ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সারা দেশের ব্যবসায়ীদের কপালে ভাঁজ ৬০৬৭ কোটি টাকার আলু হিমাগারে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সারা দেশের ৩৯০টি হিমাগারে প্রায় ৪৩ লাখ মেট্রিক টন (১০০০ কেজিতে এক মেট্রিক টন) আলু পড়ে আছে। এর বাজারমূল্য (প্রতি মেট্রিক টন ১৪ হাজার ১১০ টাকা) প্রায় ছয় হাজার ৬৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

দুই মাস পর আলু চাষের নতুন মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে সপ্তম। এশিয়ায় তৃতীয়। তবে রপ্তানির দিক থেকে (১৫ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই) অনেক পিছিয়ে। ২০১৬ সালে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছিল ৮০ লাখ মেট্রিক টন। চলতি বছর উৎপাদন এক কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। অথচ আলুর চাহিদা, ব্যবহার ও রপ্তানি বাড়েনি।

হিমাগার থেকে আলু বিক্রির যে গতি তাতে মৌসুম শেষে (সাড়ে তিন মাস) ১৯ থেকে ২০ লাখ টন অবিক্রীত থেকে যাবে। এতে বিপুলসংখ্যক কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের আট জেলার হিমাগারগুলোয় প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন আলু পড়ে আছে। এগুলো বিক্রি না করতে পারলে হিমাগার মালিক ও আলু চাষিদের প্রায় দুই হাজার ৫৩৯ কোটি ৮০ লাখ টাকার ক্ষতি হবে।

রংপুর বিভাগের কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও আলু চাষিদের কাছ থেকে জানা গেছে, দুই মাস পর নতুন আলু রোপণের মৌসুম। হিমাগারের আলু এখনই না বেচতে পারলে তা খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়বে। হিমাগারে পচে নষ্ট হবে।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় শাহ জালাল ও এ বি এল স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ প্রাইভেট লিমিটেড নামে দুটি হিমাগার রয়েছে। শাহ জালাল হিমাগারে এক লাখ ৭১ হাজার বস্তা ও এ বি এল কোল্ড স্টোরেজে এক লাখ ২০ হাজার বস্তা আলু মজুদ রাখা হয়েছে। প্রতিবছর এ সময়ে হিমাগারের বাইরে চাষি ও ব্যবসায়ীদের হুড়াহুড়ি দেখা যায়। কিন্তু এবারে চিত্র ছিল একেবারে ভিন্ন। আলু তুলতে আসছে না কেউ। বিগত বছরগুলোয় এই সময়ে ৭৫ শতাংশ আলু হিমাগার থেকে বেরিয়ে গেলেও এবারে ১৫ শতাংশও বের হয়নি।

স্থানীয় বাজারগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌসুমে প্রতি বস্তা (৮৫ কেজি) সাদা আলু ৯৫০ টাকা, গ্র্যানুলা ৬৫০ টাকা, শীল বিলাতি (স্থানীয় নাম) এক হাজার ৫০০ টাকা, কার্টিনাল ৯০০ টাকা, লাল পাকড়ী এক হাজার ১০০ টাকা ও ডায়মন্ড ৮৫০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। তার ওপর বস্তাপ্রতি পরিবহন খরচ ১১০ টাকা, হিমাগার খরচ ২৬০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাজারে বস্তাপ্রতি আলুর ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কমে গেছে। তবে পাইকারি বাজারে ধস নামলেও খুচরা বিক্রেতারা প্রতি কেজি আলু ১৮ থেকে ২৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে।

বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী কাজী ফজলুল হক বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে চার হাজার বস্তা আলু কিনে হিমাগারে রেখেছি। বর্তমানে প্রতি বস্তা ৭০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। হিমাগার ও পরিবহন ভাড়া মিলে বস্তায় ৪০০ টাকা লোকসান গুনতে হবে। ’

মধুপুর ইউনিয়নের ঘোনাপাড়ার চাষি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘নিজের জমিতে চাষ করা আলু আছে ৫০০ বস্তা। বাজার থেকে কিনে আরো তিন হাজার ৪০০ বস্তা হিমাগারে রেখেছি। প্রতি বস্তা আলুতে হিমাগার থেকে ৫০০ টাকা করে ঋণ নিয়েছি। কিন্তু এখন প্রতিদিন হিমাগারের লোকজন ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে। বাজারের অবস্থা এ রকম থাকলে বাড়ি ছেড়ে পালানো ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। ’

ব্যবসায়ী সফিয়ার রহমান বলেন, ‘৩০০ বস্তা সাদা আলু কিনে শাহ জালাল কোল্ড স্টোরেজে রেখে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। বাজার এ রকম থাকলে পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। ’

শাহ জালাল হিমাগারের তত্ত্বাবধায়ক প্রদীপ কুমার বলেন, ‘এর আগে ২০১৩ সালে আলু নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। এবার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবসায়ী আলু তুলতে আসেনি। এ কারণে আমরা চিন্তায় আছি। হিমাগার মালিকদের কোটি কোটি টাকা ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে হবে। ’

এ বি এল কোল্ড স্টোরেজের মালিক বাসুদেব দাস বলেন, ‘আলু ব্যবসায়ীদের তিন কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লোকসানের ভয়ে কেউ আলু তুলতে আসছে না। ’

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক স ম আশরাফ আলী বলেন, ‘গত মৌসুমে রংপুরে ৫৪ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন আলু চাষ হয়েছে। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলে ছোট ছোট কারখানা তৈরি করে আলুর চিপস প্যাকেটজাত করতে পারলে লোকসান থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যাবে। ’

রংপুরের হিমাগার ব্যবসায়ী, মোতাহার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘রপ্তানিকারকদের কাছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন না থাকায় রপ্তানি অলাভজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারি উদ্যোগে (বন্যার্ত এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে) ত্রাণ ও চালের সঙ্গে আলু বিতরণ করতে হবে। এ জন্য অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রাণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

সারা দেশের ব্যবসায়ীদের কপালে ভাঁজ ৬০৬৭ কোটি টাকার আলু হিমাগারে

আপডেট টাইম : ০৯:০২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সারা দেশের ৩৯০টি হিমাগারে প্রায় ৪৩ লাখ মেট্রিক টন (১০০০ কেজিতে এক মেট্রিক টন) আলু পড়ে আছে। এর বাজারমূল্য (প্রতি মেট্রিক টন ১৪ হাজার ১১০ টাকা) প্রায় ছয় হাজার ৬৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

দুই মাস পর আলু চাষের নতুন মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে সপ্তম। এশিয়ায় তৃতীয়। তবে রপ্তানির দিক থেকে (১৫ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই) অনেক পিছিয়ে। ২০১৬ সালে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছিল ৮০ লাখ মেট্রিক টন। চলতি বছর উৎপাদন এক কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। অথচ আলুর চাহিদা, ব্যবহার ও রপ্তানি বাড়েনি।

হিমাগার থেকে আলু বিক্রির যে গতি তাতে মৌসুম শেষে (সাড়ে তিন মাস) ১৯ থেকে ২০ লাখ টন অবিক্রীত থেকে যাবে। এতে বিপুলসংখ্যক কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের আট জেলার হিমাগারগুলোয় প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন আলু পড়ে আছে। এগুলো বিক্রি না করতে পারলে হিমাগার মালিক ও আলু চাষিদের প্রায় দুই হাজার ৫৩৯ কোটি ৮০ লাখ টাকার ক্ষতি হবে।

রংপুর বিভাগের কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও আলু চাষিদের কাছ থেকে জানা গেছে, দুই মাস পর নতুন আলু রোপণের মৌসুম। হিমাগারের আলু এখনই না বেচতে পারলে তা খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়বে। হিমাগারে পচে নষ্ট হবে।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় শাহ জালাল ও এ বি এল স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ প্রাইভেট লিমিটেড নামে দুটি হিমাগার রয়েছে। শাহ জালাল হিমাগারে এক লাখ ৭১ হাজার বস্তা ও এ বি এল কোল্ড স্টোরেজে এক লাখ ২০ হাজার বস্তা আলু মজুদ রাখা হয়েছে। প্রতিবছর এ সময়ে হিমাগারের বাইরে চাষি ও ব্যবসায়ীদের হুড়াহুড়ি দেখা যায়। কিন্তু এবারে চিত্র ছিল একেবারে ভিন্ন। আলু তুলতে আসছে না কেউ। বিগত বছরগুলোয় এই সময়ে ৭৫ শতাংশ আলু হিমাগার থেকে বেরিয়ে গেলেও এবারে ১৫ শতাংশও বের হয়নি।

স্থানীয় বাজারগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌসুমে প্রতি বস্তা (৮৫ কেজি) সাদা আলু ৯৫০ টাকা, গ্র্যানুলা ৬৫০ টাকা, শীল বিলাতি (স্থানীয় নাম) এক হাজার ৫০০ টাকা, কার্টিনাল ৯০০ টাকা, লাল পাকড়ী এক হাজার ১০০ টাকা ও ডায়মন্ড ৮৫০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। তার ওপর বস্তাপ্রতি পরিবহন খরচ ১১০ টাকা, হিমাগার খরচ ২৬০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাজারে বস্তাপ্রতি আলুর ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কমে গেছে। তবে পাইকারি বাজারে ধস নামলেও খুচরা বিক্রেতারা প্রতি কেজি আলু ১৮ থেকে ২৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে।

বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী কাজী ফজলুল হক বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে চার হাজার বস্তা আলু কিনে হিমাগারে রেখেছি। বর্তমানে প্রতি বস্তা ৭০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। হিমাগার ও পরিবহন ভাড়া মিলে বস্তায় ৪০০ টাকা লোকসান গুনতে হবে। ’

মধুপুর ইউনিয়নের ঘোনাপাড়ার চাষি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘নিজের জমিতে চাষ করা আলু আছে ৫০০ বস্তা। বাজার থেকে কিনে আরো তিন হাজার ৪০০ বস্তা হিমাগারে রেখেছি। প্রতি বস্তা আলুতে হিমাগার থেকে ৫০০ টাকা করে ঋণ নিয়েছি। কিন্তু এখন প্রতিদিন হিমাগারের লোকজন ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে। বাজারের অবস্থা এ রকম থাকলে বাড়ি ছেড়ে পালানো ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। ’

ব্যবসায়ী সফিয়ার রহমান বলেন, ‘৩০০ বস্তা সাদা আলু কিনে শাহ জালাল কোল্ড স্টোরেজে রেখে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। বাজার এ রকম থাকলে পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। ’

শাহ জালাল হিমাগারের তত্ত্বাবধায়ক প্রদীপ কুমার বলেন, ‘এর আগে ২০১৩ সালে আলু নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। এবার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবসায়ী আলু তুলতে আসেনি। এ কারণে আমরা চিন্তায় আছি। হিমাগার মালিকদের কোটি কোটি টাকা ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে হবে। ’

এ বি এল কোল্ড স্টোরেজের মালিক বাসুদেব দাস বলেন, ‘আলু ব্যবসায়ীদের তিন কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লোকসানের ভয়ে কেউ আলু তুলতে আসছে না। ’

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক স ম আশরাফ আলী বলেন, ‘গত মৌসুমে রংপুরে ৫৪ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন আলু চাষ হয়েছে। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলে ছোট ছোট কারখানা তৈরি করে আলুর চিপস প্যাকেটজাত করতে পারলে লোকসান থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যাবে। ’

রংপুরের হিমাগার ব্যবসায়ী, মোতাহার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘রপ্তানিকারকদের কাছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন না থাকায় রপ্তানি অলাভজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারি উদ্যোগে (বন্যার্ত এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে) ত্রাণ ও চালের সঙ্গে আলু বিতরণ করতে হবে। এ জন্য অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রাণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।