একাত্তরের মার্চের কথা মনে হলেই আমি একান্ত স্মৃতিতাড়িত হয়ে উঠি। আমি মফস্বলের মানুষ। মফস্বল অর্থাত্ ময়মনসিংহ শহর থেকে আমি যেভাবে সেই মার্চ প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলাম। সে কথাটুকুই শুধু বলছি।
সে বছর ফেব্রুয়ারি থেকেই আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল বলা যেতে পারে। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পেশওয়ারে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান যে, তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ঢাকায় যাবেন না। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতারা তার সঙ্গে একমত হননি। তারা অনেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। তাকে সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন। এমনকি স্বয়ং ইয়াহিয়া খানও শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ‘ভাবি’ প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সবই ওলট-পালট হয়ে গেল মার্চের প্রথম দিনে। সেদিন দুপুরে রেডিও পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়ার সংক্রান্ত ইয়াহিয়া খানের বিবৃতিটি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছিল— সে খবর পত্রিকার পাতায় পড়েছি। নিজ চোখে দেখেনি। তবে এ খবর ময়মনসিংহ শহরে এসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে যে স্বতঃস্ফূর্ত জঙ্গি মিছিলগুলো রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেগুলো দেখেছি। ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের নেতা রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া টাউন হলের সামনে যখন নিজের হাতে আগুন ধরিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাটি পুড়িয়ে ফেললেন, তখন এর প্রতীকী তাত্পর্য অনেক বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। পাকিস্তানবাদী দক্ষিণপন্থি দলগুলো তখন একেবারেই কোণঠাসা। ওরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার কথাটি খুব জোরেসোরে বলতে পারছিল না, কারণ তা বললে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার হিম্মত সেই সময় কারো ছিল না। তাই দক্ষিণপন্থি নেতারা শেখ মুজিবের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য ভুট্টোকে অনুরোধ জানিয়ে চলছিলেন।
কিন্তু মার্চের প্রথম দিন থেকেই জনসমুদ্রে জাগলো বাঁধভাঙা জোয়ার। রাজনৈতিক দলের আদেশ-নির্দেশের জন্য জনগণ বসে থাকতে রাজি নয়। সকল রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীকে অনেক পেছনে ফেলে জনতার মিছিল অনেক সামনে এগিয়ে এসেছে। পাকিস্তানের নাম-নিশানা মুছে না যাওয়া পর্যন্ত এ মিছিল থামবে না। ছয় দফা এখন অতীতের ব্যাপার। এখন শুধু একটাই লক্ষ্য— স্বাধীন বাংলাদেশ। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।