ঢাকা , শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সমাজের ওপর নাস্তিকতার প্রভাব

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ নাস্তিকতার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে মানুষের চরিত্র ও নৈতিকতা এবং সামাজিক ব্যবস্থা। কেউ যদি মনে করে যে, পৃথিবীর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, পরকাল ও আখেরাত নেই, মৃত্যুর পর জীবনের কর্মকারে কোনো হিসাব দিতে হবে না, তবে সে যা খুশি তা-ই করতে পারবে। যে কোনো পাপকাজ করতে পারবে, যে কোনো অপরাধ ঘটাতে পারবে। বিবেক থেকে সে কোনো বাধা পাবে না; তার নৈতিকতাবোধও কাজ করবে না। শুধু রাষ্ট্রীয় আইন এবং সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া পৃথিবীর কোনোকিছুই তাকে পাপ ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখতে পারবে না। এমন মানুষের জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য হলো ধনদৌলত ও ভোগবিলাস, বড়জোর খ্যাতি ও প্রতিপত্তি।

কেউ যদি মনে করে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করবে না তাহলে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে টাকা ছিনতাইয়ে তার সামনে বাধা কোথায়? অপরহরণ, ধর্ষণ ও হত্যা, খুন-রাহাজানি, এসিড ছুড়ে মুখ-হাত-পা ঝলসে দেওয়া, কারো শ্লীলতাহানি ও সম্ভ্রম ছিনিয়ে ইত্যাকার যাবতীয় অপরাধ করে বেড়ালেও তার সামনে কোনোকিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ সে বিবেক থেকে কোনো বাধা পায় না। এতিমের মাল আত্মসাৎ, দরিদ্রের প্রতি অত্যাচার, অধীন লোকদের ওপর জুলুম ও অবিচার থেকে তাকে কেউ বিরত রাখতে পারবে না। কারণ রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে সবসময় পাহারা দিয়ে রাখবে না। মিথ্যা বলে স্বার্থ উদ্ধার, জালিয়াতি ও চালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লুণ্ঠন, আত্মীয়কে হত্যা করে সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া, যৌতুকের জন্য স্ত্রীর ওপর অত্যাচার, মা-বাবার প্রতি অসদাচরণ, ছোটদের প্রতি নির্মম আচরণ এবং বড়দের প্রতি অশ্রদ্ধা থেকে তাকে কেউ নিবৃত্ত করতে পারবে না, যেহেতু পরকালের প্রতি তার বিশ্বাস নেই।

খাদ্যে ও ওষুধে ভেজাল ও বিষ মিশ্রিত করা, তাতে কারও মৃত্যু হয় হোক; ওজনে কম দেওয়া, তাতে কারও ক্ষতি হয় হোক, বেশি মুনাফার জন্য পণ্য দীর্ঘদিন গুদামজাত করে রাখা, তাতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠলে উঠুক এসব ব্যাপার কে পরোয়া করে যদি নৈতিকভাবে তার সামনে কোনো বাধা না থাকে? দুর্নীতি করা, ঘুষ গ্রহণ করা, স্বেচ্ছচারিতার সঙ্গে সুদ খাওয়া, ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা, জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করা, অসৎ উপায়ে ব্যবসা করে মানুষের গলা কাটা আল্লাহ ও আখেরাতে যার বিশ্বাস নেই তাকে এসব কার্যকলাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কোনো দাওয়াই নেই। সামাজিক প্রতিরোধের সীমাবদ্ধতা আছে এবং রাষ্ট্রীয় আইনের ফাঁকফোকর আছে। যার কিছুটা প্রভাব আছে, প্রতিপ্রত্তি আছে, বিবেক ও বিশ্বাসের বাধা না থাকলে সে যে-কোনো ধরনের অপরাধ ঘটাতে পারে।

আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসহীন মানুষ যেমন যে-কোনো মন্দ কাজ ও অপরাধ করতে পারে, তেমনি সৎকাজ ও কল্যাণমূলক কর্মকা-অংশগ্রহণের বেলায়ও তাদের সামনে অনুপ্রেরণা দানকারী কিছু নেই। কারও গাড়ির নিচে চাপা পড়ে একজন পথচারী থেঁতলে গেল, গাড়িচালক তাকে উঠিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার কষ্টটুকুও করবে না, কারণ এতে তার কোনো লাভ নেই। কোনো বৃদ্ধ নর্দমায় পড়ে গেলে সে তাকে তুলবে না। কারণ এ-ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় আইন নেই, সামাজিক বাধ্যবাধকতা নেই। অসুস্থ ও মুখাপেক্ষীদের সাহায্যে সে এগিয়ে আসবে না। কেন সে অপরের জন্য তার টাকা-পয়সা খরচ করবে? এতিম, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদের জন্য তার অর্থ ব্যয়িত হবে না। কারণ সে জানে এতে তার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কোনো অর্জন নেই। মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণেও সে এগিয়ে আসবে না। কারণ এতে তার দৃশ্যমান মুনাফা নেই।

যেসব ঘটনার উদাহরণ পেশ করা হলো এগুলো আমরা প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় দেখে থাকি। মনে হয় আমরা হিংস্র শ্বাপদসংকুল জনপদে বসবাস করি। যেখানে মানুষ ও মুসলমান হওয়া শুধু একটি লেবেলের কাজ করে। এর বেশি কিছু নয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, তৃতীয় বিশ্বের সব দেশেই অসংখ্য জায়গায় অহরহ এসব ঘটনা ঘটছে। আমরা আগেই বলেছি মুসলিম বিশ্বে নাস্তিকতা তার শেকড় বিস্তার করেছে। মুসলমানরা যে তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে বসেছে তা নয়; কিন্তু দৈনন্দিন কর্মকা-ের এসব বিশ্বাসের যথার্থ প্রতিফলন ঘটে না। সবাই তাদের বিশ্বাস ও আদর্শের দাবি থেকে উদাসীন। সৃষ্টিকর্তা আছেন কি নেই, তিনি নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন কি করেননি, আখেরাতে পুনরুত্থান ঘটবে কি ঘটবে না, ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি পাওয়া যাবে কি যাবে না এসব ব্যাপারে কোনো পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করছে যে আমাদের মন-মানসিকতায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে নাস্তিকতার প্রভাব কতটা গভীর।

বাস্তবিক সত্য এই যে, পৃথিবীর কোনো দেশেই রাষ্ট্রীয় আইন মানুষকে অপরাধমূলক কর্মকা-থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। গুটিকয় অপরাধপ্রবণ মানুষ হয়তো আইনের কারণে অপরাধ ঘটানো থেকে বিরত থাকে; কিন্তু অধিকাংশ অপরাধীই আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যায়। জনাথন সুফইটের কথা এখানে স্মরণযোগ্য ‘আইন হলো মাকড়সার জালের মতো, ক্ষুদ্র মশা-মাছি তাতে আটকে যায়; কিন্তু বোলতা ও ভিমরুল তা ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়।’ অথবা ‘আইন হলো মাকড়সার জালের মতো; ছোট কীটপতঙ্গ আটকে ফেললে বড় কিছুকে আটকাতে পারে না।’
আইনের জালে আটকে যাওয়ার ভয় থাকলেও অনেক অপরাধীই এই ভয়কে আমলে আনে না। একদিন তারা কোনো মারপ্যাঁচের জোরে অপরাধের শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে এমন ধারণা পোষণ করে।

তা ছাড়া কোনো অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে অনেক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শুধু প্রকাশ্যে অপরাধ সংঘটিত হলেই তা সম্ভব হয়। তেমনি সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধের দ্বারা শুধু সেসব অপরাধীকেই দমন করা সম্ভব যাদের অপরাধ মানুষের চোখে পড়ে এবং যারা সমাজে প্রভাবশালী নয়। প্রভাবশালী ব্যক্তির অপরাধের বিরুদ্ধে সমাজ উচ্চকিত হয় খুব কম। একই অপরাধ শক্তিশালী ও দুর্বল দ্বারা সংঘটিত হলে তাদের সমাজের মানুষের প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্নরকম। সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধের দ্বারা যেসব অপরাধের নিবৃত্তি ঘটে তার সংখ্যা খুবই নগণ্য; শতকরা ১০০ ভাগের ৫ ভাগ।

যে-বিষয়টি অপরাধ ও পাপাচার দমাতে ও নির্মূল করতে পারে তা হলো নৈতিকতাবোধ এবং চারিত্রিক পরিশুদ্ধতার অনুভূতি। এই বোধ ও অনুভূতি শুধু সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা ও তার সামনে জবাবদিহির বিশ্বাস থেকেই জন্মাতে পারে। কিন্তু নাস্তিকতার দ্বারা প্রভাবিত সমাজ ও মানবম-লীর মধ্যে এমন বোধ ও অনুভূতি কীভাবে জন্ম নেবে? এটা নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ব্যাপারটা এমন নয় যে, পৃথিবীর নাস্তিক্যবাদী চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা নৈতিকতাবোধ ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধতার অনুভূতি ও বিবেককে অস্বীকার করেন। বরং তারা নিজেদের নৈতিকতা ও মানবাধিকারের ঝান্ডাবাহীরূপে উপস্থাপিত করেন। তারা উল্লিখিত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা আখেরাতের ভালো কাজের পুরস্কার এবং পাপকাজের শাস্তির চিন্তার বিপরীতে একটি প্রতিচিন্তা দাঁড় করিয়েছেন। তারা বলেছেন, একজন মানুষের ওপর অপর মানুষ জুলুম, অন্যায়, অত্যাচার করবে না এই আশঙ্কায় যে, ওই লোকটা তার ওপর জুলুম করতে পারে বা প্রতিশোধ নিতে পারে। অর্থাৎ, মানুষ অপরের দুরাচার থেকে বাঁচার জন্য নিজে দুরাচার করবে না।

নৈতিকতার এই মানদ-কে মেনে নেওয়া হলেও তা শুধু ওই ক্ষেত্রেই সম্ভব হবে যখন উভয় পক্ষ সমান শক্তি ও সমান ক্ষমতার অধিকারী হবে। কিন্তু একজন শক্তিমান বা ক্ষমতাবান যদি তার চেয়ে দুর্বলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা তার ওপর জুলুম ও অত্যাচার করে তাহলে এখানে প্রতিশোধের বা বদলা নেওয়ার ভয় থাকে না। নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারা যখন পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বেরিয়ে এসে প্রাচ্যের দেশগুলোতে তার ডানা বিস্তৃত করল, সমাজের এলিট ও অভিজাত শ্রেণির লোকেরা তার ছায়ায় আশ্রয় নিল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, এই এলিট ও অভিজাত শ্রেণির কোনো চারিত্রিক ভিত্তি ছিল না, নৈতিক মানদ- ছিল না। এই শ্রেণি ও তাদের অনুসারী সাধারণ জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন কর্মকা-ের ক্ষেত্রে নাস্তিক্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং এর কুপ্রভাবের শিকার হলো।

ফলে তারা যাবতীয় নৈতিক ও চারিত্রিক সীমা লঙ্ঘন করল এবং প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার অংজস্র ঘটনার জন্ম দিল। প্রতিদিনই সংবাদপত্রে খুনখারাবি, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, ছিনতাই, প্রতারণা, দুর্নীতির সংবাদ আসছে। যাদের অন্তরে সত্যিকার অর্থেই তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতের বিশ্বাস রয়েছে তারা নির্ভয়ে ও নিঃসংশয়ে এসব ঘটনা ঘটাতে পারে না। বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমা দেশগুলোর যেসব নৈতিক অধঃপতনমূলক কর্মকা-আমরা গর্হিত ও ঘৃণিত মনে করতাম, সেগুলো বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। নেশা ও মাদক, মদ্যপান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বিবাহবহির্ভূত যৌনতা চর্চা, পর্নোগ্রাফি আসক্তি, পশ্চিমা কৃষ্টি-কালচারের প্রতি লজ্জাজনক অনুরাগ ইত্যাদি নৈতিক অধঃপতন আমাদের সমাজে গতি লাভ করেছে। আগে যে এসব ছিল না তা নয়; কিন্তু বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে এসব কর্মকা- ব্যাপক হয়ে পড়েছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

সমাজের ওপর নাস্তিকতার প্রভাব

আপডেট টাইম : ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ নাস্তিকতার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে মানুষের চরিত্র ও নৈতিকতা এবং সামাজিক ব্যবস্থা। কেউ যদি মনে করে যে, পৃথিবীর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, পরকাল ও আখেরাত নেই, মৃত্যুর পর জীবনের কর্মকারে কোনো হিসাব দিতে হবে না, তবে সে যা খুশি তা-ই করতে পারবে। যে কোনো পাপকাজ করতে পারবে, যে কোনো অপরাধ ঘটাতে পারবে। বিবেক থেকে সে কোনো বাধা পাবে না; তার নৈতিকতাবোধও কাজ করবে না। শুধু রাষ্ট্রীয় আইন এবং সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া পৃথিবীর কোনোকিছুই তাকে পাপ ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখতে পারবে না। এমন মানুষের জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য হলো ধনদৌলত ও ভোগবিলাস, বড়জোর খ্যাতি ও প্রতিপত্তি।

কেউ যদি মনে করে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করবে না তাহলে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে টাকা ছিনতাইয়ে তার সামনে বাধা কোথায়? অপরহরণ, ধর্ষণ ও হত্যা, খুন-রাহাজানি, এসিড ছুড়ে মুখ-হাত-পা ঝলসে দেওয়া, কারো শ্লীলতাহানি ও সম্ভ্রম ছিনিয়ে ইত্যাকার যাবতীয় অপরাধ করে বেড়ালেও তার সামনে কোনোকিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ সে বিবেক থেকে কোনো বাধা পায় না। এতিমের মাল আত্মসাৎ, দরিদ্রের প্রতি অত্যাচার, অধীন লোকদের ওপর জুলুম ও অবিচার থেকে তাকে কেউ বিরত রাখতে পারবে না। কারণ রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে সবসময় পাহারা দিয়ে রাখবে না। মিথ্যা বলে স্বার্থ উদ্ধার, জালিয়াতি ও চালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লুণ্ঠন, আত্মীয়কে হত্যা করে সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া, যৌতুকের জন্য স্ত্রীর ওপর অত্যাচার, মা-বাবার প্রতি অসদাচরণ, ছোটদের প্রতি নির্মম আচরণ এবং বড়দের প্রতি অশ্রদ্ধা থেকে তাকে কেউ নিবৃত্ত করতে পারবে না, যেহেতু পরকালের প্রতি তার বিশ্বাস নেই।

খাদ্যে ও ওষুধে ভেজাল ও বিষ মিশ্রিত করা, তাতে কারও মৃত্যু হয় হোক; ওজনে কম দেওয়া, তাতে কারও ক্ষতি হয় হোক, বেশি মুনাফার জন্য পণ্য দীর্ঘদিন গুদামজাত করে রাখা, তাতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠলে উঠুক এসব ব্যাপার কে পরোয়া করে যদি নৈতিকভাবে তার সামনে কোনো বাধা না থাকে? দুর্নীতি করা, ঘুষ গ্রহণ করা, স্বেচ্ছচারিতার সঙ্গে সুদ খাওয়া, ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা, জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করা, অসৎ উপায়ে ব্যবসা করে মানুষের গলা কাটা আল্লাহ ও আখেরাতে যার বিশ্বাস নেই তাকে এসব কার্যকলাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কোনো দাওয়াই নেই। সামাজিক প্রতিরোধের সীমাবদ্ধতা আছে এবং রাষ্ট্রীয় আইনের ফাঁকফোকর আছে। যার কিছুটা প্রভাব আছে, প্রতিপ্রত্তি আছে, বিবেক ও বিশ্বাসের বাধা না থাকলে সে যে-কোনো ধরনের অপরাধ ঘটাতে পারে।

আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসহীন মানুষ যেমন যে-কোনো মন্দ কাজ ও অপরাধ করতে পারে, তেমনি সৎকাজ ও কল্যাণমূলক কর্মকা-অংশগ্রহণের বেলায়ও তাদের সামনে অনুপ্রেরণা দানকারী কিছু নেই। কারও গাড়ির নিচে চাপা পড়ে একজন পথচারী থেঁতলে গেল, গাড়িচালক তাকে উঠিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার কষ্টটুকুও করবে না, কারণ এতে তার কোনো লাভ নেই। কোনো বৃদ্ধ নর্দমায় পড়ে গেলে সে তাকে তুলবে না। কারণ এ-ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় আইন নেই, সামাজিক বাধ্যবাধকতা নেই। অসুস্থ ও মুখাপেক্ষীদের সাহায্যে সে এগিয়ে আসবে না। কেন সে অপরের জন্য তার টাকা-পয়সা খরচ করবে? এতিম, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদের জন্য তার অর্থ ব্যয়িত হবে না। কারণ সে জানে এতে তার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কোনো অর্জন নেই। মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণেও সে এগিয়ে আসবে না। কারণ এতে তার দৃশ্যমান মুনাফা নেই।

যেসব ঘটনার উদাহরণ পেশ করা হলো এগুলো আমরা প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় দেখে থাকি। মনে হয় আমরা হিংস্র শ্বাপদসংকুল জনপদে বসবাস করি। যেখানে মানুষ ও মুসলমান হওয়া শুধু একটি লেবেলের কাজ করে। এর বেশি কিছু নয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, তৃতীয় বিশ্বের সব দেশেই অসংখ্য জায়গায় অহরহ এসব ঘটনা ঘটছে। আমরা আগেই বলেছি মুসলিম বিশ্বে নাস্তিকতা তার শেকড় বিস্তার করেছে। মুসলমানরা যে তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে বসেছে তা নয়; কিন্তু দৈনন্দিন কর্মকা-ের এসব বিশ্বাসের যথার্থ প্রতিফলন ঘটে না। সবাই তাদের বিশ্বাস ও আদর্শের দাবি থেকে উদাসীন। সৃষ্টিকর্তা আছেন কি নেই, তিনি নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন কি করেননি, আখেরাতে পুনরুত্থান ঘটবে কি ঘটবে না, ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি পাওয়া যাবে কি যাবে না এসব ব্যাপারে কোনো পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করছে যে আমাদের মন-মানসিকতায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে নাস্তিকতার প্রভাব কতটা গভীর।

বাস্তবিক সত্য এই যে, পৃথিবীর কোনো দেশেই রাষ্ট্রীয় আইন মানুষকে অপরাধমূলক কর্মকা-থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। গুটিকয় অপরাধপ্রবণ মানুষ হয়তো আইনের কারণে অপরাধ ঘটানো থেকে বিরত থাকে; কিন্তু অধিকাংশ অপরাধীই আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যায়। জনাথন সুফইটের কথা এখানে স্মরণযোগ্য ‘আইন হলো মাকড়সার জালের মতো, ক্ষুদ্র মশা-মাছি তাতে আটকে যায়; কিন্তু বোলতা ও ভিমরুল তা ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়।’ অথবা ‘আইন হলো মাকড়সার জালের মতো; ছোট কীটপতঙ্গ আটকে ফেললে বড় কিছুকে আটকাতে পারে না।’
আইনের জালে আটকে যাওয়ার ভয় থাকলেও অনেক অপরাধীই এই ভয়কে আমলে আনে না। একদিন তারা কোনো মারপ্যাঁচের জোরে অপরাধের শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে এমন ধারণা পোষণ করে।

তা ছাড়া কোনো অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে অনেক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শুধু প্রকাশ্যে অপরাধ সংঘটিত হলেই তা সম্ভব হয়। তেমনি সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধের দ্বারা শুধু সেসব অপরাধীকেই দমন করা সম্ভব যাদের অপরাধ মানুষের চোখে পড়ে এবং যারা সমাজে প্রভাবশালী নয়। প্রভাবশালী ব্যক্তির অপরাধের বিরুদ্ধে সমাজ উচ্চকিত হয় খুব কম। একই অপরাধ শক্তিশালী ও দুর্বল দ্বারা সংঘটিত হলে তাদের সমাজের মানুষের প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্নরকম। সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধের দ্বারা যেসব অপরাধের নিবৃত্তি ঘটে তার সংখ্যা খুবই নগণ্য; শতকরা ১০০ ভাগের ৫ ভাগ।

যে-বিষয়টি অপরাধ ও পাপাচার দমাতে ও নির্মূল করতে পারে তা হলো নৈতিকতাবোধ এবং চারিত্রিক পরিশুদ্ধতার অনুভূতি। এই বোধ ও অনুভূতি শুধু সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা ও তার সামনে জবাবদিহির বিশ্বাস থেকেই জন্মাতে পারে। কিন্তু নাস্তিকতার দ্বারা প্রভাবিত সমাজ ও মানবম-লীর মধ্যে এমন বোধ ও অনুভূতি কীভাবে জন্ম নেবে? এটা নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ব্যাপারটা এমন নয় যে, পৃথিবীর নাস্তিক্যবাদী চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা নৈতিকতাবোধ ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধতার অনুভূতি ও বিবেককে অস্বীকার করেন। বরং তারা নিজেদের নৈতিকতা ও মানবাধিকারের ঝান্ডাবাহীরূপে উপস্থাপিত করেন। তারা উল্লিখিত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা আখেরাতের ভালো কাজের পুরস্কার এবং পাপকাজের শাস্তির চিন্তার বিপরীতে একটি প্রতিচিন্তা দাঁড় করিয়েছেন। তারা বলেছেন, একজন মানুষের ওপর অপর মানুষ জুলুম, অন্যায়, অত্যাচার করবে না এই আশঙ্কায় যে, ওই লোকটা তার ওপর জুলুম করতে পারে বা প্রতিশোধ নিতে পারে। অর্থাৎ, মানুষ অপরের দুরাচার থেকে বাঁচার জন্য নিজে দুরাচার করবে না।

নৈতিকতার এই মানদ-কে মেনে নেওয়া হলেও তা শুধু ওই ক্ষেত্রেই সম্ভব হবে যখন উভয় পক্ষ সমান শক্তি ও সমান ক্ষমতার অধিকারী হবে। কিন্তু একজন শক্তিমান বা ক্ষমতাবান যদি তার চেয়ে দুর্বলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা তার ওপর জুলুম ও অত্যাচার করে তাহলে এখানে প্রতিশোধের বা বদলা নেওয়ার ভয় থাকে না। নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারা যখন পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বেরিয়ে এসে প্রাচ্যের দেশগুলোতে তার ডানা বিস্তৃত করল, সমাজের এলিট ও অভিজাত শ্রেণির লোকেরা তার ছায়ায় আশ্রয় নিল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, এই এলিট ও অভিজাত শ্রেণির কোনো চারিত্রিক ভিত্তি ছিল না, নৈতিক মানদ- ছিল না। এই শ্রেণি ও তাদের অনুসারী সাধারণ জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন কর্মকা-ের ক্ষেত্রে নাস্তিক্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং এর কুপ্রভাবের শিকার হলো।

ফলে তারা যাবতীয় নৈতিক ও চারিত্রিক সীমা লঙ্ঘন করল এবং প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার অংজস্র ঘটনার জন্ম দিল। প্রতিদিনই সংবাদপত্রে খুনখারাবি, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, ছিনতাই, প্রতারণা, দুর্নীতির সংবাদ আসছে। যাদের অন্তরে সত্যিকার অর্থেই তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতের বিশ্বাস রয়েছে তারা নির্ভয়ে ও নিঃসংশয়ে এসব ঘটনা ঘটাতে পারে না। বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমা দেশগুলোর যেসব নৈতিক অধঃপতনমূলক কর্মকা-আমরা গর্হিত ও ঘৃণিত মনে করতাম, সেগুলো বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। নেশা ও মাদক, মদ্যপান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বিবাহবহির্ভূত যৌনতা চর্চা, পর্নোগ্রাফি আসক্তি, পশ্চিমা কৃষ্টি-কালচারের প্রতি লজ্জাজনক অনুরাগ ইত্যাদি নৈতিক অধঃপতন আমাদের সমাজে গতি লাভ করেছে। আগে যে এসব ছিল না তা নয়; কিন্তু বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে এসব কর্মকা- ব্যাপক হয়ে পড়েছে।