ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোরআনের আলোয় পরিবার গঠন

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মানব ইতিহাসে সবচেয়ে পুরানো ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিবার। মানব সভ্যতার বয়সের সমান এর বয়স। এ হচ্ছে মানব সভ্যতার স্থায়ী সংস্থা। একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান মানবরূপে বেড়ে ওঠার মূল সবক ও প্রশিক্ষণ পায় পরিবার থেকে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি মানব শিশুই জন্ম নেয় মুসলমান রূপে। কিন্তু পিতা-মাতা বা পরিবারের প্রভাবে বেড়ে ওঠে ইহুদি, নাসারা বা অমুসলিম রূপে।

আমাদের সমাজের পরিবার নামক এ সনাতন প্রতিষ্ঠানটি আজ কোরআন বিমুখ। অথচ আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম গুণ হচ্ছে সুন্দর পারিবারিক জীবন কামনা। তাদের এ জীবনদর্শন একটি দোয়ার মাধ্যমে প্রকাশ হয়। আল্লাহপাক বলেন, ‘তারা আমার কাছে আকুতি জানায়, হে আমার রব আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী পরিজন ও আমাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে চোখের শীতলতারূপে দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকিদের ইমাম ও নেতারূপে সাব্যস্ত করুন।’ (সূরা ফুরকান: ৭৪)।

আমাদের সন্তানদের উপরোক্ত আয়াতের দাবি অনুযায়ী গঠন করতে হলে শৈশব থেকেই তার প্রস্তুতি নিতে হবে। যখন আমাদের শিশুরা এক শব্দ, দুই শব্দ করে উচ্চারণ করে অথবা এক বাক্য আধা বাক্য বলতে চেষ্টা করে, তখনই অভিভাবকদের উচিত ভালো ভালো কথা শিখিয়ে দেওয়া, যেমন আল্লাহর নাম, সালাম, বিসমিল্লাহ ইত্যাদি। অর্থাৎ আমাদের প্রাত্যহিক কথাগুলোকে ইসলামের রঙে সাজিয়ে বলা বা শেখানো, এতে করে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই সেভাবে তৈরি হবে।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের একক বা ভিত্তি হলো পরিবার। সুন্দর এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য পারিবারিক পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই সামাজিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করে পারিবারিক কাঠামো, সমাজে চলাচলের জন্য ন্যূনতম জ্ঞান পরিবার থেকেই শেখা যায়। অপরের সঙ্গে আচার ব্যবহার কেমন হবে তার অনেকটাই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে রপ্ত করে। পরিবার থেকে যদি শিশু ভালো শিক্ষা না পেয়ে থাকে তবে সমাজে তার চালচলন মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করবে। পরিবারে অভিভাবকদের দেওয়া উপদেশ শিশুকে নীতি বোধে জাগ্রত করে এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে রক্ষা করে। তাই একে পারিবারিক বিদ্যালয় বা শিক্ষালয় বলা হয়।

পরিবারের ভূমিকা: পবিত্র কোরআনে পরিবারের ইউনিটকে সুরক্ষিত দুর্গ বলা হয়েছে। এটি যেমন সবচেয়ে ছোট তেমনি আবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। জাতি গঠনে এ পরিবারই মূল দায়িত্বটি পালন করে থাকে। আবার একটি সমাজে ভাঙন ও বিপর্যয়ও শুরু হয় পরিবার থেকেই। একটি পরিবারের মূল প্রাণশক্তি বা চালিকাশক্তি হলো প্যারেন্টিং। অর্থাৎ একটি পরিবারকে যথাযথভাবে কার্যকর ও সক্রিয় রাখে এ প্যারেন্টিং। পিতা-মাতা বা অভিভাবকের দায়িত্ব কর্তব্য বোঝাতে পরিভাষা হিসেবে বিভিন্ন দেশে এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। প্যারেন্টিং হচ্ছে জীবনকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে, কল্যাণ, জ্ঞানে, বোধে, শিক্ষায় রুচিতে সন্তানের জন্য মানবিক উত্তরণের এক পথের ঠিকানা করে দেওয়ার এক মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান।

একটি ইসলামি পরিবারের পরিকল্পনা হবে পরিবারের সবাইকে ইসলামি শিক্ষায় গড়ে তোলা। তাদের কোরআনমুখী করা, কোরআনের আলোয় হৃদয় আলোকিত করে, পরিবার সমাজ ও দেশময় আলোকিত করা। এজন্য সপ্তাহে অন্তত একটি পারিবারিক বৈঠক করে ইসলামি জীবনব্যবস্থা ও পদ্ধতি সম্বন্ধে ইসলামের বিভিন্ন দিক এবং বিষয়ের ওপর পরস্পর আলোচনা ও জ্ঞান অর্জন করা উচিত। এ ধারণা আমরা ছোটবেলার ‘ফুরকানিয়া কোরআনিয়া’ বা মক্তব থেকে পাই, যা মৃত্যু পর্যন্ত এ কোরআন বৈঠক বা ক্লাস চালু রাখা যায়। আমরা নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট কোরআন শিক্ষা বৈঠক করতে পারি। কেননা আল্লাহ তায়ালা মোমিনদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ‘তোমাদের ঘরে আল্লাহপাকের আয়াত ও হিকমা বা হাদিসের যে কথা আলোচনা করা হয়, তোমরা তা স্মরণ রেখ এবং একে অপরের কাছে বর্ণনা করো। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা সূক্ষ্মদর্শী ও সম্যক অবগত। (সূরা আহজাব: ২৪)।

‘উজ্কুর’ শব্দটি স্মরণ রাখা অর্থে এবং বর্ণনা করা অর্থে ব্যবহার হয়। যুগে যুগে প্রত্যেক নবী পরিবারে পারিবারিক শিক্ষা বৈঠক চালু ছিল। বর্তমান ও ভবিষ্যতেও প্রকৃত ঈমানদারদের ঘরে ঘরে এ শিক্ষা বৈঠক চালু থাকবে।
ইসলামি জ্ঞান শিক্ষা দান সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা আততাহরিম: ৬)। আল্লাহপাক বলেন, ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।’ (সূরা আশশুয়ারা: ২১৪)।

তাই আপনি আপনার নিজের জন্য যেমন জিম্মাদার, আপনার পরিবারের জন্যও তেমনি দায়িত্বশীল। এমনকি নিকটাত্মীয়দেরও সতর্ক করে যেতে হবে। প্রতিদিন আমাদের ঘরগুলোয় বিভিন্ন বৈঠক চলছে। খাওয়া-দাওয়ার বৈঠক, চায়ের বৈঠক, কথামালার বৈঠক তাহলে আমরা কি সপ্তাহে একটি বৈঠক কোরআন জানার জন্য বোঝার জন্য করতে পারি না? প্রতি মাসেও কী একটি কোরআনি ক্লাস করতে পারি না? উদ্যোগ নিলেই পারি। ‘সময়’ নামক মূলধনকে অনন্ত জীবনের পুঁজি মনে করলেই পারি।

মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম ‘ইকরা’ শব্দের মাধ্যমে হেরা পর্বতে জ্বলে ওঠেছিল নূর বা বাতি। এ আলো মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ২৩ বছর প্রাণপণ সাধনা করেছেন আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তার ইন্তেকালের পর সেই নূর বা আলো প্রিয় নবীর আসহাবরা পৌঁছিয়েছেন দুনিয়ায়। আমাদেরও দায়িত্ব এ ‘নূর’ বা বাতি প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করা। যে নূর আমাদের কবর, হাশর, মিজান, পুলসিরাত এবং জান্নাতের পথে সাথী হয়ে থাকবে। আমাদের ঘরখানাকে দারুল কোরআন বা নিজেদের আহলে কোরআন হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যখন কিছু লোক কোনো একটি ঘরে আল্লাহর কিতাবের আলোচনায় মগ্ন থাকে, তখন তাদের ওপরে মহা প্রশান্তি অবতীর্ণ হতে থাকে এবং আল্লাহর রহমত ও করুণা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে, আর ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ স্বয়ং কাছের ফেরেশতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করে থাকেন।’ (মুসলিম)।

কোরআন শিক্ষার পুরস্কার জান্নাত : আমরা যদি আমাদের পরিবার পরিজনকে কোরআনমুখী করার চেষ্টা-সাধনা করি তাহলে আল্লাহপাক আমাদের পরিবারভুক্ত সবাইকে সপরিবারে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তানাদি ঈমানের পথ অনুসরণ করেছে আমরা তাদের সন্তানদেরকে শামিল করে দেব এবং তাদের আমলের কোনো কমতি করা হবে না।’ (সূরা তুর: ২১)।

আল্লাহ আরও বলেন, ‘চিরস্থায়ী জান্নাতে তারা নিজেরাও প্রবেশ করবে এবং তাদের বাপ-দাদা, তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা নেক ও সৎ আমল করেছে তারাও তাদের সঙ্গে সেখানে যাবে। এবং ফেরেশতারা চারদিক থেকে তাদের সংবর্ধনার জন্য এসে বলবে তোমাদের প্রতি সালাম, যে জন্য তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ, কতই না উত্তম পরকালের এ বাড়ি।’ (সূরা রাদ: ২৩-২৪)।

ভূমিকা পালন না করার পরিণতি: আমরা যখন কোরআনের আহ্বান পেয়েছি, তখন প্রত্যেককেই ‘কোরআনের দায়িত্ব’ বহনের ভূমিকা পালন করতে হবে। এ দায়িত্বে অবহেলা করলে কেয়ামতের দিন আল্লাহর রাসূল (সা.) উম্মতের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে মামলা করবেন। আল্লাহ হবেন বিচারক, রাসুল (সা.) হবেন বাদী এবং আসামি হবেন যারা দুনিয়ায় কোরআনকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখেছিল কোরআন প্রচারে ও প্রতিষ্ঠার ভূমিকা পালন করেননি তারা। আল্লাহপাক বলেন, ‘সেদিন তিনি (রাসুলুল্লাহ) উম্মতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলবেন, নিশ্চয়ই আমার উম্মত এই কোরআন পেয়ে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।’ (সূরা ফুরকান: ৩০)।

অতএব, কোরআনের হক আদায় করে যেন এর তেলাওয়াত, অর্থ ও মর্ম উদ্ধার, প্রচার ও সমাজে বাস্তবায়নের ভূমিকা পালন করে মুক্তির পথ অনুসরণ করতে পারি। কেয়ামতের সেই কঠিন মুহূর্তে কোরআন যেন হয় আমাদের সুপারিশকারী। আল্লাহ আমাদের সিরাতুল মুস্তাকিমে চলার তাওফিক দিন।

লেখক : খতিব, বিন্নাপাড়া জামে মসজিদ রাজাপুর, ঝালকাঠি

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

কোরআনের আলোয় পরিবার গঠন

আপডেট টাইম : ০৭:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মানব ইতিহাসে সবচেয়ে পুরানো ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিবার। মানব সভ্যতার বয়সের সমান এর বয়স। এ হচ্ছে মানব সভ্যতার স্থায়ী সংস্থা। একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান মানবরূপে বেড়ে ওঠার মূল সবক ও প্রশিক্ষণ পায় পরিবার থেকে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি মানব শিশুই জন্ম নেয় মুসলমান রূপে। কিন্তু পিতা-মাতা বা পরিবারের প্রভাবে বেড়ে ওঠে ইহুদি, নাসারা বা অমুসলিম রূপে।

আমাদের সমাজের পরিবার নামক এ সনাতন প্রতিষ্ঠানটি আজ কোরআন বিমুখ। অথচ আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম গুণ হচ্ছে সুন্দর পারিবারিক জীবন কামনা। তাদের এ জীবনদর্শন একটি দোয়ার মাধ্যমে প্রকাশ হয়। আল্লাহপাক বলেন, ‘তারা আমার কাছে আকুতি জানায়, হে আমার রব আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী পরিজন ও আমাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে চোখের শীতলতারূপে দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকিদের ইমাম ও নেতারূপে সাব্যস্ত করুন।’ (সূরা ফুরকান: ৭৪)।

আমাদের সন্তানদের উপরোক্ত আয়াতের দাবি অনুযায়ী গঠন করতে হলে শৈশব থেকেই তার প্রস্তুতি নিতে হবে। যখন আমাদের শিশুরা এক শব্দ, দুই শব্দ করে উচ্চারণ করে অথবা এক বাক্য আধা বাক্য বলতে চেষ্টা করে, তখনই অভিভাবকদের উচিত ভালো ভালো কথা শিখিয়ে দেওয়া, যেমন আল্লাহর নাম, সালাম, বিসমিল্লাহ ইত্যাদি। অর্থাৎ আমাদের প্রাত্যহিক কথাগুলোকে ইসলামের রঙে সাজিয়ে বলা বা শেখানো, এতে করে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই সেভাবে তৈরি হবে।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের একক বা ভিত্তি হলো পরিবার। সুন্দর এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য পারিবারিক পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই সামাজিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করে পারিবারিক কাঠামো, সমাজে চলাচলের জন্য ন্যূনতম জ্ঞান পরিবার থেকেই শেখা যায়। অপরের সঙ্গে আচার ব্যবহার কেমন হবে তার অনেকটাই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে রপ্ত করে। পরিবার থেকে যদি শিশু ভালো শিক্ষা না পেয়ে থাকে তবে সমাজে তার চালচলন মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করবে। পরিবারে অভিভাবকদের দেওয়া উপদেশ শিশুকে নীতি বোধে জাগ্রত করে এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে রক্ষা করে। তাই একে পারিবারিক বিদ্যালয় বা শিক্ষালয় বলা হয়।

পরিবারের ভূমিকা: পবিত্র কোরআনে পরিবারের ইউনিটকে সুরক্ষিত দুর্গ বলা হয়েছে। এটি যেমন সবচেয়ে ছোট তেমনি আবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। জাতি গঠনে এ পরিবারই মূল দায়িত্বটি পালন করে থাকে। আবার একটি সমাজে ভাঙন ও বিপর্যয়ও শুরু হয় পরিবার থেকেই। একটি পরিবারের মূল প্রাণশক্তি বা চালিকাশক্তি হলো প্যারেন্টিং। অর্থাৎ একটি পরিবারকে যথাযথভাবে কার্যকর ও সক্রিয় রাখে এ প্যারেন্টিং। পিতা-মাতা বা অভিভাবকের দায়িত্ব কর্তব্য বোঝাতে পরিভাষা হিসেবে বিভিন্ন দেশে এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। প্যারেন্টিং হচ্ছে জীবনকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে, কল্যাণ, জ্ঞানে, বোধে, শিক্ষায় রুচিতে সন্তানের জন্য মানবিক উত্তরণের এক পথের ঠিকানা করে দেওয়ার এক মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান।

একটি ইসলামি পরিবারের পরিকল্পনা হবে পরিবারের সবাইকে ইসলামি শিক্ষায় গড়ে তোলা। তাদের কোরআনমুখী করা, কোরআনের আলোয় হৃদয় আলোকিত করে, পরিবার সমাজ ও দেশময় আলোকিত করা। এজন্য সপ্তাহে অন্তত একটি পারিবারিক বৈঠক করে ইসলামি জীবনব্যবস্থা ও পদ্ধতি সম্বন্ধে ইসলামের বিভিন্ন দিক এবং বিষয়ের ওপর পরস্পর আলোচনা ও জ্ঞান অর্জন করা উচিত। এ ধারণা আমরা ছোটবেলার ‘ফুরকানিয়া কোরআনিয়া’ বা মক্তব থেকে পাই, যা মৃত্যু পর্যন্ত এ কোরআন বৈঠক বা ক্লাস চালু রাখা যায়। আমরা নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট কোরআন শিক্ষা বৈঠক করতে পারি। কেননা আল্লাহ তায়ালা মোমিনদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ‘তোমাদের ঘরে আল্লাহপাকের আয়াত ও হিকমা বা হাদিসের যে কথা আলোচনা করা হয়, তোমরা তা স্মরণ রেখ এবং একে অপরের কাছে বর্ণনা করো। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা সূক্ষ্মদর্শী ও সম্যক অবগত। (সূরা আহজাব: ২৪)।

‘উজ্কুর’ শব্দটি স্মরণ রাখা অর্থে এবং বর্ণনা করা অর্থে ব্যবহার হয়। যুগে যুগে প্রত্যেক নবী পরিবারে পারিবারিক শিক্ষা বৈঠক চালু ছিল। বর্তমান ও ভবিষ্যতেও প্রকৃত ঈমানদারদের ঘরে ঘরে এ শিক্ষা বৈঠক চালু থাকবে।
ইসলামি জ্ঞান শিক্ষা দান সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা আততাহরিম: ৬)। আল্লাহপাক বলেন, ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।’ (সূরা আশশুয়ারা: ২১৪)।

তাই আপনি আপনার নিজের জন্য যেমন জিম্মাদার, আপনার পরিবারের জন্যও তেমনি দায়িত্বশীল। এমনকি নিকটাত্মীয়দেরও সতর্ক করে যেতে হবে। প্রতিদিন আমাদের ঘরগুলোয় বিভিন্ন বৈঠক চলছে। খাওয়া-দাওয়ার বৈঠক, চায়ের বৈঠক, কথামালার বৈঠক তাহলে আমরা কি সপ্তাহে একটি বৈঠক কোরআন জানার জন্য বোঝার জন্য করতে পারি না? প্রতি মাসেও কী একটি কোরআনি ক্লাস করতে পারি না? উদ্যোগ নিলেই পারি। ‘সময়’ নামক মূলধনকে অনন্ত জীবনের পুঁজি মনে করলেই পারি।

মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম ‘ইকরা’ শব্দের মাধ্যমে হেরা পর্বতে জ্বলে ওঠেছিল নূর বা বাতি। এ আলো মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ২৩ বছর প্রাণপণ সাধনা করেছেন আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তার ইন্তেকালের পর সেই নূর বা আলো প্রিয় নবীর আসহাবরা পৌঁছিয়েছেন দুনিয়ায়। আমাদেরও দায়িত্ব এ ‘নূর’ বা বাতি প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করা। যে নূর আমাদের কবর, হাশর, মিজান, পুলসিরাত এবং জান্নাতের পথে সাথী হয়ে থাকবে। আমাদের ঘরখানাকে দারুল কোরআন বা নিজেদের আহলে কোরআন হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যখন কিছু লোক কোনো একটি ঘরে আল্লাহর কিতাবের আলোচনায় মগ্ন থাকে, তখন তাদের ওপরে মহা প্রশান্তি অবতীর্ণ হতে থাকে এবং আল্লাহর রহমত ও করুণা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে, আর ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ স্বয়ং কাছের ফেরেশতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করে থাকেন।’ (মুসলিম)।

কোরআন শিক্ষার পুরস্কার জান্নাত : আমরা যদি আমাদের পরিবার পরিজনকে কোরআনমুখী করার চেষ্টা-সাধনা করি তাহলে আল্লাহপাক আমাদের পরিবারভুক্ত সবাইকে সপরিবারে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তানাদি ঈমানের পথ অনুসরণ করেছে আমরা তাদের সন্তানদেরকে শামিল করে দেব এবং তাদের আমলের কোনো কমতি করা হবে না।’ (সূরা তুর: ২১)।

আল্লাহ আরও বলেন, ‘চিরস্থায়ী জান্নাতে তারা নিজেরাও প্রবেশ করবে এবং তাদের বাপ-দাদা, তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা নেক ও সৎ আমল করেছে তারাও তাদের সঙ্গে সেখানে যাবে। এবং ফেরেশতারা চারদিক থেকে তাদের সংবর্ধনার জন্য এসে বলবে তোমাদের প্রতি সালাম, যে জন্য তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ, কতই না উত্তম পরকালের এ বাড়ি।’ (সূরা রাদ: ২৩-২৪)।

ভূমিকা পালন না করার পরিণতি: আমরা যখন কোরআনের আহ্বান পেয়েছি, তখন প্রত্যেককেই ‘কোরআনের দায়িত্ব’ বহনের ভূমিকা পালন করতে হবে। এ দায়িত্বে অবহেলা করলে কেয়ামতের দিন আল্লাহর রাসূল (সা.) উম্মতের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে মামলা করবেন। আল্লাহ হবেন বিচারক, রাসুল (সা.) হবেন বাদী এবং আসামি হবেন যারা দুনিয়ায় কোরআনকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখেছিল কোরআন প্রচারে ও প্রতিষ্ঠার ভূমিকা পালন করেননি তারা। আল্লাহপাক বলেন, ‘সেদিন তিনি (রাসুলুল্লাহ) উম্মতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলবেন, নিশ্চয়ই আমার উম্মত এই কোরআন পেয়ে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।’ (সূরা ফুরকান: ৩০)।

অতএব, কোরআনের হক আদায় করে যেন এর তেলাওয়াত, অর্থ ও মর্ম উদ্ধার, প্রচার ও সমাজে বাস্তবায়নের ভূমিকা পালন করে মুক্তির পথ অনুসরণ করতে পারি। কেয়ামতের সেই কঠিন মুহূর্তে কোরআন যেন হয় আমাদের সুপারিশকারী। আল্লাহ আমাদের সিরাতুল মুস্তাকিমে চলার তাওফিক দিন।

লেখক : খতিব, বিন্নাপাড়া জামে মসজিদ রাজাপুর, ঝালকাঠি