দেশের প্রধান রফতানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক শিল্পকে ঘিরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন প্রতিবেদন ফাঁস হয়ে গেছে। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয় ও বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। গুলশানে জঙ্গিহামলা করে বায়ারদের নৃশংসভাবে হত্যার পর বিশ্বজুড়েই তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন(ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্যে রফতানি-বাণিজ্যেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠা না গেলে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক গোপন প্রতিবেদনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এমন আশঙ্কাজনক বার্তাই দিয়েছে।
পোশাক খাত নিয়ে তৈরি করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব উম্মে সালমা সানজিদা স্বাক্ষরিত পাঁচ পাতার গোপন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অন্তত সাতটি চ্যালেঞ্জ। নিজ দেশের পোশাক খাতের জন্য ভারত প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বাংলাদেশ। এছাড়া ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসায় সংকটের মুখে পড়বে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়। এছাড়া পোশাক খাতের নতুন ক্রেতা আগমন এবং নতুন বাজার তৈরি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা, নতুন কারখানায় যথাসময়ে বিদেশি টেকনিশিয়ান না পাওয়া, পণ্যের অর্ডার কমে যাওয়াসহ এ খাতের যেকোনো নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পোশাক শিল্পে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ধরনের অঘটন (আগুন, ভবনধস ইত্যাদি) বিশ্বজুড়ে যে ভাবমূর্তির সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় বিদেশি নিহতের ঘটনায় বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্কতা জারি করে। ফলে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাভীতি ও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এখন বায়াররা পণ্যের অর্ডার প্লেস, আলোচনা বা চুক্তির জন্য এদেশে না এসে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং বা ভারতের মতো তৃতীয় কোনো দেশে উদ্যোক্তাদের যাওয়ার অনুরোধ করছেন। এতে পণ্যের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাবে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ভারতের মন্ত্রিসভা ওই দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে ছয় হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর পাশাপাশি দেশটি ২০১৮ সালে তৈরি পোশাক রফতানিতে ৪ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অপরদিকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চার হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ আগামী দুই বছরের মধ্যে ভারত আমাদের চেয়ে কমপক্ষে ৩০০ কোটি ডলার বেশি মূল্যের পোশাক রফতানির চেষ্টা করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে।
এতে বলা হয়, পোশাক খাতের ক্রেতারা বিদেশি। যদি দেশে জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে তাহলে তারা শঙ্কিত হয়ে বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। কারণ, তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনার সুযোগ নিয়ে প্রতিযোগী দেশগুলো এ দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে পোশাক খাতের বাজার তাদের দখলের চেষ্টা চালাতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তৈরি পোশাক খাতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ও শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। এরা শ্রমিক অসন্তোষের নামে বিশৃঙ্খল পরিস্তিতি তৈরি করে স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে সরকারকে চাপে ফেলার জন্য সর্বদা সক্রিয় রয়েছে। দেশি-বিদেশি এসব ষড়যন্ত্র বন্ধ না হলে ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
এ গোপন প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ টেলিফোনে পূর্বপশ্চিমকে বলেন, আমি এখনো পোশাক খাত নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোন প্রতিবেদন হাতে পাইনি। যদি এমন কোন ষড়যন্ত্রমূলক কাজের সঙ্গে দেশীয় কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েত উল্লাহ মামুন পূর্বপশ্চিমকে নিশ্চিত করেছেন যে, পোশাক খাতের ষড়যন্ত্র নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা গোপন প্রতিবেদনটি তাদের হাতে এসেছে। তবে বিষয়টি খুবই স্পর্ষকাতর হওয়ায় কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বপশ্চিমকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের উপসচিব উম্মে সালমা সানজিদা স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু গণমাধ্যমকে জানানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, পোশাক শিল্পে একটার পর একটা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যেসব দেশে আমাদের নতুন মার্কেট তৈরি হয়েছে, সেসব মার্কেটের ক্ষেত্রে সমস্যাটা বেশি। কেননা, বায়ারদের অর্ডার দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। কিন্তু এ সময়ই যদি তারা দেশ ছেড়ে চলে যান, সেটা পোশাক শিল্পের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। কারণ, বিদেশিরা গভীরভাবে জঙ্গি হামলার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছেন। তাই সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।