সমকাল :প্রথমবারের মতো ঢাকায় আইপিইউ সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট কী? এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্জনটাই-বা কী হতে পারে?
সাবের হোসেন চৌধুরী :প্রথমত, কোনো দেশ আইপিইউ সম্মেলনের আয়োজক হতে চাইলে আবেদন করতে হয়। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আবেদনটি বিবেচিত হয়। তবে আইপিইউর সভাপতি হিসেবে আমি নিজেও চেয়েছি আয়োজনটা একবার বাংলাদেশে হোক। সব মিলিয়েই ১৩৬তম আইপিইউ সম্মেলন বাংলাদেশে হচ্ছে। এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন বাংলাদেশে হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিশেষ তাৎপর্য আছে। এ সম্মেলনে প্রায় ১৭১টি দেশের প্রতিনিধিরা আসছেন। এর মধ্যে ৯৫টি দেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকাররা থাকছেন। খুব সাধারণ বিষয় হচ্ছে, সংসদ সদস্যরাই একটি দেশের সাধারণ মানুষকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। এখন যে বিশ্ব বাস্তবতা, তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পরিসর পেরিয়ে সংসদ সদস্যরা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার প্রতিনিধিত্ব বিস্তার করছেন কিংবা করার সুযোগ পাচ্ছেন। আর সেই সুযোগটা তৈরি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে আইপিইউ। এবারের সম্মেলনে বিশ্বের এত দেশ থেকে সংসদ সদস্যরা আসবেন। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ থেকে শুরু করে বিশ্বের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, লৈঙ্গিক অসমতা, নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত বিবর্তনসহ প্রায় বিদম্যান সব আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়েই কথা বলবেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের নতুন মহাসচিব দায়িত্ব নেওয়ার বাস্তবতায় বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হবে। এর ফলে এসব বিষয়ে আমাদের দেশের সংসদ সদস্যরা জানতে পারবেন। সাধারণ মানুষও বিষয়গুলো সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাবেন। সবচেয়ে বড় কথা, এত বড় সম্মেলনের আয়োজক দেশ হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন একটি পরিচিতি পাবে; বড় পরিসরে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হবে। এতটি দেশের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য ও সম্ভাবনার কথা জানবেন। এটাই কিন্তু দেশের জন্য অনেক বড় অর্জন।
একাত্তরের ৯ মাসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাচ্ছে বাংলাদেশ। এ সম্মেলন থেকে সে বিষয়ে কিছু অর্জন সম্ভব কি?
সাবের :দেখুন, এখন বিশ্বে কূটনীতির ধারণায় অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। বিশেষ করে সংসদীয় কূটনীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে অবশ্যই বাংলাদেশ বড় আকারে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাবে। এ ক্ষেত্রে সংসদীয় কূটনীতিই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে। কারণ প্রতিটি দেশে জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে জাতীয় সংসদ। আর সংসদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সংসদ সদস্যদের সিদ্ধান্তে। কারণ তারাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। এবারের ঢাকা সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরা হবে। আমাদের সংসদ সদস্যরাও অন্যান্য দেশের সংসদ সদস্যদের সঙ্গে এ নিয়ে নিবিড়ভাবে মতবিনিময়ের সুযোগ পাবেন। ফলে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সংসদীয় কূটনীতির বড় সুযোগ কিন্তু করে দিচ্ছে এবারের আইপিইউ সম্মেলন।
সংসদীয় কূটনীতি কি অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভাব রাখতে পারে?
সাবের :অবশ্যই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ সহায়তা, উন্নয়ন, নিরাপত্তা- বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এখন যে কোনো বিষয়েই আলোচনা হোক না কেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রতিটি দেশকেই জাতীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেই সিদ্ধান্ত তো জাতীয় সংসদই নেয়। ফলে সংসদীয় কূটনীতি সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক প্রভাব তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে । আর আইপিইউ সংসদীয় কূটনীতির সবচেয়ে বৃহৎ ও কার্যকর প্ল্যাটফরম। ফলে আইপিইউ’কে ঘিরে সংসদীয় কূটনীতি বিস্তৃত করতে পারলে তা দেশের জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও অনেক বড় সাফল্য এনে দেবে- সন্দেহ নেই। আর একটা বিষয় ভেবে দেখুন, বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন নেই। বিশেষ করে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ দেশেই আমাদের কূটনৈতিক মিশন নেই। সেসব দেশ কিন্তু আইপিইউর সদস্য। এবারের সম্মেলনেও সেসব দেশের প্রতিনিধিরা আসছেন। ওইসব দেশের সঙ্গে কৌশলগত কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে একমাত্র ভূমিকা রাখতে পারে আইপিইউ এবং এর মাধ্যমে সংসদীয় কূটনীতি।
এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য কী?
সাবের : এবারের মূল প্রতিপাদ্য ‘রিড্রেসিং ইনইকুয়ালিটিজ :ডেলিভারিং অন ডিগনিটি অ্যান্ড ওয়েলবিং ফর অল।’ এক কথায় বলতে পারি, বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্যগুলোকেই তুলে ধরা হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বত্রই দিন দিন বৈষম্য বাড়ছে। কেন বৈষম্য বাড়ছে- এ নিয়ে বিতর্ক হবে। বিতর্কে অংশ নেওয়ার জন্য শান্তিতে নোবেল বিজয়ী কল্যাণ সত্যার্থীও এ সম্মেলনে অংশ নেবেন।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনেই বিশ্বে সম্পদের অসম বণ্টন দূর করতে হবে, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আলোচনাতেও বিশ্বে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ার কারণে উদ্বেগের বিষয়টি এসেছে। এবারের আইপিইউ সম্মেলন থেকে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে আনার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্যরা মত দেবেন। এ ব্যাপারে একটি সর্বসম্মত ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হবে এবং প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে তা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এর ফলে বিশ্বে বৈষম্য দূরীকরণে একটা বড় পদক্ষেপের সূচনা এখান থেকেই হতে পারে।
:জাতিসংঘের বর্তমান ভূমিকা বিবেচনায় আইপিইউর গুরুত্ব কতটুকু?
সাবের :আইপিইউর যাত্রা কিন্তু জাতিসংঘেরও আগে। জাতিসংঘের ভূমিকা এখন সর্বব্যাপী। অবশ্যই আন্তর্জাতিক পরিসরে জাতিসংঘই সাধারণভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই জাতিসংঘই কিন্তু স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, মানবাধিকার রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আইপিইউর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতিসংঘের গত সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। সেই আলোকে জাতিংসঘ এবং আইপিইউ এখন একসঙ্গে কাজ করছে। বিশ্বে স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় সহায়ক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরম আইপিইউ।
যুক্তরাষ্ট্র তো আইপিইউর সদস্য নয়। এ বিষয়টি কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
সাবের :যুক্তরাষ্ট্র আইপিইউর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে তারা আইপিইউতে থাকা যৌক্তিক মনে করেনি। তারা বলল, সদস্য অনেক দেশে গণতন্ত্র নেই। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের থাকার যৌক্তিকতা কোথায়? মূলত, তারা কিউবার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে এবং আইপিইউ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। যাহোক, এখন বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গেছে। কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেও পরিবর্তন এসেছে। জোর দিয়ে বলতে চাই, আইপিইউর শক্তিটা হচ্ছে জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে মতপার্থক্য থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে সম্পর্কের টানাপড়েন থাকতে পারে। কিন্তু আইপিইউ সংসদ সদস্যদের মধ্যে মেলবন্ধনের সৃষ্টি, জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক তৈরি করে। এ কারণেই আইপিইউ আন্তর্জাতিক পরিসরে তার নিজস্ব গুরুত্ব ধরে রেখেছে। এখানে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের প্রভাব বিবেচ্য হয়নি।
এবারের আইপিইউ সম্মেলন ঘিরে কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
সাবের :আয়োজক দেশের জাতীয় সংসদই সাধারণত নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিরাপত্তা-সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ নিরাপদ পরিবেশে সাফল্যের সঙ্গে এবারের সম্মেলন সম্পন্ন করা যাবে- এ ব্যাপারে আমি দৃঢ় আশাবাদী। সমকাল