১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের জন্ম। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়। এতে অংশ নেন আনসার, পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীসহ দেশের আপামর জনসাধারণ। শহিদ হন ৩০ লাখ মানুষ। সম্ভ্রম হারান দুই লাখ নারী। আহত হন আরও কয়েক লাখ মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর (১৯৭১ থেকে ২০২৩) এ পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে, ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে সবগুলো ‘অংশগ্রহণমূলক’ হয়নি। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে- ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮, এই পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল। বাকি নির্বাচনগুলোতে কোনো না কোনো দল, এমনকি একাধিক দলও বর্জন করেছে।
প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ, বুধবার। সেই সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল ১৪টি। সব দল মিলিয়ে ৩০০ আসনে প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৯১ জন। সে নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৩.৫৪ শতাংশ। নির্বাচনের জামানত ছিল ১ হাজার টাকা।
অংশগ্রহণকারী ১৪টি দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে এককভাবে জয়ী হয়েছিল ২৯২ আসন পেয়ে। এ ছাড়াও, সংরক্ষিত ১৫টি মহিলা আসনসহ প্রথম সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিল ৩০৭ জন।
প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকি দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ পেয়েছিল ৩টি, ন্যাপ (ভাসানী) ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১টি এবং স্বতন্ত্র ৩ জন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী সব ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ ছিল।
দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের অধীনে বাংলাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, রোববার। সে নির্বাচনে অংশ নেয় ২৯টি রাজনৈতিক দল। মোট ভোট পড়েছিল ৫১.২৮ শতাংশ। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জামানত ছিল ২ হাজার টাকা।
নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে এককভাবে ২২০টি আসন পায়। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সংরক্ষিত মহিলা আসন ১৫টি থেকে বাড়িয়ে ৩০টি পাশ করে। তাদের প্রাপ্ত ২২০টির সঙ্গে সংরক্ষিত ৩০টি আসন যোগ হয়ে বিএনপির মোট আসন দাঁড়ায় ২৫০টি।
অপরদিকে, সে নির্বাচনে বাকি ৮০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ৩৯টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ১২টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ ৮টি, ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ ৬টি, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, জাতীয় লীগ ২টি, গণফ্রন্ট ২টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১টি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, জাতীয় একতা পার্টি ও ন্যাপ (মোজাফফর) ১টি করে আসন পায়। এ ছাড়া, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৫ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সেই সময় থেকেই ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতি এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালের ৭ মে, বুধবার। সে নির্বাচনে অংশ নেয় ২৮টি রাজনৈতিক দল। ভোটের হার ছিল ৫৯.৩৮ শতাংশ। জামানত ছিল ৫ হাজার টাকা।
বিএনপি সে নির্বাচন বর্জন করে। জাতীয় পার্টি ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৮৩টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ৭৬টি আসনে জয়লাভ করে বিরোধী দল হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাকি দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ পায় ১০টি আসন, কমিউনিস্ট পার্টি ৬টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৫টি, মুসলিম লীগ ও জাসদ (রব) ৪টি করে, ওয়ার্কার্স পার্টি (নজরুল) ও জাসদ (সিরাজ) ৩টি করে, ন্যাপ (মোজাফফর) ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন ৪ জন। সে বছর কোনো সংরক্ষিত নারী আসন ছিল না।
চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
আবারও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ, বৃহস্পতিবার চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচন অবশ্য যৌথভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বর্জন করে। চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮টি রাজনৈতিক দল এবং তাদের অধীনে ৯৭৭ জন প্রার্থী অংশ নেন। ভোট পড়েছিল ৫৪.৯৩ শতাংশ। জামানত ছিল ৫ হাজার টাকা।
চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এককভাবে ২৫১টি আসনে জয়লাভ করে। সম্মিলিত বিরোধীদল পায় ১৯টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, ফ্রিডম পার্টি ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পায় ২৫টি আসন।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ২৫টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। বিএনপি আসন পায় ১৪০টি এবং সংরক্ষিত ২৮টি, আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, সিপিবি ও বাকশাল ৫টি করে, ন্যাপ (মোজাফফর), জাসদ (সিরাজ), এনডিপি, ইসলামী ঐক্যজোট ও গণতান্ত্রিক পার্টি ১টি করে, জামায়াতে ইসলামী ১৮টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসনে বিজয়ী হন।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৫৫.৫৪ শতাংশ। সে নির্বাচনেও প্রার্থীদের জামানত ছিল ৫ হাজার টাকা।
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। অংশগ্রহণকারী ৪২টি দলের বিপরীতে মোট প্রার্থী ছিল ১ হাজার ৪৫০ জন। সে নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৬৭ লাখ ২ হাজার ৪২ জন। যাদের মধ্যে ভোট দিয়েছিলেন ১ কোটি ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৪৮১ জন।
সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ অনেক রাজনৈতিক দল অংশ না নেওয়ায় সংসদের বিরোধীদল ছিল না। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি পায় ২৭৮টি আসন। যার মধ্যে আবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ৪৮ জন, ফ্রিডম পার্টি পায় ১টি ও স্বতন্ত্র ১০টি আসন। তবে, ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মেয়াদ ছিল মাত্র ৪ মাস।
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৯৬ সালের ১২ জুন আবারও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যা স্বাধীন বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ৮১টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যাতে মোট ভোট পড়ে ৭৫.৬০ শতাংশ। জামানত ছিল ৫ হাজার টাকা।
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসনে জয়লাভ করে। এরপর তারা জোট নিয়ে সরকার গঠন করে এবং প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
বিএনপি ১১৬টি আসন পেয়ে বিরোধীদল হয়। আর বিরোধী দলের নেতা হন বেগম খালেদা জিয়া। বাকি আসনগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি পায় ৩২টি, জামায়াত ইসলামী ৩টি, ইসলামী ঐক্যজোট, জাসদ (রব) ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১টি করে আসনে জয়লাভ করে।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ৫৫টি দল অংশ নেয়। সব দল মিলে মোট ১ হাজার ৯৩৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সে নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৭৪.৭৩ শতাংশ। প্রার্থীদের জামানত বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা করা হয়।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ পায় ৬২টি, জামায়াত ১৭টি, জাতীয় পার্টি (নাজিউর রহমান মঞ্জু) ৪টি, ইসলামী ঐক্যজোট ২টি, জাতীয় পার্টি (মতিন) ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ১টি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান ৬টি আসন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রথম বারের মতো নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করার পর সব শর্ত পালন করে ৩৯টি নিবন্ধিত দল নির্বাচনে অংশ নেয়। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। সে অনুযায়ী মোট ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৩ জন। সেসব ভোটারের মধ্যে ৭ কোটি ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৪৮৫ জন ভোটাররা তাদের ভোটদান করেন। ভোট পড়ার হার ছিল ৮৬.৩৪ শতাংশ। নির্বাচনের জামানতও ছিল ১০ হাজার টাকা।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, বিএনপি পায় ৩০টি আসন, জাতীয় পার্টি ২৭টি, জাসদ ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি, জামায়াত ২টি, বিজেপি ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ১টি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান ৪টি আসন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
বিএনপিসহ কয়েকটি দলের নির্বাচন বর্জনের মধ্যেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ১১টি দল অংশ নেয়। আর আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৪১ শতাংশ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অনেকটা ‘একতরফা’ নির্বাচনে এককভাবে ২৭৩টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি পায় ১৮টি আসন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় দুটি জোটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি পায় মাত্র ৬টি আসন।