড এজেন্সির ব্যাংক হিসাবে জমা থাকবে।