বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মোমিনদের পারস্পরিক বন্ধুত্বের দাবি হলো, তারা একে অপরের অন্যায় সমর্থন করেন না, বরং একে অপরকে ন্যায়কর্মে নির্দেশ দেন এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করেন। এখানে আরও লক্ষণীয়, এসব আয়াতে ঈমান, সালাত, জাকাত ইত্যাদির আগে সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে আমরা মোমিনের জীবনে এর সবিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি
সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ, প্রচার, নসিহত, ওয়াজ বা এককথায় আল্লাহর দ্বীন পালনের পথে আহ্বান করাই ছিল সব নবী ও রাসুলের (আলাইহিমুস সালাম) দায়িত্ব। সব নবীই তার উম্মতকে তাওহিদ ও ইবাদতের আদেশ করেছেন এবং শিরক, কুফর ও পাপকাজ থেকে নিষেধ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মি নবীর, যার উল্লেখ তারা তাদের কাছে রক্ষিত তাওরাত ও ইনজিলে লিপিবদ্ধ পায়, যিনি তাদের সৎকাজের নির্দেশ দেন এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করেন।’ (সূরা আরাফ : ১৫৭)।
এ আয়াতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কর্মকে আদেশ ও নিষেধ নামে অভিহিত করা হয়েছে। অন্যত্র এই কর্মকে দাওয়াত বা আহ্বান নামে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন না, অথচ রাসুল তোমাদের আহ্বান করছেন যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আন।’ (সূরা হাদিদ : ৮)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর এ দায়িত্বকে দাওয়াত বা আহ্বান বলে অভিহিত করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান করুন হিকমত বা প্রজ্ঞা ও সুন্দর ওয়াজ-উপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে উৎকৃষ্টতর পদ্ধতিতে আলোচনা-বিতর্ক করুন।’ (সূরা নাহল : ১২৫)।
অন্যত্র এ দায়িত্বকেই তাবলিগ বা প্রচার বলে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে রাসুল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা আপনি প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না।’ (সূরা মায়েদা : ৬৭)।
কোরআনুল কারিমে বারবার বলা হয়েছে, প্রচার বা পৌঁছানোই রাসুলদের একমাত্র দায়িত্ব। নিচের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘রাসুলদের দায়িত্ব তো শুধু সুস্পষ্টভাবে প্রচার করা।’ (সূরা নাহল : ৩৫)। নুহ (আ.) এর জবানিতে বলা হয়েছে, ‘আমি আমার প্রতিপালকের রিসালাতের দায়িত্ব তোমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের নসিহত করছি।’ (সূরা আরাফ : ৬২)।
সূরা আরাফের ৬৮, ৭৯, ৯৩ নম্বর আয়াত, সূরা হুদের ৩৪ নম্বর আয়াত ও অন্যান্য স্থানে দাওয়াতকে নসিহত বলে অভিহিত করা হয়েছে। সূরা শূরার ১৩ আয়াতে বলেছেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নুহকে আর যা আমি ওহি করেছি আপনাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহিম, মুসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করো এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না। আপনি মুশরিকদের যার প্রতি আহ্বান করছেন তা তাদের কাছে দুর্বহ মনে হয়।’ (সূরা শূরা : ১৩)।
তাবারি, ইবনু কাসির ও অন্যান্য মুফাসসির, সাহাবি-তাবিয়ি মুফাসসিররা উদ্ধৃত করেছেন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো দ্বীন পালন করা। আর দ্বীন পরিপূর্ণ পালনের মধ্যেই রয়েছে আদেশ, নিষেধ ও দাওয়াত। এ অর্থে কোনো কোনো গবেষক দ্বীন পালন বা নিজের জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যদের জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার দাওয়াতকেও ইকামতে দ্বীন বলে গণ্য করেছেন।
উম্মতে মুহাম্মদির দায়িত্ব
অন্য নবীদের একেকজনের মৃত্যুর পর প্রয়োজনের সময় আল্লাহ আরেকজন নবী পাঠিয়েছেন, কিন্তু শেষ নবী (সা.) এর নবী আসার অবকাশ না থাকায় দাওয়াত, আদেশ-নিষেধ, দ্বীন প্রতিষ্ঠা বা নসিহতের এ দায়িত্বই উম্মতে মুহাম্মদির ওপর বর্তেছে। এটিই তাদের অন্যতম দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ন্যায়কার্যে আদেশ এবং অন্যায় কার্যে নিষেধ করো এবং আল্লাহতে বিশ্বাস করো।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)।
প্রকৃত মোমিনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর তারা কল্যাণকর কাজে দ্রুত ধাবিত হয় এবং তারা নেককারদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১৪)।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘আর মোমিন পুরুষ ও মোমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে। এদের আল্লাহ শিগগিরই দয়া করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তওবা : ৭১)।
সূরা তওবার ১১২ আয়াতে, সূরা হজের ৪১ আয়াতে, সূরা লোকমানের ১৭ আয়াতে ও অন্যান্য স্থানেও উল্লেখ করা হয়েছে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ আল্লাহর প্রকৃত মোমিন বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এভাবে আমরা দেখছি, ঈমান, সালাত, সওম ইত্যাদি ইবাদতের মতো সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎকাজের নিষেধ মোমিনের অন্যতম কর্ম। শুধু তাই নয়, মোমিনদের পারস্পরিক বন্ধুত্বের দাবি হলো, তারা একে অপরের অন্যায় সমর্থন করেন না, বরং একে অপরকে ন্যায়কর্মে নির্দেশ দেন এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করেন। এখানে আরও লক্ষণীয়, এসব আয়াতে ঈমান, সালাত, জাকাত ইত্যাদির আগে সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে আমরা মোমিনের জীবনে এর সবিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি।
এই দায়িত্ব পালনকারী মোমিনকেই সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ওই ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি তো মুসলিমদের একজন।’ (সূরা ফুসসিলাত : ৩৩)।
আমরা দেখেছি যে, আদেশ, নিষেধ বা দাওয়াতের আরেক নাম নসিহত। নসিহত বর্তমানে সাধারণভাবে উপদেশ অর্থে ব্যবহৃত হলেও মূল আরবিতে নসিহত অর্থ আন্তরিকতা ও কল্যাণ কামনা। কারও প্রতি আন্তরিকতা ও কল্যাণ কামনার বহিঃপ্রকাশ হলো তাকে ভালো কাজের পরামর্শ দেওয়া এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করা। এ কাজটি মোমিনদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি অন্যতম দায়িত্ব। বরং এই কাজটির নামই দ্বীন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দ্বীন হলো নসিহত। সাহাবিরা বললেন, কার জন্য? বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসুল (সা.) জন্য, মুসলিমদের নেতৃবর্গের জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য।’ (মুসলিম)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এ নসিহতের জন্য সাহাবিদের বায়াত তথা প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতেন। বিভিন্ন হাদিসে জারির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) মুগিরা ইবনু শুবা (রা.) প্রমুখ সাহাবি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কাছে বায়াত বা প্রতিজ্ঞা করেছি, সালাত কায়েম, জাকাত প্রদান ও প্রত্যেক মুসলমানের নসিহত (কল্যাণ কামনা) করার ওপর।’ (বোখারি)। এ অর্থে তিনি সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধের বায়াত গ্রহণ করতেন। উবাদাহ ইবনু সামিত ও অন্যান্য সাহাবি (রা.) বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) হাতে বায়াত করি আনুগত্যের… এবং সৎকর্মে আদেশ ও অসৎকর্মে নিষেধের এবং এ কথার ওপর যে, আমরা মহিমাময় আল্লাহর জন্য কথা বলব এবং সে বিষয়ে কোনো নিন্দুকের নিন্দা বা গালিগালাজের তোয়াক্কা করব না।’ (আহমাদ), বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য সনদ)।