ঢাকা , বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীর মত প্রকাশের নিরাপত্তা ও নাগরিক সাংবাদিকতার দায়

নারীদের কি নিজের মত প্রকাশের অধিকার আছে? যদি বলি আছে তবে সেটা কতটুকু? এমন অনেক নারীই আছেন যারা ইচ্ছে করেই নিজের মত প্রকাশ করেন না। কারণ মত প্রকাশ করলে কিংবা পুরুষের মতের বিরুদ্ধে গেলে ক’জনের অবস্থা খাদিজার মতো হবে না একথা কেইবা বলতে পারে। খাদিজাতো বদরুলকে পছন্দ নয় বলে নিজের মত প্রকাশ করেছিল, আর এজন্যই আজ সে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আর যদি সে বদরুলে প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিত তবে হয়তা তাকে এখন আইসিইউতে বসে মৃত্যুর প্রহর গুণতে হতো না।

এই চিত্র দেখে ক’জন নারীই এখন নিজের মত প্রকাশের সাহস দেখাবেন? সঠিকভাবে অনুসন্ধান করলে এমন চিত্রও দেখা যাবে যে, এমন নারীও আছেন যারা নারী অধিকারের কথা বলে বাইরে বক্তৃতা শ্লোগান করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন কিন্তু তিনি নিজেও ঘরে মত প্রকাশ করার সুযোগ পান না। এ কারণেই হয়তো যুগ যুগ ধরে খাদিজাদের নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়।

ছেলেটির চরিত্রের সঙ্গে বদ লুকিয়ে আছে বলেই হয়তো তার নাম বদরুল। তার মানে এই নয় যে পৃথিবীর সব বদরুল-ই খারাপ। এখানে ভালো বদরুলদের সংখ্যা বেশি আর খারাপদের সংখ্যা নেহাতই কম। এর প্রমাণ খাদিজাকে সাহায্যকারী ইমরান। মুদ্রার এপিঠ যেমন আছে ওপিঠও আছে। বদরুলকে কেন আমরা শুধু ছাত্রলীগ বলে আখ্যায়িত করে নিজেদের দায় এড়াব? যেখানে দেশের সর্বাচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুকুম দিয়েছেন অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন তার সাজা হবেই সেখানে দলের বিষয়টি মূখ্য নয়। সবার আগ দেখতে হবে বদরুল মানুষ কি না। আশরাফুল মাখলুকাতের যে ন্যূনতম যোগ্যতা বিধাতা মানুষকে দিয়েছেন এর সিকিভাগও হয়তো বদরুলের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। না হলে মানুষ এত হিংস্র হয় কিভাবে?

বিশ্ব মিডিয়ার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বদরুল দেখিয়ে দিয়েছে মানুষরূপি কিছু কসাইও এ পৃথিবীতে বাস করে। আর সেই চিত্র গণমাধ্যমে কোনো সাংবাদিকদের ক্যামেরায় উঠে আসেনি। এসেছে হয়তো খাদিজার-ই পরিচিত কোনো বন্ধু, কিংবা পরিচিতজনের মুঠোফোনে। যারা খাদিজাকে রক্ষার চেয়ে ছবি তুলতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শুনলাম সিলেটের এমসি কলেজের কিছু প্রতক্ষ্যদর্শী বয়ান করছেন বদরুল খুব হিংস্র ছিল বলে তারা আগাতে সাহস পাননি। তাহলে খাদিজাকে হিংস্রভাবে কোপানোর পর তারা কিভাবে বদরুলকে ধরলেন? এতগুলো মানুষ মুহূর্তটি দেখছেন এবং ক্যমেরাবন্দী করছেন, তারা সবাই যদি একসাথে এগিয়ে আসতেন তবেও কি বদরুলের সঙ্গে পারতেন না? হয়তোবা তারা সে সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন।

ইদানীং সাংবাদিকদের পাশপাশি নাগরিক সাংবাদিকদের ভূমিকা গণমাধ্যমে বেশ প্রভাব ফেলছে। এখন অনেক সংবাদই সাংবাদিকদের আগে এসব নাগরিক সাংবাদিকরা সংগ্রহ করেন। এর বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে সময়ের ভার্চুয়াল মিডিয়াতে। এদের কারণেই আমরা দেখতে পাই খাদিজাকে নির্মমভাবে আঘাত করার দৃশ্য এমনকি খাদিজাকে আইসিইউতে দেখতে গিয়ে নারী নেতৃদের সেলফি তোলার দৃশ্যও। আর এতে যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো সব দায় এসে পড়ে সাংবাদিকদের ওপর। এসব সংবাদ প্রচারের পর একজন বিচক্ষণ সাংবাদিকও হয়ে যান হলুদ সাংবাদিক। সবাই তখন সাংবাদিকদের দোষ দেন এবং কেউ কেউ কিভাবে সাংবাদিকতা করতে হয় এসবও তর্জমা করেন। এটা নিয়ে টক শো হয় লেখালেখি হয় আরও কত কী যে হয়! সবশেষে সাংবাদিকদের সংবাদেরই কিন্তু সত্যতা মিলে। তবে কিছু কিছু নামসর্বস্ব পত্রপত্রিকার সাংবাদিকদের কথা/লেখা যদি গুণীজনেরা গ্রাহ করেন কিংবা রেফারেন্স দেন তবে এই দু’পক্ষের মধ্যে পার্থক্যটা আর থাকল কোথায়?

চিকিৎসকরা বলছেন, খাদিজার অবস্থা আশংকাজনক। এখনও তার বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না, তবে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করছি খাদিজা বেঁচে ফিরুক; কিন্তু এরপর? যে খাদিজা ফিরবে সে কি এমসি কলেজের প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘেরা ক্যাম্পসে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে? যে ট্রমা নিয়ে সে ফিরবে সেটাকে কি সুস্থ জীবন বলা যাবে? বেঁচে ফিরলে হয়তো খাদিজাকে এই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। তবুও আমরা চাই এই সুন্দর পৃথিবী থেকে একটি জীবন যেন ঝরে না যায়। এই আশা-ই বাঁচিয়ে রাখুক আমাদের। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন বদরুলদের মতিভ্রম কাটুক এবং তারা সত্যিকারের মানুষ হোন এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক; ই-মেইল: [email protected]

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

নারীর মত প্রকাশের নিরাপত্তা ও নাগরিক সাংবাদিকতার দায়

আপডেট টাইম : ০৬:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ অক্টোবর ২০১৬

নারীদের কি নিজের মত প্রকাশের অধিকার আছে? যদি বলি আছে তবে সেটা কতটুকু? এমন অনেক নারীই আছেন যারা ইচ্ছে করেই নিজের মত প্রকাশ করেন না। কারণ মত প্রকাশ করলে কিংবা পুরুষের মতের বিরুদ্ধে গেলে ক’জনের অবস্থা খাদিজার মতো হবে না একথা কেইবা বলতে পারে। খাদিজাতো বদরুলকে পছন্দ নয় বলে নিজের মত প্রকাশ করেছিল, আর এজন্যই আজ সে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আর যদি সে বদরুলে প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিত তবে হয়তা তাকে এখন আইসিইউতে বসে মৃত্যুর প্রহর গুণতে হতো না।

এই চিত্র দেখে ক’জন নারীই এখন নিজের মত প্রকাশের সাহস দেখাবেন? সঠিকভাবে অনুসন্ধান করলে এমন চিত্রও দেখা যাবে যে, এমন নারীও আছেন যারা নারী অধিকারের কথা বলে বাইরে বক্তৃতা শ্লোগান করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন কিন্তু তিনি নিজেও ঘরে মত প্রকাশ করার সুযোগ পান না। এ কারণেই হয়তো যুগ যুগ ধরে খাদিজাদের নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়।

ছেলেটির চরিত্রের সঙ্গে বদ লুকিয়ে আছে বলেই হয়তো তার নাম বদরুল। তার মানে এই নয় যে পৃথিবীর সব বদরুল-ই খারাপ। এখানে ভালো বদরুলদের সংখ্যা বেশি আর খারাপদের সংখ্যা নেহাতই কম। এর প্রমাণ খাদিজাকে সাহায্যকারী ইমরান। মুদ্রার এপিঠ যেমন আছে ওপিঠও আছে। বদরুলকে কেন আমরা শুধু ছাত্রলীগ বলে আখ্যায়িত করে নিজেদের দায় এড়াব? যেখানে দেশের সর্বাচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুকুম দিয়েছেন অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন তার সাজা হবেই সেখানে দলের বিষয়টি মূখ্য নয়। সবার আগ দেখতে হবে বদরুল মানুষ কি না। আশরাফুল মাখলুকাতের যে ন্যূনতম যোগ্যতা বিধাতা মানুষকে দিয়েছেন এর সিকিভাগও হয়তো বদরুলের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। না হলে মানুষ এত হিংস্র হয় কিভাবে?

বিশ্ব মিডিয়ার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বদরুল দেখিয়ে দিয়েছে মানুষরূপি কিছু কসাইও এ পৃথিবীতে বাস করে। আর সেই চিত্র গণমাধ্যমে কোনো সাংবাদিকদের ক্যামেরায় উঠে আসেনি। এসেছে হয়তো খাদিজার-ই পরিচিত কোনো বন্ধু, কিংবা পরিচিতজনের মুঠোফোনে। যারা খাদিজাকে রক্ষার চেয়ে ছবি তুলতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শুনলাম সিলেটের এমসি কলেজের কিছু প্রতক্ষ্যদর্শী বয়ান করছেন বদরুল খুব হিংস্র ছিল বলে তারা আগাতে সাহস পাননি। তাহলে খাদিজাকে হিংস্রভাবে কোপানোর পর তারা কিভাবে বদরুলকে ধরলেন? এতগুলো মানুষ মুহূর্তটি দেখছেন এবং ক্যমেরাবন্দী করছেন, তারা সবাই যদি একসাথে এগিয়ে আসতেন তবেও কি বদরুলের সঙ্গে পারতেন না? হয়তোবা তারা সে সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন।

ইদানীং সাংবাদিকদের পাশপাশি নাগরিক সাংবাদিকদের ভূমিকা গণমাধ্যমে বেশ প্রভাব ফেলছে। এখন অনেক সংবাদই সাংবাদিকদের আগে এসব নাগরিক সাংবাদিকরা সংগ্রহ করেন। এর বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে সময়ের ভার্চুয়াল মিডিয়াতে। এদের কারণেই আমরা দেখতে পাই খাদিজাকে নির্মমভাবে আঘাত করার দৃশ্য এমনকি খাদিজাকে আইসিইউতে দেখতে গিয়ে নারী নেতৃদের সেলফি তোলার দৃশ্যও। আর এতে যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো সব দায় এসে পড়ে সাংবাদিকদের ওপর। এসব সংবাদ প্রচারের পর একজন বিচক্ষণ সাংবাদিকও হয়ে যান হলুদ সাংবাদিক। সবাই তখন সাংবাদিকদের দোষ দেন এবং কেউ কেউ কিভাবে সাংবাদিকতা করতে হয় এসবও তর্জমা করেন। এটা নিয়ে টক শো হয় লেখালেখি হয় আরও কত কী যে হয়! সবশেষে সাংবাদিকদের সংবাদেরই কিন্তু সত্যতা মিলে। তবে কিছু কিছু নামসর্বস্ব পত্রপত্রিকার সাংবাদিকদের কথা/লেখা যদি গুণীজনেরা গ্রাহ করেন কিংবা রেফারেন্স দেন তবে এই দু’পক্ষের মধ্যে পার্থক্যটা আর থাকল কোথায়?

চিকিৎসকরা বলছেন, খাদিজার অবস্থা আশংকাজনক। এখনও তার বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না, তবে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করছি খাদিজা বেঁচে ফিরুক; কিন্তু এরপর? যে খাদিজা ফিরবে সে কি এমসি কলেজের প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘেরা ক্যাম্পসে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে? যে ট্রমা নিয়ে সে ফিরবে সেটাকে কি সুস্থ জীবন বলা যাবে? বেঁচে ফিরলে হয়তো খাদিজাকে এই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। তবুও আমরা চাই এই সুন্দর পৃথিবী থেকে একটি জীবন যেন ঝরে না যায়। এই আশা-ই বাঁচিয়ে রাখুক আমাদের। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন বদরুলদের মতিভ্রম কাটুক এবং তারা সত্যিকারের মানুষ হোন এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক; ই-মেইল: [email protected]