বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূরণ হয়। তবে এ স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদ আর দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটে। এখন চলছে স্বাধীনতার স্বাক্ষর বিজয়ের মাস ডিসেম্বর।
বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা।
অর্জন করে নিজস্ব ভূখণ্ড আর সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা। বিজয়ের ৪৫টি বছর পার করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকরা। এতটা বছর পার করে বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশের মানুষ এই বিজয় দিবসকে নিয়ে কে কী ভাবছেন, আমাদের শিল্পীদের ভাবনাটাই বা কী?
স্বাধীনতা আর দেশপ্রেম নিয়ে এবার কথা হয় দেশের খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী ও সামাজিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে। তিনি জানান স্বাধীনতা নিয়ে নানান ভাবনা চিন্তা ও স্মৃতির কথা।
স্বাধীনতার পর চার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এবং সাধারণ নাগরিকেরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেটি ঠিক সময়ের সাথে সাথে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে এবিষয়ে জানতে চাইলে ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, আর আমার এতে অংশগ্রহণও ছিল। যুদ্ধের আগের অংশটাও আমার জানা আছে। যুদ্ধের আগে আমরা অন্য জাতি দ্বারা শাসিত হচ্ছিলাম। তারা বিভিন্নভাবে আমাদের অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে। কিন্তু সে জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা স্বাধীন একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাওয়ার মনোবাসনা আমাদের মনের মধ্যে কাজ করত। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই একত্র হয়ে আন্দোলন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের ঝাঁপিয়ে পরেছি। আর পাকিস্তানি বাহিনী এরইমধ্যে অনেক মানুষ মেরে ফেলেছিল। তখন সাধারণ মানুষেরা ভেবেছে মরবোই যখন, মেরে মরব। সে জায়গা থেকে আমার প্রায়শই মনে হয় যে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছে। কারণ একটি সময়ের শেষে যারা স্বাধীন দেশ থেকে কিছুই পেলো না। দেশকে নিয়ে তাদের যে স্বপ্নটা ছিল, সেটি যদি আমরা অন্তত পূরণ করতে পারতাম, তাহলে তাদের জন্য কিছু হলেও করতে পারতাম। আর এখন স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হলেও আমরা কাঙ্খিত সেই স্বাধীনতাটা পাইনি। মাঝেমধ্যেই মনে হয় নিজের দেশে নিজেই পরাধীন হয়ে আছি। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের যে মারমুখি মনোভাব দেখলে তো মনে হয় না আমরা কোন স্বাধীন দেশে আছি। সারা বাংলাদেশের মানুষের যে স্বাধীনতা সেটি এখনও আমার মধ্যে অনুভূত হয়নি। শুধু কিছু মানুষের জন্য দেশটা স্বাধীন মনে হলেও সত্যিকার অর্থে দেশের সমস্ত মানুষের জন্য দেশটি স্বাধীন হয়নি। স্বাধীনতার সুফল কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ভোগ করছে। সেই স্বাধীনতা আসলে কবে অর্জিত হবে তা আমি জানি না। বিশেষ করে সকলের জন্যে মৌলিক চাহিদার যোগান তো দিতে হবে।’
যারা দেশের একদম সাধারণ মানুষ, তাদের মধ্যে এতো জটিল ভাবনা কাজ করে না। তারা নিজের অবস্থান থেকে নিজের মত করে দেশকে ভালোবাসে। তাদেরকে তো কাছ থেকে আপনার দেখার সুযোগ হয়, তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের বিষয়টা কেমন বলে আপনার মনে হয় জানতে চাইলে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘দেশপ্রেমের জন্য সবার আগে নেতার প্রয়োজন হয়। যারা দেশ পরিচালনা করেন তাদের চিন্তাধারার ওপর অনেকখানি বিষয় নির্ভর করে। আর দেশ প্রেমের যে স্পৃহা, সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে দুর্নীতি। আর যারা একেবারে সাধারণ মানুষ, তাদের ভাবনাটা অনেক সহজ-সরল। এতো জটিল করে তাদের বিষয়গুলো ভাবায় না।
আপনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, বিষয়টা ঠিক কিভাবে অনুভব করেন, কিংবা পাকবাহিনীর নির্যাতনের ভিডিও দৃশ্যগুলো দেখার সময় আপনাকে ঠিক কতটুকু যন্ত্রণা কিংবা কষ্ট দেয়? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ প্রথম কথা হলো যে-এটা একটা সম্মানের বিষয়। সে জায়গায় আমাদের মা-বোনদেরকে তারা অসম্মান করেছে। একটি নারীর কেউ যদি সম্ভ্রম লুট করে, সে নারী তার জীবনটাই রাখতে চায় না। যারা জীবন না দিয়ে বেঁচে আছে তারা কত কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে তা কি বোঝা যায়? আমি বিষয়টা অনুভব করতে পারি, তারা ঠিক কতটা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে।
ব্যক্তি ইলিয়াস কাঞ্চনের দিক থেকে দেশপ্রেমের বিষয়টা আপনার দৃষ্টিতে কিংবা ভাবনায় ঠিক কেমন? এবিষয়ে তিনি জানান,’ আমি বিষয়টা এভাবে দেখি- আমি দেশকে কি দিলাম। কিন্তু আমাদের দেশের মুষ্টিমেয় মানুষের উল্টো চিন্তা। সবাই বলে আমাকে দেশ কি দিল? দেশ দিয়েছে বলেই তো আমরা সুস্থ আছি, খেতে পারছি, কাজ করতে পারছি, অর্থ উপার্জন করতে পারছি। আজ এতো সুযোগ-সুবিধা শুধু দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই পাচ্ছি। কারণ আমি তো পাকিস্তান আমলে দেখেছি, আমাদের অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল না। দেশ যদি স্বাধীন না হতো আমি ইলিয়াস কাঞ্চন হতে পারতাম কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে! দেশটাকে ভালো রাখার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই সে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পথ চলা উচিত। আমরা ব্যক্তিগতভাবে সবাই লাভবান হতে চাই কিন্তু দেশকে কিছু দিতে চাই না। এ ধরনের চিন্তা থেকে বের হয়ে আসা উচিত।
একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে আপনি একজন অভিনেতার পরিচয়ের বাইরে গিয়ে দেশের জন্য ভিন্ন কিছু কি করতে চান? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সে চেষ্টা কিংবা ইচ্ছে দুটোই আমার আছে। আমি আমার মতো করেই দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। আমি ভাবি এভাবে- যে যার অবস্থান থেকে দেশের জন্য কিছু করলেই দেশটা এগিয়ে যাবে। সে সুযোগ আসলে আমি রাজি আছি।
এবারের বিজয় দিবস নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের ভাবনা কি জানতে চাইলে তিনি জানান, বিজয় দিবসে তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হয়। তখন আমি স্বাধীনতার যে মর্ম সেটি বোঝানোর চেষ্টা করি। তারা যেন দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়। আমি চেষ্টা করি দেশপ্রেম যেন মানুষের মধ্যে জাগে। তরুণ প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি, তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করি অনেক কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আমাদের দেশটি যদি ভালো থাকে তাহলেই আমরা সকলে ভালো থাকব। যে মুক্তিযোদ্ধরা জীবন দিয়ে গেছে তাদের সে ত্যাগের কথা মনে রেখে দেশের জন্য কিছু করা প্রয়োজন।
সবশেষ তিনি এই বিজয়ের মাসে সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী জানিয়ে দেশবাসি সকলকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানান এবং সকলের নিরাপদ জীবন ও সু-স্বাস্থ্য কামনা করে সড়ক পথে সাবধানে চলার আহবান জানান।