বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ হজরত সুলতান মসজিদ।
মসজিদটি রাজধানী আস্তানায় অবস্থিত। এটি কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় এবং মধ্য এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ কমিউনিজম ছিল আদর্শের ভিত্তি। মানুষের মাঝে এই আদর্শিক চেতনা সাময়িকভাবে স্পন্দন সৃষ্টি করতে পেরেছিল বলেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু আয়তনে নয়, সমরশক্তির দিক দিয়েও বিশ্বের সেরা দুটি শক্তির অন্যতম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কল্পনা দিয়ে যত শক্তিশালী আদর্শিক ভিত্তি দাঁড় করানো হোক না কেন, সত্যিকার অর্থে তা যে ঠুনকো কিছু তা প্রমাণিত হয় খান খান হয়ে যাওয়া কমিউনিজমের পতনের মধ্য দিয়ে।
লেনিনের বিশাল মূর্তি ক্রেন দিয়ে নামানোর সময় একদিকে যেমন ভ্রান্ত একটি মতবাদের কবর রচিত হতে থাকে, ঠিক সেই মুহূর্তে নীরবে প্রভুর দাসত্বকারী একটি দল বেরিয়ে আসতে থাকেন দীর্ঘ জুলুম, নির্যাতন, নিষ্পেষণের বন্ধ দুয়ার থেকে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সাময়িক দাপটে স্বাধীনতা হারানো বেশ কিছু প্রজাতন্ত্র এ সময় বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। ককেসাস অঞ্চলের চেচেন ইঙ্গুশেতিয়া, তাতারিস্তান স্বাধীনতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে এখনও সফল না হলেও তা থেমে যায়নি। তবে মধ্য এশিয়ার যেসব দেশ স্বাধীনতা লাভ করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান।
সম্প্রতি অনলাইনে একটি ছবি দেখে ঈমানি চেতনা ও আশায় বুক ভরে উঠল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কাজাখস্তানের আবহাওয়া যখন মাইনাস ৩ ডিগ্রি এবং অনবরত ভারি তুষারপাত হচ্ছে, তখনও মুসলমানরা খোলা আকাশের নিচে (মসজিদ মুসল্লিতে পূর্ণ হয়ে যাওয়ায়) সালাতুল জুমা আদায় করছেন। ছবিটি সত্যিই একজন মোমিনকে মুগ্ধ করবে এবং হৃদয়ে ঈমানি চেতনা জাগাবে।
কে বিশ্বাস করবে যে, এই কাজাখস্তানে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৬০ বছর কমিউনিস্টদের শাসন চলার কারণে একটি মসজিদও পাওয়া যেত না! এমনকি কোরআন সংগ্রহে রাখাও ফাঁসিযোগ্য অপরাধ ছিল! সেই কাজাখস্তানে আজ ৪ হাজারেরও বেশি মসজিদ রয়েছে। ২৩ হাজারের মতো ছাত্র দ্বীনি শিক্ষায় মনোযোগী। দেশের বাইরে পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিশর প্রভৃতি দেশেও উচ্চতর লেখাপড়া করতে কাজাখস্তানের শিক্ষার্থীরা পাড়ি জমাচ্ছে। সুতরাং অবশেষে ওই অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনই হলো, কমিউনিজমের আলো নিভে গেল এবং সত্যের ধর্ম ইসলামই টিকে থাকল।
কাজাখস্তান মধ্য এশিয়ার একটি প্রজাতান্ত্রিক দেশ। এটি বিশ্বের নবম বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং বৃহত্তম স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। এর উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে চীন, দক্ষিণে কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান এবং পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর ও রাশিয়া। কাজাখস্তানের বেশিরভাগ এশিয়া মহাদেশে পড়লেও দেশটির উরাল নদীর পশ্চিমের কিছু অংশ ইউরোপ মহাদেশে পড়েছে।
খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতকে তার্কি ও ইরান থেকে বহু মানুষ এ দেশে গিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। এ দেশের ওপর দিয়েই এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য হতো বিখ্যাত ‘সিল্ক রোড’ এর মধ্য দিয়ে। ১৩ শতকে মোঙ্গলরা এখানে রাজত্ব শুরু করে। ১৬ শতক পর্যন্ত মোঙ্গলরা বিনা বাধায় এখানে রাজত্ব করে। উনিশ শতক থেকে রাশিয়া এ দেশ দখল করে এবং কাজাখস্তানে জারের রাজত্ব শুরু হয়। দুই বিশ্বযুদ্ধের পরও রাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার দখলেই থাকে দেশটি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাশিয়া থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয় দেশটি। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটি প্রেসিডেন্ট শাসিত। অর্থনৈতিকভাবে মধ্য এশিয়ার নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্র কাজাখস্তান। পুরো অঞ্চলের ৬০ শতাংশ জিডিপি এই দেশটির। খনিজসমৃদ্ধ দেশটির মূল সম্পদ তেল ও গ্যাস। দেশটির মোট আয়তন ২৭ লাখ ১৭ হাজার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনের দিক দিয়ে দেশটি বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। ‘কাজাখ’ কাজাখস্তানের সরকারি ভাষা।
দেশের উত্তর অংশে অবস্থিত আস্তানা শহর দেশটির রাজধানী। এ দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। কাজাখস্তানের মুসলমানরা ধর্মকর্ম পালন করেন বেশ ঘটা করে। ধর্ম শুধু পরিচয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ধর্মের প্রভাব দারুণভাবে উপস্থিত। এ বিষয়েই বলছিলেন মদিনা নুরগালিভা। তিনি কাজাখস্তানের বিশিষ্ট সমাজবিদ হিসেবে বেশ সমাদৃত। দেশটির সমাজে ধর্মের প্রভাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, দেশের সক্রিয় প্রায় ৯০ শতকরা যুবকই ধর্মভীরু। আরও অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই শতকরা ৯০ ভাগের ৮৬ ভাগই মুসলমান।
মদিনা নুরগালিভা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যুবকদের মাঝে ধর্মের প্রভাবের বিষয়ের ওপর গবেষণার পর এমন মন্তব্য করেন।
তার গবেষণা অনুযায়ী তুলনামূলকভাবে কাজাখস্তানের যুবকরা ধর্মীয় প্রভাবে দারুণভাবে প্রভাবিত। এমন প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতে খুব একটা দেখা যায় না। যুবকদের কেউ কেউ ধর্মের বিষয়ে সরকারের নীতিকে সুষম জ্ঞান করলেও তাদের বিরাট একটি অংশ মনে করেন, ধর্মের বিষয়ে সরকারের নীতি বেশ দুর্বল। কাজাখস্তানের ধর্ম অধিদপ্তরের হিসাব মতে, দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক হাজার মসজিদ রয়েছে। রয়েছে শতাধিক মাদরাসা ও হাজারের বেশি ইসলামিক সেন্টার। দেশের উল্লেখযোগ্য মসজিগুলোর অন্যতম হলো হজরত সুলতান মসজিদ।
মসজিদটি রাজধানী আস্তানায় অবস্থিত। এটি কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় এবং মধ্য এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। এই মসজিদে একসঙ্গে ৫০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। কয়েক বছর আগে শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমানি ধর্মীয় এক সফরে কাজাখস্তান গিয়েছিলেন। সেখানে ধর্মীয় কয়েকটি কনফারেন্সে তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেই সফরের বৃত্তান্ত তিনি ‘সফর দর সফর’ নামক তার (তৃতীয়) ভ্রমণকাহিনিতে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন, সেখানকার কিছু উদ্যমী যুবকের মুখে আমি বিশুদ্ধ আরবি শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করলে জানতে পারলাম তারা হাফেজে কোরআনও। অথচ বয়সের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনকালেই তাদের বেড়ে ওঠা। কৌতূহলী আবেগে জিজ্ঞেস করলাম, যেখানে এক দীর্ঘকাল কোরআনের কপি ঘরে রাখাই অপরাধ ছিল, সেখানে আপনারা কীভাবে কোরআন হেফজ করলেন আর কেমন করেই বিশুদ্ধ আরবি শিখতে পারলেন! প্রশ্ন শুনে তাদের চোখগুলো থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল।
তাদের পূর্বপুরুষ আলেমরা কীভাবে জান ও মাল বিসর্জন দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্তানদের এবং নতুন প্রজন্মকে ঘরে ঘরে গিয়ে গোপনে মাটির নিচে কোরআন শেখাতেন। শুধু তেলাওয়াতই নয়, আরবি ভাষা, ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান সবকিছুর তারা শিক্ষা প্রদান করতেন। বস্তুত তাদের ওই বিরাট ত্যাগ-তিতিক্ষার বদৌলতে আজ যখন কাজাখস্তান স্বাধীনতা লাভ করল দ্বীনি শিক্ষার লোকের অভাব দেখা দেয়নি। আর তাদের হাতেগড়া তরুণরাই আজকের কাজাখস্তানে ধর্মীয় ক্ষেত্রে মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে।