বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আমদানি শুল্ক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা, বাকিতে ঋণপত্র খোলার সুযোগ দেওয়া এবং সরকারিভাবে আমদানির প্রভাব চালের বাজারে পড়ছে না। এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও গত এক মাসে দেশের মানুষের প্রধান এই খাদ্যের দাম অন্তত তিন দফায় কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে।
রাজধানীর বাজারে সরু চালের দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকার ওপরে উঠেছে, যা বছরের এ সময়ে সাধারণত ৫০ টাকার নিচে থাকে। এ ছাড়া মাঝারি ও মোটা চালের দামও বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা।
খুচরা বাজারে মাঝারি মানের চালের মধ্যে বিআর-২৮ প্রতি কেজি ৫২ থেকে ৫৪ টাকা এবং মোটা চাল মানভেদে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের এ সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, মাঝারি চালের দাম এবার কেজিতে ১০ টাকা ও মোটা চালের দাম ১৩ টাকা বেশি।
এদিকে চালের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় গতকাল সোমবার কুষ্টিয়ায় একটি চালকলে অভিযান চালিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। চালকলটিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। চালকলটির মালিক চালকল মালিক সমিতির সভাপতি।
দফায় দফায় চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপাকে পড়েছে মানুষ। সীমিত আয়ের একটি পরিবারে ৫০ কেজির এক বস্তা চাল কিনতে এখন ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। চালের বিকল্প আটার দামও চলতি সপ্তাহে কেজিতে দুই টাকা বেড়েছে।
শ্যামলীতে গোল্ডেন এস্টেট নামে পরিচিত একটি রিকশার গ্যারেজ চালান ময়না বেগম। তাঁর গ্যারেজে ৫০ জনের মতো রিকশাচালক তিন বেলা খাবার খান। সম্প্রতি এক দিনের খাবারের দাম ২০ টাকা বাড়িয়ে ১২০ টাকা করেছেন ময়না বেগম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চালের দাম এভাবে বাড়লে রিকশাচালকদের কাছ থেকে বেশি না নিয়ে উপায় কী?’
বাজারে চালের দাম বেড়ে গেলে খাদ্য অধিদপ্তর খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচি চালায়। কিন্তু এটি এখন বন্ধ। ৬ সেপ্টেম্বরের হিসাবে সরকারের গুদামে মজুত ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার টন চাল। গত বছর একই দিনে মজুত ছিল ৮ লাখ ২৩ হাজার টন। ওএমএস চালু করা হবে কি না, জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. কায়কোবাদ হোসেন গত রাতে বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে আমরা চালু করব।’
দেশে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ৫৫ শতাংশ আসে বোরো মৌসুমে। গত বোরোতে হাওরে ফসলহানি ও বন্যায় উৎপাদন ২০ লাখ টন কম হয়েছে বলে মনে করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আগের বছর বোরোতে উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টন চাল।
উৎপাদন কম হওয়ায় গত এপ্রিল থেকেই বাজারে চালের দাম বাড়তে থাকে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে গত মাসের শুরুতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেটের দাম ছিল ২ হাজার ৬৫০ টাকা, যা এখন ৩০০ টাকা বেশি চাইছেন বিক্রেতারা। এ হিসাবে মিনিকেটের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৬ টাকা। জানতে চাইলে কৃষি মার্কেটের পাইকারি প্রতিষ্ঠান বরিশাল রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন রাজা বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, চালের সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি থাকায় দাম বেড়েছে।
রাজধানীর বাজারে আমদানি করা চাল আসছে মূলত ভারত থেকে। গতকাল বেনাপোল বন্দরে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪৪ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় ৫ থেকে ৬ টাকা বেশি।
ভারতকেন্দ্রিক চাল আমদানিকারক মোহাম্মদপুরের খুলনা রাইস এজেন্সির মালিক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, সবাই ভারতের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ায় সেখানেও চালের দাম বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বেনাপোল বন্দরে জটের কারণে ভারতীয় অংশে ট্রাকের ভাড়াও অনেক বেড়েছে। বেনাপোল বন্দরে একটি ট্রাক খালাসে ২০ দিন লাগছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় দুই মাসে ৩ লাখ ৬৩ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। এর আগের পুরো এক বছরে আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার টন চাল।
কুষ্টিয়ায় অভিযান
দেশের বড় চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্ট নামের চালকলে গতকাল অভিযান চালান ভ্রাম্যমাণ আদালত। আগে কেনা ধানের বর্তমান বাজারমূল্য দেখিয়ে চাল বেশি দামে বিক্রির অভিযোগে চালকলটিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ চালকলের মালিক আবদুর রশিদ বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত ৩০ আগস্ট চালকলমালিকদের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
জানতে চাইলে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক সাইফুল ইসলাম বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, ‘রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টের নথিপত্র দেখে ধান কেনা ও চাল বিক্রিতে অসামঞ্জস্য পাওয়া গেছে। এতে কারাদণ্ড দেওয়া যেত। তারপরও প্রথমবার বলে সতর্ক করার জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে জরিমানা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, এখন থেকে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে।
খাজানগরে ৩১টি বড় অটো রাইস মিল আছে। এগুলো থেকে প্রতিদিন অন্তত দেড় হাজার টন চাল দেশের বিভিন্ন বাজারে যায়। সেখানকার চালকলমালিকদের দাবি, বাজার থেকে বেশি দামে ধান কেনার কারণেই তাঁরা চালের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক ও আইনজীবী হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করলে জরিমানার সুযোগ আছে, বেশি মুনাফা করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকার খরচ বিশ্লেষণ করে চালের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরে কেউ সেই দামের চেয়ে বেশি চাইলে জরিমানা করা যায়।