পীর হাবিবুর রহমান
মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, মানুষের ভাষা কি শুনতে পাচ্ছেন? দেখতে কি পাচ্ছেন গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার বাজেট ও কথাবার্তা নিয়ে দেশের মানুষ কি বলছে, কি লিখছে? আমার একজন প্রিয়, শ্রদ্ধেয়, স্মার্ট, সাহিত্যের রসবোধসম্পন্ন লেখক ও সাবেক জাঁদরেল আমলা হিসাবে অনেক পছন্দের। ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে সৎ হিসাবেই চিনি। কিন্তু এবার বাজেট দেয়ার পর সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া যেভাবে দেখা যাচ্ছে অতীতে সেভাবে আর কখনো দেখা যায়নি। আপনি বলেছেন, জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট দিয়েছেন। আপনি আবার বলেছেন, ব্যাংকে চুরিচামারি হয়েই থাকে। আবার ব্যাংকিংখাতের এই লুটপাটের মধ্যেও মানুষের আস্থার জায়গাটি আছে বলে আপনি আমানতকারীদের ওপর করের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন। সবিনয়ে জানতে চাই মাননীয় অর্থমন্ত্রী, এমনটা হচ্ছে কেন?
ব্যাংকিংখাতে যখন চার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যায় আপনি তখন বলেন, এটা কোনো টাকাই নয়। অন্যদিকে বলছেন, যাদের লাখ টাকা আছে তারা সম্পদশালী। মাননীয় অর্থমন্ত্রী আপনার অতি আপনজন ও সহকর্মী কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর কাছে জেনে নিবেন, বাজারের অবস্থা কি? আপনারা দামি স্যুট-টাই পরেন। আপনারা দামি পাঞ্জাবি পরেন। সবাই নিয়মিত বাজারে যান না। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী নিজের বাজার করেন, তিনি জানেন ৯ বছরে বাজারের হালচাল, নিত্যপয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম এমনকি চালের দামটা কোথায় গেছে? আপনার পূর্বসূরী শাহ এম এস কিবরিয়া আওয়ামী লীগের ৯৬ শাসনামলে দেশের অর্থনীতিকে যতটা মজবুত, সুশৃঙ্খল এবং বাজারে চালের দাম যতটা নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন, সেই অনুপাতে আপনি কি ততটা পারছেন?
স্বল্পভাষী শাহ এম এস কিবরিয়া আপনার মতো অতিকথনে পারদর্শী ছিলেন না। কিন্তু তাকে শেয়ারবাজারের বিপর্যয় ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক স্ক্যান্ডালের মুখোমুখি হতে হয়নি। আপনারা সিলেটের ৩ কৃতি সন্তান এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অর্থমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করার গৌরব অর্জন করেছেন। মরহুম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানসহ ২৮ টি বাজেট দিয়েছেন। ইতিহাস সাইফুর রহমানকে অর্থনীতির সংস্কারক ও শাহ এম এস কিবরিয়াকে দক্ষ অর্থমন্ত্রী হিসাবে অমরত্ব দিয়েছে। আপনি ভ্যাটের চাপে ভোটের যে বাজেট দিয়েছেন, তাতে ইতিহাস আপনাকে কোথায় নির্ধারণ করবে সে চিন্তা কি কখনো করেছেন?
যারা ব্যাংকে লাখ টাকা রাখতে পারেন, তাদেরকে সম্পদশালী বলে আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে রণবীর কার্টুণ যদি থাকতো, শুকন মিয়ার ঢাকা দর্শণ তাহলে সবচে উচিত জবাবটিই হয়তো আপনি পেতেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার নির্বাচনের আগে বা পরে উচ্চাভিলাসী বাজেট দেন, কল্পনাভিলাসী বাজেট দেন। এমনকি বলা হয়, নির্বাচনী বাজেট দেয়া হয়েছে। সেই বাজেটের সমালোচনা করেন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল। তারা রাজনীতির জন্য সমালোচনা করেন। সিপিডির গবেষক ছাড়াও অর্থনীতিবিদরা বাজেটের ক্রুটি-বিচ্যুতি, ফাঁকফোঁকড়, ইতিবাচক, নেতিবাচক দিকগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে ব্যাখা বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝেন না বা এ নিয়ে বেশি মাতামাতি করেন না। কিন্তু একটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আপনি আপনার ভাষায়, জীবেনের শ্রেষ্ঠতম বাজেট দিয়েছেন বলে আত্নতৃপ্তির ঢেঁকুড় তুললে সিয়াম ও সংযমের মাস রমজানে মানুষ মুখের লাগাম, কিবোর্ডের লাগাম ছেড়ে বলে যাচ্ছে-এমন করের বোঝার বাজেট আসেনি জাতির জীবনে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অর্থমন্ত্রী মহাসড়কে উঠবেন ভালো, কিন্তু অর্জন সুসংহত করতে আগে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করতে হবে। ব্যাংক, বীমা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো-এসব ঠিক নেই; কিন্তু মহাসড়কে উঠে পড়লেন। এতে তো দুর্ঘটনা ঘটবে। মহাসড়কে উঠলে তো আর নামা যাবে না। প্রয়োজনে মহাসড়ক যুক্ত হবে আন্তর্জাতিক সড়কের সঙ্গেও। কিন্তু ঘোষিত বাজেট গতানুগতিক, যেখানে আশ্বাস রয়েছে অনেক। তিনি বলেছেন, বাজেট বিশাল অংকের হলেও বাস্তবায়নযোগ্য মনে হয় না। এবার বাজেট ঘাটতি হবে বিশাল। রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাট চাপানো হয়েছে। সংস্কার না করে ভ্যাট চাপিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি। ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের ওপর সব চাপিয়ে দেবেন। সরকারের আয় হবে, জনগণের পকেট কেটে। তিনি অনেক প্রশ্ন তুলে আরো বলেছেন, করের বোঝার বাজেট জনগণমূখী হয় কিভাবে? আপনার মতো অভিজ্ঞ, পণ্ডিত মানুষ এসবের জবাব দেবেন কি?
আমাদের সহজ-সরল প্রশ্ন ব্যাংক আমানতের ওপর কর বাড়িয়ে জনগণকে কি পরোক্ষভাবে সেই অনিশ্চিত শেয়ার বাজারের দিকেই ঠেলে দিলেন? আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন, সাধারণ মানুষ মাটির ব্যাংকের ছবি দিয়ে প্রতিবাদের ভাষায় বলছে, এখন থেকে এটাতেই টাকা রাখবে। এটা এক ধরণের প্রতীকি প্রতিবাদ। এমন প্রতিবাদের ঢেউ সাম্প্রতিক ইতিহাসে কখনো বাজেট ঘিরে হয়েছে কি? আপনাদের মতো আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের এত জ্ঞানের গরিমা নেই। কিন্তু বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলছে, কোনো ধরণের সংস্কার ছাড়া বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে এই বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই বাজেট দলিলের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন অবাস্তব তথ্য উপস্থাপন করে বাজেটের অংকের হিসাব মেলানো হয়েছে। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তির যে হিসাব দেয়া হয়েছে তা অংকের হিসাব জানা শিশুও বিশ্বাস করবে না।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, দীর্ঘদিন থেকে অনেক প্রশ্ন ভিতরে জমেছে আমার। ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা রেখে বিনয়ের সঙ্গে মনের কৌতুহল ও তৃষ্ণা নিবারণে জানতে চাই, আপনি যেখানে শেয়ারবাজারকে ফটকাবাজার বলেছিলেন; সেখানে আপনার সহোদর ড. আবুল মোমেন কেমন করে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান হলেন? আপনার আরেক নিকট আত্নীয় ড. আহমেদ আল কবীর রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান কেমন করে হয়েছিলেন? তার এই চেয়ারম্যান হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি আওয়ামী যুবলীগেরও প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়ে গেলেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী জবাব দেবেন কি, আপনার আত্নীয়-স্বজনদের মনের আশা পূরণ করলেও ৯ বছরে জনগণের আশা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন কি? আপনার আমলেই বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছে। ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে আপাদমস্তক সৎ গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করে চলে গেলেও এই কেলেংকারির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে কারা জড়িত তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়নি কেন?
২০১০ সালের শেয়ার কেলেংকারির ঝড়ের মুখে সরকার তদন্ত কমিটি করেছিল। আপনি মহান সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ওদের হাত লম্বা। কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের চেয়ে, সরকারের চেয়ে, কাদের হাত এত লম্বা; বলবেন কি? চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ীর লাভজনক শিল্প প্রতিষ্ঠান না থাকলেও আলোচিত হচ্ছে ৭৬ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণই তিনি নেননি, একের পর এক বিভিন্ন ব্যাংকের মালিক হয়ে যাচ্ছেন। এটা কেমন করে হচ্ছে, মাননীয় অর্থমন্ত্রী? জবাব দেবেন কি? আপনিই বলছেন, ব্যাংকিং খাতে সব সময় চুরিচামারি হয়, এর মধ্য দিয়ে চোর চামারদের উৎসাহিত করা কি হচ্ছে না?
এদের রুখতে ব্যাংকিং সেক্টরে এখন পর্যন্ত সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি কেন?
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, লাখ টাকা ব্যাংকে থাকলেই যদি সম্পদশালী হওয়া যায়, তাহলে একজন নাগরিক হিসাবে মানুষ যদি লাখ টাকা আপনার হাতে দিয়ে বলে আমার সংসারের খাওয়া পরা, সন্তানদের লেখাপড়া ও একটি সুস্থ জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করে দিন, আপনি কি জবাব দেবেন?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক