ঢাকা , বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও আজকের করুণ পদ্মা

‘নৌকা চলে পদ্মায়। পদ্মা তো কখনো শুকায় না। কবে এ নদীর সৃষ্টি হইয়াছে কে জানে। সমুদ্রগামী জলপ্রবাহের আজও মুহূর্তের বিরাম নাই। গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনো দিন দ্যাখে নাই, চিরকাল গোপন হইয়া আছে। ’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে এ কথাগুলো লিখেছেন।

উপন্যাসে বিধৃত পদ্মার রূপ এখন আর বর্তমান নেই। এখনকার পদ্মা নদীর ওপর আন্তরাষ্ট্রীয় দখলদারিত্ব রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে প্রবহমানতার মধ্যে মনুষ্যসৃষ্ট ছেদ নদীর প্রকৃত রূপ নষ্ট করে দিয়েছে। নদীর প্রাণ জল। সেই জল নিয়ে আছে ভাগাভাগি। ভারত উজানের দেশ হওয়ার কারণে পদ্মার ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে পদ্মার যে বুক কেউ কোনো দিন দেখেনি বলে লেখক উল্লেখ করেছেন, সেই বুকই এখন দৃশ্যমান হয়ে থাকে। জলহীন পদ্মার বুকে বছরের অর্ধেক সময়জুড়ে শুধু বালু আর বালু। পদ্মার যৌবন এখন রুপালি চরে ঢাকা।

আশ্বিন-কার্তিক মাসে আগে পানি কমে যেত। সেই পানি কমে যাওয়ার পরও শুষ্ক মৌসুমে জলরাশির প্রস্থরূপ ছিল তিন মাইল। লেখকের ভাষায়—‘তখন আশ্বিন মাস, সেখানে পদ্মার এ তীর ও তীরের ব্যবধান তিন মাইলের কম নয়। ’ শুষ্ক মৌসুমে সেই জলরাশি এখন আর নেই। সভ্যতা-মানবতা-মানবিকতা সব কিছুই আজ তুচ্ছ, অতি গৌণ। ভারতের অংশে জল আছে। তারা জল আটকে রেখেছে। ভারতের সঙ্গে পদ্মার জল নিয়ে বাংলাদেশের একটি চুক্তি থাকলেও তা কাগুজে। নদীখেকো জাতিতে পরিণত হচ্ছে অনেকেই। সর্বগ্রাসী মানুষ যখন থেকে নদীর বুকে গ্রাস বসিয়েছে, তখন থেকে প্রকৃতিও তার চরিত্র বদলিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ অংশের পদ্মা অববাহিকা মরুকরণের পথে হাঁটছে।

পদ্মা নদীর সমাজচিত্র এখন ইতিহাসের অংশ। সময়-সমাজই শিল্প-সাহিত্যের প্রতিচ্ছবি। আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের বহুকৌণিক বিশ্লেষণ করে থাকি। সমাজচিত্র তার মধ্যে অন্যতম বিশ্লেষণ। চর্যাপদ একই সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ, একই সঙ্গে সমাজচিত্রও বটে। ফলে প্রাচীন ভাষা-দর্শন-সমাজ সব কিছুর জন্যই আমরা একবার ফিরে তাকাই চর্যাপদের দিকে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনসহ মধ্যযুগের সাহিত্যে আমরা অতীতের সন্ধান করে থাকি। পদ্মা নদীর মাঝিতেও আমরা যে জীবন পাই তাও আমাদের ইতিহাস পাঠের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে।

একটি নদী মানে শুধু একটি জলপ্রবাহ মাত্র নয়। একটি নদীই গড়ে তোলে একটি সভ্যতা। নদীকে ঘিরেই একেক সময়ে সংস্কৃতির ধরন সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের বড় বড় শহর কোনো না কোনো নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে আমরা একটি জেলেপাড়া পাই। সেই জেলেপাড়া এখন আর কোথাও বিদ্যমান নেই। নৌকানির্ভর জীবন ছিল একসময়। তাও এখন ইতিহাসের পাঠ মাত্র। উপন্যাসজুড়ে কুবের, কপিলা, গণেশ, ধনঞ্জয়, হোসেন মিয়া, আমিনুদ্দি, মালা, রাসু সবাই পদ্মার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। নিকট-দূরের যাতায়াত নদীপথে। জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন বলতে পদ্মা ও পদ্মার খাল। স্বপ্ন-সম্ভাবনা সব কিছুই নদীকে ঘিরে। সব চরিত্রের ঘূর্ণাবর্তের সঙ্গে নদীর যোগ আছে বরাবরই। ঔপন্যাসিকের ভাষায়—‘পদ্মা ও পদ্মার খালগুলি ইহাদের অধিকাংশের উপজীবিকা। কেহ মাছ ধরে, কেহ মাঝিগিরি করে। কুবেরের মতো কেহ জাল ফেলিয়া বেড়ায় খাস পদ্মার বুকে, কুঁড়ো জাল লইয়া কেহ খালে দিন কাটায়। নৌকার যাহারা মাঝি, যাত্রী লইয়া মাল বোঝাই দিয়া পদ্মায় তাহারা সুদীর্ঘ পাড়ি জমায়, এ গাঁয়ের মানুষকে ও গাঁয়ে পৌঁছাইয়া দেয়। ’

উপন্যাসের যে চরিত্রটি সব চরিত্রের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত, সে কুবের। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মাপারের এক জেলেপল্লী কেতুপুরের কুবেরকেই প্রধান চরিত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। সমাজের অন্ত্যজশ্রেণির চরিত্র নিয়ে উপন্যাস বাঁধার চেষ্টা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহসিকতার পরিচায়ক। কুবের জেলে ও মাঝি। পদ্মায় ইলিশ ধরে বর্ষার মৌসুমে। তার স্ত্রী মালা। হাঁটতে পারে না। প্রতিবন্ধী স্ত্রীর ছোট বোন কপিলা। কপিলার সঙ্গে মনোদৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রেমের টানে কপিলার স্বামী শ্যামাদাসের বাড়ি গিয়েছিল কপিলাকে দেখতে। সেখানে গিয়ে কুবের জ্বরে আক্রান্ত হয়। প্রেমিকাকে দেখতে গিয়ে অসুস্থ হলেও তার মন-প্রাণ পড়ে থাকে পদ্মার জন্য। সুস্থ হয়ে তারপর যাওয়ার জন্য কুবেরকে অনুরোধ করে কপিলা। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে—‘পদ্মা নদীর কূল ছাড়িয়া দশ মাইল তফাতে চলিয়া আসিয়াছে সে, মন কেমন করিতেছে তার। পদ্মার বাতাস গায়ে না লাগিলে, কেতুপুরের মেছো গন্ধ না শুঁকিলে, সে সুস্থ হইবে না। ’ পদ্মার সঙ্গে কুবেরের যে প্রেম, তা যেন কপিলার প্রেমকেও হার মানায়।

সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’ গল্পে একটি পুরনো মোটরগাড়ি জগদ্দলের সঙ্গে গল্পের নায়কের প্রেম আমরা দেখেছি। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পে মহেশের সঙ্গে গফুরের প্রেম দেখেছি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নারী ও নাগিনী’ গল্পে খোঁড়া শেখের সঙ্গে সাপের সম্পর্ক দেখেছি, দেখেছি পরশুরামের লম্বকর্ণ গল্পে একটি ছাগলের সঙ্গে গল্পের নায়কের মিতালি। আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে আমরা দেখি পদ্মার সঙ্গে কুবেরের প্রেম।

উপন্যাসের শুরুতেই পদ্মায় ইলিশ ধরার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আমরা আখ্যানভাগে প্রবেশ করি। প্রবেশপূর্বক পূর্ণ সময় পদ্মায় যেন অবগাহন। শেষ দৃশ্যেও কুবের জলপথে ময়নাদ্বীপে যাত্রা করে। পদ্মায় কাহিনির অবতারণা, পদ্মাতেই কাহিনির সমাপ্তি। পদ্মাময় এক আখ্যান ‘পদ্মা নদীর মাঝি’।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপন্যাসটিতে তাঁর দুটি চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। একটি হচ্ছে তাঁর মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যটি লিবিডো। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ময়নাদ্বীপ প্রতীকী অর্থে এক অর্থপূর্ণ সৃষ্টি। ময়নাদ্বীপে কোনো মসজিদ-মন্দির নেই। যাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের এক উন্নত স্বপ্ন দেখানো হয়। কেউ যাওয়ার পর পালিয়ে এলেও তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন হোসেন মিয়া। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্রয়েডিয়ের দর্শন প্রয়োগ করেছেন কুবের-কপিলার মধ্যে।

মালা শারীরিক প্রতিবন্ধী। অন্যদিকে চপল-চঞ্চল কপিলা। কপিলাকে তার স্বামী অনেক দিন সঙ্গে রাখেনি। আরেকটি বিয়ে করেছিল। দ্বিতীয়  স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্ত্রীকে নিয়ে গেছে। মধ্যবর্তী সময়টির অনেকাংশ সে ছিল বড় বোন মালার বাড়িতে। প্রতিবন্ধী মালার স্বামী কুবেরের সঙ্গে তাই তার ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্কটিই যেন অনিবার্য ছিল। কপিলার নানা ছলাকলা কুবের যৎসামান্য বিরোধিতা করলেও সে তা উপভোগও করে। গোপীর পায়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে হোটেলে একসঙ্গে কুবের-কপিলার রাত্রি যাপন লেখকের পরিকল্পিত পথেরই বিনির্মাণ।

মার্ক্সবাদী দর্শনের আদলে সৃষ্ট ময়নাদ্বীপে কুবেরকে নেওয়ারও ব্যবস্থা করেছেন। কুবের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তার বাড়িতে পুলিশ এসেছে। কপিলা সারা রাত জেগে পদ্মার পারে দাঁড়িয়েছিল। জেলভয়ে কুবের ময়নাদ্বীপে যেতে আপত্তি করেনি। যাওয়ার সময় নৌকার ছইয়ের নিচে কুবেরের কাছে গিয়ে কপিলা বলে, ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ উপন্যাসের শেষ বাক্য—‘হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। একা অত দূরে কুবের পাড়ি দিতে পারিবে না। ’ কপিলার প্রশ্নের উত্তর কুবের দেয়নি। আবার অন্য কেউ যখন কুবেরের সঙ্গে কপিলার যাওয়ার কথা বলে, তার কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই উপন্যাসটি শেষ হয়। পাঠকের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে দুটি চরিত্রকে ফ্রয়েডীয় দর্শনের ওপর দাঁড় করিয়েছেন, সে চরিত্র দুটিকেই আবার নিয়ে গেলেন ময়নাদ্বীপে। যেখানে একই সঙ্গে লেখকের দুটি দর্শনের প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মা নদীকে প্রধান উপজীব্য করে উপন্যাস রচনা করেননি। পদ্মা নদীর মাঝিকে নির্বাচন করেছেন তাঁর উপন্যাসের জন্য। কিন্তু যে ক্যানভাসের ওপর রংতুলির আঁচড়ে শিল্পকর্মটি পূর্ণতা পেয়েছে, সেটি পদ্মা। একটি নদী। সেই নদীর জীবনকাল পরম্পরায় হুমকির মুখে। কথাশিল্পীর সৃষ্টিতে বেঁচে থাকা নদীচিত্রই আমাদের কাম্য। পদ্মার জলকথনে আবার ভরে উঠুক সন্ধ্যার পদ্মা। সারা বছর ঢাকা থাকুক পদ্মার রুপালি বুক। পদ্মার নদীচরিত্র বজায় রেখে গড়ে উঠুক আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিমণ্ডল।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও আজকের করুণ পদ্মা

আপডেট টাইম : ১১:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ মে ২০১৭

‘নৌকা চলে পদ্মায়। পদ্মা তো কখনো শুকায় না। কবে এ নদীর সৃষ্টি হইয়াছে কে জানে। সমুদ্রগামী জলপ্রবাহের আজও মুহূর্তের বিরাম নাই। গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনো দিন দ্যাখে নাই, চিরকাল গোপন হইয়া আছে। ’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে এ কথাগুলো লিখেছেন।

উপন্যাসে বিধৃত পদ্মার রূপ এখন আর বর্তমান নেই। এখনকার পদ্মা নদীর ওপর আন্তরাষ্ট্রীয় দখলদারিত্ব রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে প্রবহমানতার মধ্যে মনুষ্যসৃষ্ট ছেদ নদীর প্রকৃত রূপ নষ্ট করে দিয়েছে। নদীর প্রাণ জল। সেই জল নিয়ে আছে ভাগাভাগি। ভারত উজানের দেশ হওয়ার কারণে পদ্মার ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে পদ্মার যে বুক কেউ কোনো দিন দেখেনি বলে লেখক উল্লেখ করেছেন, সেই বুকই এখন দৃশ্যমান হয়ে থাকে। জলহীন পদ্মার বুকে বছরের অর্ধেক সময়জুড়ে শুধু বালু আর বালু। পদ্মার যৌবন এখন রুপালি চরে ঢাকা।

আশ্বিন-কার্তিক মাসে আগে পানি কমে যেত। সেই পানি কমে যাওয়ার পরও শুষ্ক মৌসুমে জলরাশির প্রস্থরূপ ছিল তিন মাইল। লেখকের ভাষায়—‘তখন আশ্বিন মাস, সেখানে পদ্মার এ তীর ও তীরের ব্যবধান তিন মাইলের কম নয়। ’ শুষ্ক মৌসুমে সেই জলরাশি এখন আর নেই। সভ্যতা-মানবতা-মানবিকতা সব কিছুই আজ তুচ্ছ, অতি গৌণ। ভারতের অংশে জল আছে। তারা জল আটকে রেখেছে। ভারতের সঙ্গে পদ্মার জল নিয়ে বাংলাদেশের একটি চুক্তি থাকলেও তা কাগুজে। নদীখেকো জাতিতে পরিণত হচ্ছে অনেকেই। সর্বগ্রাসী মানুষ যখন থেকে নদীর বুকে গ্রাস বসিয়েছে, তখন থেকে প্রকৃতিও তার চরিত্র বদলিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ অংশের পদ্মা অববাহিকা মরুকরণের পথে হাঁটছে।

পদ্মা নদীর সমাজচিত্র এখন ইতিহাসের অংশ। সময়-সমাজই শিল্প-সাহিত্যের প্রতিচ্ছবি। আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের বহুকৌণিক বিশ্লেষণ করে থাকি। সমাজচিত্র তার মধ্যে অন্যতম বিশ্লেষণ। চর্যাপদ একই সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ, একই সঙ্গে সমাজচিত্রও বটে। ফলে প্রাচীন ভাষা-দর্শন-সমাজ সব কিছুর জন্যই আমরা একবার ফিরে তাকাই চর্যাপদের দিকে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনসহ মধ্যযুগের সাহিত্যে আমরা অতীতের সন্ধান করে থাকি। পদ্মা নদীর মাঝিতেও আমরা যে জীবন পাই তাও আমাদের ইতিহাস পাঠের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে।

একটি নদী মানে শুধু একটি জলপ্রবাহ মাত্র নয়। একটি নদীই গড়ে তোলে একটি সভ্যতা। নদীকে ঘিরেই একেক সময়ে সংস্কৃতির ধরন সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের বড় বড় শহর কোনো না কোনো নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে আমরা একটি জেলেপাড়া পাই। সেই জেলেপাড়া এখন আর কোথাও বিদ্যমান নেই। নৌকানির্ভর জীবন ছিল একসময়। তাও এখন ইতিহাসের পাঠ মাত্র। উপন্যাসজুড়ে কুবের, কপিলা, গণেশ, ধনঞ্জয়, হোসেন মিয়া, আমিনুদ্দি, মালা, রাসু সবাই পদ্মার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। নিকট-দূরের যাতায়াত নদীপথে। জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন বলতে পদ্মা ও পদ্মার খাল। স্বপ্ন-সম্ভাবনা সব কিছুই নদীকে ঘিরে। সব চরিত্রের ঘূর্ণাবর্তের সঙ্গে নদীর যোগ আছে বরাবরই। ঔপন্যাসিকের ভাষায়—‘পদ্মা ও পদ্মার খালগুলি ইহাদের অধিকাংশের উপজীবিকা। কেহ মাছ ধরে, কেহ মাঝিগিরি করে। কুবেরের মতো কেহ জাল ফেলিয়া বেড়ায় খাস পদ্মার বুকে, কুঁড়ো জাল লইয়া কেহ খালে দিন কাটায়। নৌকার যাহারা মাঝি, যাত্রী লইয়া মাল বোঝাই দিয়া পদ্মায় তাহারা সুদীর্ঘ পাড়ি জমায়, এ গাঁয়ের মানুষকে ও গাঁয়ে পৌঁছাইয়া দেয়। ’

উপন্যাসের যে চরিত্রটি সব চরিত্রের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত, সে কুবের। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মাপারের এক জেলেপল্লী কেতুপুরের কুবেরকেই প্রধান চরিত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। সমাজের অন্ত্যজশ্রেণির চরিত্র নিয়ে উপন্যাস বাঁধার চেষ্টা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহসিকতার পরিচায়ক। কুবের জেলে ও মাঝি। পদ্মায় ইলিশ ধরে বর্ষার মৌসুমে। তার স্ত্রী মালা। হাঁটতে পারে না। প্রতিবন্ধী স্ত্রীর ছোট বোন কপিলা। কপিলার সঙ্গে মনোদৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রেমের টানে কপিলার স্বামী শ্যামাদাসের বাড়ি গিয়েছিল কপিলাকে দেখতে। সেখানে গিয়ে কুবের জ্বরে আক্রান্ত হয়। প্রেমিকাকে দেখতে গিয়ে অসুস্থ হলেও তার মন-প্রাণ পড়ে থাকে পদ্মার জন্য। সুস্থ হয়ে তারপর যাওয়ার জন্য কুবেরকে অনুরোধ করে কপিলা। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে—‘পদ্মা নদীর কূল ছাড়িয়া দশ মাইল তফাতে চলিয়া আসিয়াছে সে, মন কেমন করিতেছে তার। পদ্মার বাতাস গায়ে না লাগিলে, কেতুপুরের মেছো গন্ধ না শুঁকিলে, সে সুস্থ হইবে না। ’ পদ্মার সঙ্গে কুবেরের যে প্রেম, তা যেন কপিলার প্রেমকেও হার মানায়।

সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’ গল্পে একটি পুরনো মোটরগাড়ি জগদ্দলের সঙ্গে গল্পের নায়কের প্রেম আমরা দেখেছি। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পে মহেশের সঙ্গে গফুরের প্রেম দেখেছি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নারী ও নাগিনী’ গল্পে খোঁড়া শেখের সঙ্গে সাপের সম্পর্ক দেখেছি, দেখেছি পরশুরামের লম্বকর্ণ গল্পে একটি ছাগলের সঙ্গে গল্পের নায়কের মিতালি। আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে আমরা দেখি পদ্মার সঙ্গে কুবেরের প্রেম।

উপন্যাসের শুরুতেই পদ্মায় ইলিশ ধরার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আমরা আখ্যানভাগে প্রবেশ করি। প্রবেশপূর্বক পূর্ণ সময় পদ্মায় যেন অবগাহন। শেষ দৃশ্যেও কুবের জলপথে ময়নাদ্বীপে যাত্রা করে। পদ্মায় কাহিনির অবতারণা, পদ্মাতেই কাহিনির সমাপ্তি। পদ্মাময় এক আখ্যান ‘পদ্মা নদীর মাঝি’।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপন্যাসটিতে তাঁর দুটি চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। একটি হচ্ছে তাঁর মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যটি লিবিডো। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ময়নাদ্বীপ প্রতীকী অর্থে এক অর্থপূর্ণ সৃষ্টি। ময়নাদ্বীপে কোনো মসজিদ-মন্দির নেই। যাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের এক উন্নত স্বপ্ন দেখানো হয়। কেউ যাওয়ার পর পালিয়ে এলেও তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন হোসেন মিয়া। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্রয়েডিয়ের দর্শন প্রয়োগ করেছেন কুবের-কপিলার মধ্যে।

মালা শারীরিক প্রতিবন্ধী। অন্যদিকে চপল-চঞ্চল কপিলা। কপিলাকে তার স্বামী অনেক দিন সঙ্গে রাখেনি। আরেকটি বিয়ে করেছিল। দ্বিতীয়  স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্ত্রীকে নিয়ে গেছে। মধ্যবর্তী সময়টির অনেকাংশ সে ছিল বড় বোন মালার বাড়িতে। প্রতিবন্ধী মালার স্বামী কুবেরের সঙ্গে তাই তার ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্কটিই যেন অনিবার্য ছিল। কপিলার নানা ছলাকলা কুবের যৎসামান্য বিরোধিতা করলেও সে তা উপভোগও করে। গোপীর পায়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে হোটেলে একসঙ্গে কুবের-কপিলার রাত্রি যাপন লেখকের পরিকল্পিত পথেরই বিনির্মাণ।

মার্ক্সবাদী দর্শনের আদলে সৃষ্ট ময়নাদ্বীপে কুবেরকে নেওয়ারও ব্যবস্থা করেছেন। কুবের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তার বাড়িতে পুলিশ এসেছে। কপিলা সারা রাত জেগে পদ্মার পারে দাঁড়িয়েছিল। জেলভয়ে কুবের ময়নাদ্বীপে যেতে আপত্তি করেনি। যাওয়ার সময় নৌকার ছইয়ের নিচে কুবেরের কাছে গিয়ে কপিলা বলে, ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ উপন্যাসের শেষ বাক্য—‘হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। একা অত দূরে কুবের পাড়ি দিতে পারিবে না। ’ কপিলার প্রশ্নের উত্তর কুবের দেয়নি। আবার অন্য কেউ যখন কুবেরের সঙ্গে কপিলার যাওয়ার কথা বলে, তার কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই উপন্যাসটি শেষ হয়। পাঠকের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে দুটি চরিত্রকে ফ্রয়েডীয় দর্শনের ওপর দাঁড় করিয়েছেন, সে চরিত্র দুটিকেই আবার নিয়ে গেলেন ময়নাদ্বীপে। যেখানে একই সঙ্গে লেখকের দুটি দর্শনের প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মা নদীকে প্রধান উপজীব্য করে উপন্যাস রচনা করেননি। পদ্মা নদীর মাঝিকে নির্বাচন করেছেন তাঁর উপন্যাসের জন্য। কিন্তু যে ক্যানভাসের ওপর রংতুলির আঁচড়ে শিল্পকর্মটি পূর্ণতা পেয়েছে, সেটি পদ্মা। একটি নদী। সেই নদীর জীবনকাল পরম্পরায় হুমকির মুখে। কথাশিল্পীর সৃষ্টিতে বেঁচে থাকা নদীচিত্রই আমাদের কাম্য। পদ্মার জলকথনে আবার ভরে উঠুক সন্ধ্যার পদ্মা। সারা বছর ঢাকা থাকুক পদ্মার রুপালি বুক। পদ্মার নদীচরিত্র বজায় রেখে গড়ে উঠুক আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিমণ্ডল।