ঢাকা , শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্রের রূপকার

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ১৯৬৪ সালে বিলেতের উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফেরেন ৩২ বছর বয়সের এক যুবক। গণমাধ্যমের ভাষায় সুদানে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের। সামরিক শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে সাধারণ জনগণ। পরিবার ও বন্ধুমহলের ধারণা ছিল তিনি প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও আইনজ্ঞ হবেন। সরকার তাকে খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ফ্যাকাল্টির গুরুত্বপূর্ণ পদে আমন্ত্রণ জানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-নির্ধারণী বিতর্কেই তিনি সামরিক শাসক ইব্রাহীম আবুদকে আক্রমণ করে বসেন। এমনকি সমারিক ভীতি উপেক্ষা করে সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের ডাকা জনসমাবেশে যোগ দেন এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তৃতা দিয়ে এক লহমায় সুদানি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এসে হাজির হন। চলমান আন্দোলন নতুন করে গতি পায়। শেষ পর্যন্ত এ বছরের অক্টোবরেই আবুদ সরকারের পতন ঘটে। এই যুবকই পরবর্তী সময়ে বিশ্বে ‘হাসান তুরাবি’ নামে বিখ্যাত হন। মুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়িয়ে তার পরিচিতি আরও বহুদূর বিস্তৃত হয়ে পড়ে।

তার পূর্ণনাম হাসান আবদুল্লাহ আত-তুরাবি। ১৯৩২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি সুদানের কাসসালায় ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের পূর্বপুরুষ ‘ওয়াদ আল-তুরাব’ ছিলেন ১৮ শতকের আলেম ও ফকিহ; একজন সংস্কারপন্থি সুফি হিসেবে তার খ্যাতি ছিল বিস্তর। তুরাবি ছিলেন ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ। জন্মের অল্প কিছুদিন পরই মা মারা যান। বাবা সেকালে সুদানে ব্রিটিশ প্রশাসনের শরিয়া আদালতের একজন বিচারক ছিলেন। আপসকামী মনোভাবের না হওয়ার তাকে বারংবার কর্তৃপক্ষের বদলির কবলে পড়তে হয়। এর ফলে পরিবারের সঙ্গে তুরাবিকে নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতে হয়। লেখাপড়ার হাতেখড়িও হয় বাবার হাতেই। কোরআনের ভাষা যেন তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পারেন, তাই অল্প বয়সেই তার বাবা তাকে ইবনে মালিকের ‘আলফিয়া’ ও ‘লামিয়াত আফাল’ এর মতো দুটি আরবি ব্যাকরণগ্রন্থ মুখস্থ করান। ১৯৫০ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫৫ সালে আইনের উচ্চতর পড়াশোনার জন্য লন্ডনের কিংস কলেজে পাড়ি জমান এবং ১৯৫৭ সালে এখানকার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে প্যারিসের সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কনস্টিটিউশনাল ল’ বিষয়ে পিএইচডি করেন। তিনি একই সঙ্গে আরবি, ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং ছিলেন একজন হাফেজে কোরআন।

দেশে ফেরার পর মুসলিম ব্রাদারহুডের ছাত্র শাখা ‘ইসলামিক চার্টার ফ্রন্ট’ এর সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৬৫ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের চাপে পার্লামেন্টে সুদান কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে সাংবিধানিক সংকটের প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কাউন্সিল যে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে, তুরাবি ছিলেন তার অন্যতম। ১৯৬৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ‘জাফর নিমেরি’ সরকার ক্ষমতায় এলে দলের বহু সদস্যের সঙ্গে তিনি গ্রেপ্তার হন। তাকে ৬ বছরের কারাদ- ও ৩ বছর লিবিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালে নিমেরির মদদপুষ্ট ন্যাশনাল উম্মাহ পার্টির সঙ্গে ইসলামি চার্টার ফ্রন্টের ‘জাতীয় পুনর্মিলন’ অনুষ্ঠিত হলে তুরাবিসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান এবং নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন।

মুক্তি পেয়েই তিনি নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট (এনআইএফ) গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন। ক্ষমতায় আরোহণ করে নিমেরি সরকার শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৭৮ সালে তুরাবি সুপ্রিমকোর্টের এটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। ফলে সুদানে ইসলামি আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে তুরাবির সামনে বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ তৈরি হয় এবং একই সঙ্গে সুদানি সমাজে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠার ভিত্তিও রচিত হয়। তার জীবনীকাররা মনে করেন, ইসলামের ‘তাজদিদি’ ধারণা এ সময়েই তার ভেতর আসন করে নেয়। তিনি মনে করতে থাকেন, কোনো বিদেশি ব্যবস্থা থেকে ধার করে নয়, ইসলামের ভিতরকার শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করেই আধুনিক সময়ে ইসলামি আইনের প্রয়োগনীতি বের করা সম্ভব।

তিনি ‘তাজদিদ’ এর সংজ্ঞা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন ১৯৮০ সালে একটি কনফারেন্সে ‘ইসলামের মূলরীতিকে অক্ষুণ রেখে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সময়োপযোগী ব্যাখ্যা প্রদান করা। কারণ, শুধু এই পদ্ধতিতেই ইসলামের মূলসূত্র চিরকাল ‘জীবন্ত ও কার্যকর’ ব্যাখ্যা করা সম্ভব।’ তাজদিদের জন্য দুটি বিষয় প্রয়োজন ফিকহর পুনর্নির্মাণ ও শরিয়ার বাস্তবায়ন। ‘তাজদিদুল ফিকরিল ইসলামি’ (১৯৮২) গ্রন্থে তিনি লেখেন “মানব সমাজে ইতিহাসের পরিবর্তন অতিক্রম করা যায় না। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষকে কালিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে তাদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে চলতে হবে এবং এভাবেই সে সত্যিকারের ‘মোমিন’ হতে পারবে।” তার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল কোরআনের টেক্সটকে নাজিলের সময়ের সঙ্গে আটকে রাখা যায় না, তাহলে কালের অসঙ্গতির কারণে মানুষ কোরআন থেকে ‘ভুল মেসেজ’ নেবে এবং কোরআনকে ‘কালোত্তীর্ণ’ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না।

এরপর ১৯৮২ সালে তিনি প্রসিডেন্টের আইন ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হন। ১৯৮৫ সালে নিমেরি সরকারের পতন হলে ’৮৬ এর সংসদ নির্বাচনে তার দল অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে তুরাবির দলের বিরুদ্ধে একক প্রার্থী দাঁড় করায়। সুতরাং সঙ্গত কারণেই এনআইএফ জয় লাভ করতে ব্যর্থ হয়। যদিও তার দল কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিলে তিনি আইনমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। তবে এই নির্বাচনের সময় তিনি প্রথম লক্ষ করেন সমাজের নারীরা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, সমানাধিকারের দাবি তুলেছে এবং তারা কমিউনিস্টপন্থি দলে ভিড়ে যাচ্ছে। তুরাবি জোর দিয়ে বলেন ‘ইসলামে নারী ও পুরুষে কোনো মৌলিক তফাৎ নেই। ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা নিজ দায়িত্বে ইসলাম কবুল করেছেন। সমাজের মুক্ত অঙ্গন শুধু পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট নয়, এখানে লিঙ্গ-বিভাজন টানা চরম মূর্খতা। মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার প্রধান একজন নারীও হতে পারে। এমনকি অন্য যে-কোনো ধর্মের নারী হলেও সমস্যা নেই।’ এ বিষয়ে তিনি ‘ওমেন বিটুইন দ্য টিচিং অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড দ্য কাস্টমস অব সোসাইটি’ (১৯৭৩) শিরোনামে বিখ্যাত একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার বক্তব্য ও রচনা এতটা প্রভাব সৃষ্টি করে যে, অল্প দিনেই সুদানে নারীদের ভোটের হাওয়া ঘুরে যায় ইসলামি রাজনৈতিক দলের দিকে এবং ‘ইসলামি নারীবাদী’ চেতনাধারীরা মার্কসবাদীদের ছাড়িয়ে যায়।

১৯৮৯ সালে সুদানে ফের সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হলে এবং ওমর আল-বশিরের সরকার ক্ষমতায় এলে নেপথ্য নায়ক হিসেবে তুরাবিকেই ধারণা করা হয়। এ সময় তার দল সরকারে অংশগ্রহণ করে এবং তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিপত্তিগুলোও চাক্ষুষ করার সুযোগ লাভ করেন। ১৯৯১ সালে তিনি আরব-ইসলামিক পপুলার কংগ্রেস পার্টি গঠন করেন, যাতে ৪৫টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সংযুক্ত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর তুরাবি সুদান পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৮ সালে প্রণীত সুদানি সংবিধানে তুরাবির চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটে। তবে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ধারাবাহিক চাপে থাকা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার মতবিরোধ বাড়তে থাকে। ১৯৯৯ প্রেসিডেন্ট ওমর ট্যাঙ্ক পাঠান সংসদ ভেঙে দিতে এবং তুরাবিকে গ্রেপ্তার করতে। মুক্তির পরে ২০১০ সাল পর্যন্ত তাকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হলেও তার দলকে তিনি একটি শক্তিশালী বিরোধী দল প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। এ বছর নির্বাচনে তিনি তরুণদের আহ্বান জানান এবং নিজ দলের আবদুল্লাহ দেনহিয়েলকে প্রেসিডন্টে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেন।

সমসাময়িক সুদানি রাজনীতিবিদদের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক দিয়ে তুরাবি ছিলেন অনেক অগ্রসর। শেষ জীবনে নিজস্ব চিন্তাধারার কর্মী গঠনের দিকেই মনোযোগী ছিলেন বেশি। তার ‘ইসলামি আন্দোলনে পাওয়ার শেয়ারিং থিউরি’ বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামি আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হিসেবে দেখা দেয়। ‘কযায়াল ওয়াহদাতু ওয়াল হুররিয়া’ (১৯৮০), ‘তাজদিদুদ দীন (১৯৮৪), ‘মানহাজিয়াতুত তাশরি’ (১৯৮৭) ইত্যাদিসহ তিনি প্রায় ২০টি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন।

তুরাবির সবচেয়ে বড় সফলতা হলো, ইসলামি সংবিধানের ধারণা সুদানি রাজনীতির প্রধান এজেন্ডায় পরিণত করা। এর ফলে পার্লামেন্টের সংবিধান কমিটি ইসলামের নীতিকে সংবিধানের মূল উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে হয়তো ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়নি; কিন্তু সুদানের রাজনৈতিক লড়াইয়ে ইসলামের অবস্থানকে আর অস্বীকার করার উপায় থাকেনি।

২০১৬ সালের ৫ মার্চ পাখিডাকা সকালে তিনি খার্তুমের রয়েল কেয়ার হাসপাতালে কাফনমুড়ি দেন এবং মারা যান। তিনি পৃথিবীতে থেকেছেন দীর্ঘ ৮৪ বছর আর দিয়েছেন ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবন এবং অগণিত মৌলিক রচনা, মুগ্ধকর ভাষণ আর ভঙ্গুর সুদানের জন্য পপুলার কংগ্রেসের মতো একটি কল্যাণকামী রাজনৈতিক দল। মৃত্যুর কয়েকদিন পর জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জন ভল জাদলিয়া একটি ম্যাগাজিনে লিখেছেন তার রাজনৈতিক দল পপুলার কংগ্রেস পার্টিকে একবিংশ শতকের পোস্ট-ইসলামিজমের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্রের রূপকার

আপডেট টাইম : ০৭:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ১৯৬৪ সালে বিলেতের উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফেরেন ৩২ বছর বয়সের এক যুবক। গণমাধ্যমের ভাষায় সুদানে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের। সামরিক শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে সাধারণ জনগণ। পরিবার ও বন্ধুমহলের ধারণা ছিল তিনি প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও আইনজ্ঞ হবেন। সরকার তাকে খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ফ্যাকাল্টির গুরুত্বপূর্ণ পদে আমন্ত্রণ জানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-নির্ধারণী বিতর্কেই তিনি সামরিক শাসক ইব্রাহীম আবুদকে আক্রমণ করে বসেন। এমনকি সমারিক ভীতি উপেক্ষা করে সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের ডাকা জনসমাবেশে যোগ দেন এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তৃতা দিয়ে এক লহমায় সুদানি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এসে হাজির হন। চলমান আন্দোলন নতুন করে গতি পায়। শেষ পর্যন্ত এ বছরের অক্টোবরেই আবুদ সরকারের পতন ঘটে। এই যুবকই পরবর্তী সময়ে বিশ্বে ‘হাসান তুরাবি’ নামে বিখ্যাত হন। মুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়িয়ে তার পরিচিতি আরও বহুদূর বিস্তৃত হয়ে পড়ে।

তার পূর্ণনাম হাসান আবদুল্লাহ আত-তুরাবি। ১৯৩২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি সুদানের কাসসালায় ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের পূর্বপুরুষ ‘ওয়াদ আল-তুরাব’ ছিলেন ১৮ শতকের আলেম ও ফকিহ; একজন সংস্কারপন্থি সুফি হিসেবে তার খ্যাতি ছিল বিস্তর। তুরাবি ছিলেন ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ। জন্মের অল্প কিছুদিন পরই মা মারা যান। বাবা সেকালে সুদানে ব্রিটিশ প্রশাসনের শরিয়া আদালতের একজন বিচারক ছিলেন। আপসকামী মনোভাবের না হওয়ার তাকে বারংবার কর্তৃপক্ষের বদলির কবলে পড়তে হয়। এর ফলে পরিবারের সঙ্গে তুরাবিকে নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতে হয়। লেখাপড়ার হাতেখড়িও হয় বাবার হাতেই। কোরআনের ভাষা যেন তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পারেন, তাই অল্প বয়সেই তার বাবা তাকে ইবনে মালিকের ‘আলফিয়া’ ও ‘লামিয়াত আফাল’ এর মতো দুটি আরবি ব্যাকরণগ্রন্থ মুখস্থ করান। ১৯৫০ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫৫ সালে আইনের উচ্চতর পড়াশোনার জন্য লন্ডনের কিংস কলেজে পাড়ি জমান এবং ১৯৫৭ সালে এখানকার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে প্যারিসের সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কনস্টিটিউশনাল ল’ বিষয়ে পিএইচডি করেন। তিনি একই সঙ্গে আরবি, ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং ছিলেন একজন হাফেজে কোরআন।

দেশে ফেরার পর মুসলিম ব্রাদারহুডের ছাত্র শাখা ‘ইসলামিক চার্টার ফ্রন্ট’ এর সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৬৫ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের চাপে পার্লামেন্টে সুদান কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে সাংবিধানিক সংকটের প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কাউন্সিল যে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে, তুরাবি ছিলেন তার অন্যতম। ১৯৬৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ‘জাফর নিমেরি’ সরকার ক্ষমতায় এলে দলের বহু সদস্যের সঙ্গে তিনি গ্রেপ্তার হন। তাকে ৬ বছরের কারাদ- ও ৩ বছর লিবিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালে নিমেরির মদদপুষ্ট ন্যাশনাল উম্মাহ পার্টির সঙ্গে ইসলামি চার্টার ফ্রন্টের ‘জাতীয় পুনর্মিলন’ অনুষ্ঠিত হলে তুরাবিসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান এবং নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন।

মুক্তি পেয়েই তিনি নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট (এনআইএফ) গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন। ক্ষমতায় আরোহণ করে নিমেরি সরকার শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৭৮ সালে তুরাবি সুপ্রিমকোর্টের এটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। ফলে সুদানে ইসলামি আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে তুরাবির সামনে বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ তৈরি হয় এবং একই সঙ্গে সুদানি সমাজে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠার ভিত্তিও রচিত হয়। তার জীবনীকাররা মনে করেন, ইসলামের ‘তাজদিদি’ ধারণা এ সময়েই তার ভেতর আসন করে নেয়। তিনি মনে করতে থাকেন, কোনো বিদেশি ব্যবস্থা থেকে ধার করে নয়, ইসলামের ভিতরকার শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করেই আধুনিক সময়ে ইসলামি আইনের প্রয়োগনীতি বের করা সম্ভব।

তিনি ‘তাজদিদ’ এর সংজ্ঞা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন ১৯৮০ সালে একটি কনফারেন্সে ‘ইসলামের মূলরীতিকে অক্ষুণ রেখে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সময়োপযোগী ব্যাখ্যা প্রদান করা। কারণ, শুধু এই পদ্ধতিতেই ইসলামের মূলসূত্র চিরকাল ‘জীবন্ত ও কার্যকর’ ব্যাখ্যা করা সম্ভব।’ তাজদিদের জন্য দুটি বিষয় প্রয়োজন ফিকহর পুনর্নির্মাণ ও শরিয়ার বাস্তবায়ন। ‘তাজদিদুল ফিকরিল ইসলামি’ (১৯৮২) গ্রন্থে তিনি লেখেন “মানব সমাজে ইতিহাসের পরিবর্তন অতিক্রম করা যায় না। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষকে কালিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে তাদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে চলতে হবে এবং এভাবেই সে সত্যিকারের ‘মোমিন’ হতে পারবে।” তার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল কোরআনের টেক্সটকে নাজিলের সময়ের সঙ্গে আটকে রাখা যায় না, তাহলে কালের অসঙ্গতির কারণে মানুষ কোরআন থেকে ‘ভুল মেসেজ’ নেবে এবং কোরআনকে ‘কালোত্তীর্ণ’ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না।

এরপর ১৯৮২ সালে তিনি প্রসিডেন্টের আইন ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হন। ১৯৮৫ সালে নিমেরি সরকারের পতন হলে ’৮৬ এর সংসদ নির্বাচনে তার দল অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে তুরাবির দলের বিরুদ্ধে একক প্রার্থী দাঁড় করায়। সুতরাং সঙ্গত কারণেই এনআইএফ জয় লাভ করতে ব্যর্থ হয়। যদিও তার দল কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিলে তিনি আইনমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। তবে এই নির্বাচনের সময় তিনি প্রথম লক্ষ করেন সমাজের নারীরা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, সমানাধিকারের দাবি তুলেছে এবং তারা কমিউনিস্টপন্থি দলে ভিড়ে যাচ্ছে। তুরাবি জোর দিয়ে বলেন ‘ইসলামে নারী ও পুরুষে কোনো মৌলিক তফাৎ নেই। ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা নিজ দায়িত্বে ইসলাম কবুল করেছেন। সমাজের মুক্ত অঙ্গন শুধু পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট নয়, এখানে লিঙ্গ-বিভাজন টানা চরম মূর্খতা। মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার প্রধান একজন নারীও হতে পারে। এমনকি অন্য যে-কোনো ধর্মের নারী হলেও সমস্যা নেই।’ এ বিষয়ে তিনি ‘ওমেন বিটুইন দ্য টিচিং অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড দ্য কাস্টমস অব সোসাইটি’ (১৯৭৩) শিরোনামে বিখ্যাত একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার বক্তব্য ও রচনা এতটা প্রভাব সৃষ্টি করে যে, অল্প দিনেই সুদানে নারীদের ভোটের হাওয়া ঘুরে যায় ইসলামি রাজনৈতিক দলের দিকে এবং ‘ইসলামি নারীবাদী’ চেতনাধারীরা মার্কসবাদীদের ছাড়িয়ে যায়।

১৯৮৯ সালে সুদানে ফের সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হলে এবং ওমর আল-বশিরের সরকার ক্ষমতায় এলে নেপথ্য নায়ক হিসেবে তুরাবিকেই ধারণা করা হয়। এ সময় তার দল সরকারে অংশগ্রহণ করে এবং তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিপত্তিগুলোও চাক্ষুষ করার সুযোগ লাভ করেন। ১৯৯১ সালে তিনি আরব-ইসলামিক পপুলার কংগ্রেস পার্টি গঠন করেন, যাতে ৪৫টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সংযুক্ত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর তুরাবি সুদান পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৮ সালে প্রণীত সুদানি সংবিধানে তুরাবির চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটে। তবে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ধারাবাহিক চাপে থাকা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার মতবিরোধ বাড়তে থাকে। ১৯৯৯ প্রেসিডেন্ট ওমর ট্যাঙ্ক পাঠান সংসদ ভেঙে দিতে এবং তুরাবিকে গ্রেপ্তার করতে। মুক্তির পরে ২০১০ সাল পর্যন্ত তাকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হলেও তার দলকে তিনি একটি শক্তিশালী বিরোধী দল প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। এ বছর নির্বাচনে তিনি তরুণদের আহ্বান জানান এবং নিজ দলের আবদুল্লাহ দেনহিয়েলকে প্রেসিডন্টে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেন।

সমসাময়িক সুদানি রাজনীতিবিদদের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক দিয়ে তুরাবি ছিলেন অনেক অগ্রসর। শেষ জীবনে নিজস্ব চিন্তাধারার কর্মী গঠনের দিকেই মনোযোগী ছিলেন বেশি। তার ‘ইসলামি আন্দোলনে পাওয়ার শেয়ারিং থিউরি’ বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামি আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হিসেবে দেখা দেয়। ‘কযায়াল ওয়াহদাতু ওয়াল হুররিয়া’ (১৯৮০), ‘তাজদিদুদ দীন (১৯৮৪), ‘মানহাজিয়াতুত তাশরি’ (১৯৮৭) ইত্যাদিসহ তিনি প্রায় ২০টি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন।

তুরাবির সবচেয়ে বড় সফলতা হলো, ইসলামি সংবিধানের ধারণা সুদানি রাজনীতির প্রধান এজেন্ডায় পরিণত করা। এর ফলে পার্লামেন্টের সংবিধান কমিটি ইসলামের নীতিকে সংবিধানের মূল উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে হয়তো ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়নি; কিন্তু সুদানের রাজনৈতিক লড়াইয়ে ইসলামের অবস্থানকে আর অস্বীকার করার উপায় থাকেনি।

২০১৬ সালের ৫ মার্চ পাখিডাকা সকালে তিনি খার্তুমের রয়েল কেয়ার হাসপাতালে কাফনমুড়ি দেন এবং মারা যান। তিনি পৃথিবীতে থেকেছেন দীর্ঘ ৮৪ বছর আর দিয়েছেন ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবন এবং অগণিত মৌলিক রচনা, মুগ্ধকর ভাষণ আর ভঙ্গুর সুদানের জন্য পপুলার কংগ্রেসের মতো একটি কল্যাণকামী রাজনৈতিক দল। মৃত্যুর কয়েকদিন পর জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জন ভল জাদলিয়া একটি ম্যাগাজিনে লিখেছেন তার রাজনৈতিক দল পপুলার কংগ্রেস পার্টিকে একবিংশ শতকের পোস্ট-ইসলামিজমের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।