বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ পবিত্র রমজান মাস আমাদের মাঝে আসে আল্লাহর অফুরান রহমত ও বরকতের সওগাত নিয়ে। প্রতিটি মুসলমানের মনের কামনা নির্বিঘে শান্তির পরিবেশে রোজ রাখবে, আল্লাহর ইবাদতে একটি মাস অতিবাহিত করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, রোজার মাস এলে দেখা যায়, ইফতার-সাহরির সামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজীয় দ্রব্যের দাম হঠাৎ অনেক বেড়ে যায়। অথচ রমজান ছাড়া বছরের অন্যান্য মাসে এসব খাদ্যপণ্যের দাম অনেকটাই সহনীয় বা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে।
ব্যতিক্রম ঘটে শুধু রমজান মাসে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা তাদের গুদামে পবিত্র রমজান মাসের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী খাদ্য অনৈতিকভাবে মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, আর রমজানের এক মাস কিংবা ১৫ দিন আগে বাজারের চাহিদা অনুপাতে সীমিত পরিমাণে বাজারে সরবরাহ করে এবং এর মূল্য বৃদ্ধি করে দেয়। যদিও এদের সংখ্যা কম; কিন্তু বাজারব্যবস্থাকে এই কমসংখ্যক ব্যবসায়ীই নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই রমজান শুরু হওয়ার আগে দেখা যায়, চিনি, ছোলা বুট, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেলসহ সবধরনের মশলা, ডালসহ এ জাতীয় পণ্যের দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অবশ্যই দায়িত্ব রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসায়ীদের মর্যাদার বিষয়টি সামনে আনলে এ বিষয়টি সহজে বোধগম্য হবে।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘সত্যবাদী, আমানতদার ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ী ব্যক্তি হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের মাঝে শামিল থাকবেন।’ (সুবহানআল্লাহ!)। (তিরমিজি)।
ব্যবসায়ী ভাইয়েরা, ভাবুন তো! আপনাদের সঠিক ব্যবসার মাধ্যমে কত বড় উচ্চমর্যাদার সুযোগ রয়েছে? এখন আপনারাই বলুন, পবিত্র রমজান মাস এলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কি নির্বিঘে রোজা রাখবেন, না দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা ভেবে চিন্তায় পড়বেন?
ব্যবসার ব্যাপারে ইসলাম কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছে। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ব্যবসাকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে আর সুদকে করা হয়েছে হারাম।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)। ইসলামে ব্যবসার সব দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। অথচ আমরা আমাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে নৈতিকতার সব সীমা পদদলিত করছি। কোনো মুসলমান ব্যবসায়ী কীভাবে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটিয়ে অন্য মুসলমানদের আল্লাহর স্মরণের পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে? আরববিশ্বের বিভিন্ন দেশে পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দেওয়া হয় এবং মুসলমানরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে রোজাদারদের সেবা করার মানসিকতা দেখায়।
অথচ আমাদের বাংলাদেশে? শুধু যে মুসলমানরা এ কাজ করে তা নয়, বরং অন্য ধর্মাবলম্বী কিছু অসাধু ব্যবসায়ীও অনৈতিকভাবে পণ্যদ্রব্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। যেখানে বিশ্বব্যাপী পবিত্র রমজান মাস এলে মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়ে যায়; ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, সেখানে আমাদের দেশের বাজারব্যবস্থা রমজানের আগের সঙ্গে রমজান চলাকালীন কোনো মিল থাকে না। এটি সত্যিই বড় বেদনার কথা।
সার্বিকভাবে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার লক্ষ্যে রোজাদারের যথাযথ দায়িত্ব পালন, আত্মশুদ্ধি অর্জন ও ইবাদত-বন্দেগিকে নির্বিঘ করতে সব ব্যবসায়ীর এ মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মর্যাদা উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। পবিত্র হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর নিজ হাতের প্রতিদান লাভের আশায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করে বরং কমিয়ে আনা এবং বাজার স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি খাদ্যে ভেজাল না মেশানোই হবে ব্যবসায়ী ভাইদের নৈতিক দায়িত্ব।
ব্যবসায়ীরা যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন তবে প্রত্যেক রোজাদার ইফতার ও সাহরির দ্রব্যসামগ্রী ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারবেন এবং তারা রোজা পালন ও আত্মশুদ্ধি অর্জনে কষ্ট এবং হয়রানির শিকার হবেন না। ব্যবসায়ীরা যদি তাদের ব্যবসায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, রোজাদারদের পাশে সহানুভূতি ও দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারেন, তবে নিশ্চয়ই তাদের জন্য থাকবে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (সা.) এর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় রহমত, বরকত এবং পরকালের মাগফিরাত ও নাজাতসহ প্রভূত কল্যাণ।
আসুন, আমরা পবিত্র রমজান মাসকে যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপনে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য ও সহমর্মিতার সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে অঙ্গীকারবদ্ধ হই। রমজানজুড়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে ভেজালমুক্ত হালাল খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন ও নৈতিক উন্নত চরিত্র গঠনে এগিয়ে আসি। আল্লাহ তায়ালা ব্যবসায়ী ভাইদের পবিত্র রমজান মাসের সঠিক বুঝ ও যথাযথ দায়িত্ব পালনের তৌফিক দিন।
লেখক : খতিব, মনিপুর বাইতুর রওশন জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা