বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদ হার আরেক দফা কমেছে। তবে বেড়েছে ঋণের সুদহার। একই সঙ্গে বেড়েছে ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) হারও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগে মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে অলস টাকা। তাই পরিচালন ব্যয় হ্রাসে ব্যাংকগুলো কমাচ্ছে আমানতের সুদহার। তবে কোনোমতেই আমানতের সুদের হার মূল্যস্ফীতির নিচে যাওয়া উচিত নয়। এতে ব্যাংকে টাকা রেখে লাভের চেয়ে লোকসান হবে বেশি। ফলে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবেন। এছাড়া অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য শুভ নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মে মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে গড় আমানতের সুদহার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা আগের মাস এপ্রিলের চেয়ে দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এপ্রিলে আমানতের সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অন্যদিকে মে মাস শেষে ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ যা আগের মাস এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ঋণের সুদহার বেড়েছে দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমানতের মুনাফা দিয়ে অনেকে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। তাই আমানতের সুদহার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকা উচিত নয়। এতে অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ ব্যয় হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
তিনি বলেন, যেখানে দেশে বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের উপরে, যেখানে আমানতের সুদহার ৫ শতাংশ বা তার নিচে থাকা মানে রিটার্ন নেগেটিভ হয়ে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য ভালো না। তাই যেকোনো মূল্যে আমানতে সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের উপরে রাখতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য আমানতের সুদের হার বেশি রাখতে হবে। যদিও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলো নিজস্ব নীতিমালার আলোকে ঋণ ও আমানতে সুদহার নির্ধারণ করতে পারে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়েছে।
এদিকে মাত্রাতিরিক্ত সুদের হার কমানোর ফলে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায় ব্যাংকগুলোকে আমানতের সুদের হার না কমানোর জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ঋণের সুদের হারের তুলনায় আমানতের সুদের হার বেশি কমানোর ফলে মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সঞ্চয়ের বদলে অপচয়মূলক ভোগ ও অন্যান্য অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের প্রবণতার ঝুঁকি বাড়ছে। এ কারণে আমানতের মুনাফার হার কমানোর প্রবণতা রোধের বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, ঋণের সুদের হার কমানোর প্রবণতা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে তা কোনোভাবেই আমানতের সুদের হার কমিয়ে নয়।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমানত ও ঋণের সুদ হারের ব্যবধান (স্পেড) কমিয়ে ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের মধ্যে রাখতে বলা হলেও এখনো এ নির্দেশনা মানছে না দেশি বিদেশি ১৩টি বেসরকারি ব্যাংক। মে শেষে ৫টি বিদেশি ব্যাংক এবং ৮টি বেসরকারি ব্যাংকের স্পেড ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি রয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সবগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের স্প্রেড নির্ধারিত সীমার মধ্যে রয়েছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মে মাস শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ হারে সুদ আদায় করেছে। আমানতের বিপরীতে দিয়েছে ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ সুদ। স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ০২ শতাংশীয় পয়েন্ট। বিশেষায়িত ব্যাংকের স্প্রেড সবচেয়ে কম, যা মাত্র ৩ দশমিক ১০ শতাংশ।বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে দিয়েছে ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ সুদ। ঋণের ক্ষেত্রে নিয়েছে ৯ দশমিক ০৭ শতাংশ সুদ।
বেসরকারি খাতের ৮ ব্যাংকের স্প্রেড ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপরে অবস্থান করছে। গত মে মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণের ক্ষেত্রে গড়ে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ হারে সুদ আদায় করেছে। আমানতের বিপরীতে দিয়েছে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ সুদ। গড় স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮২ শতাংশীয় পয়েন্ট।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর স্প্রেড এখনো ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের উপরে রয়েছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ সুদ দিয়েছে। অন্যদিকে ঋণের বিপরীতে আদায় করছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ সুদ। এ খাতের ব্যাংকগুলোর স্প্রেড সবচেয়ে বেশি, যা ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ।
স্প্রেড ৫ শতাংশের উপরে রয়েছে বিদেশি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, সিটি ব্যাংক এনএ, ওয়ারী ব্যাংক এবং এইচএসবিসি ব্যাংক। দেশি ব্যাংকগুলো মধ্যে রয়েছে, দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড, আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড, উত্তরা ব্যাংক লিমি্টেড, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড এবং দ্য ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড।