ওরে আবার ঢলের বন্যা হলো এবং নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল ডুবিয়ে দিল। ডুবে যাওয়া অনেক এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ছিল, অনেক জায়গায় ছিল না। যেখানে ছিল সেগুলো ডুবো বাঁধ, উচ্চতা ৬.০৩ মিটার থেকে ৬.৫০ মিটার। ঐসব বাঁধ অল্প মাত্রার বন্যা ঠেকানোর জন্যে কার্যকর। উচ্চ মাত্রার বন্যা যেসব বাঁধ ছাপিয়ে ভেতরে ঢুকে ফসল ডুবিয়ে দেয়। এবার সুনামগঞ্জে বন্যা এসেছে ৮.১০ মিটার উচ্চতার। অভিযোগ এসেছে বাঁধগুলো ঠিকমত মেরামত করা হয়নি, দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু যা ক্ষতি হবার তা’ হয়েছে। দায়ী যদি হয়ে থাকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা বা মেরামত কাজে নিয়োজিত ঠিকাদাররা তারা কি শাস্তি পাবে?
সারণি ১ : সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে বাঁধের উচ্চতা (তথ্যসূত্রঃ পাউবো)
হাওরসমূহের নাম বাঁধের ডিজাইন
উচ্চতা (মিটার)
কালনার হাওর ৯.১০
করচার, আঙ্গুরালী হাওর ৯.১০/৭.১০
শাংগাই, নালুয়া, খাই, জামখোলা, ৭.৫০
নানদাইর, দেখার, কাচিভাঙ্গা
জোয়ালভাঙ্গা, কালিকূটা, টাঙ্গুয়ার, ৭.৪০
বোরাম, উদগল, ভান্ডা হাওর
শনির, চাপতির হাওর ৭.৩০
চন্দ্রসোনা, ধানকুনি হাওর ৬.৩৪
মাতিয়ান, মহালিয়া, হালি, গুরমের, ৬.১০
পাগনা, জয়ধূনা হাওর
সোনামড়ল হাওর ৬.০৩
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড হাওর অঞ্চলে তার বাঁধগুলিকে ডুবো ডিজাইন করে বন্যার মুখে ঝুঁকিপূর্ণ করে রেখে ভুল করেছে বলা যায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বিগত শতকের ষাটের দশকে, যখন তা’ অবশ্যই সঠিক ছিল। ঐ সময় হাওর অঞ্চলে স্থানীয় জাতের বোরো ধান আবাদ হতো যা’ এপ্রিল মাসের আগেই উঠে যেত। ওসব ধানের জীবিতকাল ছিল নভেম্বর/ডিসেম্বর মাস থেকে ১৩০-১৪০ দিন। আশির দশকে উচ্চফলনশীল বোরো আসে এবং এরপর আসে হাইব্রিড ধান যার জীবিতকাল ১৫০ থেকে ১৬৫ দিন। এই জাতের ধানে ফলন অনেক বেশি হয়, কিন্তু হাওর অঞ্চলে এই ফসল মে মাসের ১৫ তারিখের আগে তোলা যায় না।
নাম/ জাতের জীবনকাল উত্পাদন হাওরে
কোড মোট দিন মেট্রিক টন/হে উপযোগী হাঁ/না
টোপা/রাধা ১৩০-১৪০ ৩.৫-৪.০ হাঁ
বিআর-১৪ ১৪৫-১৬০ ৫.০-৬.০ না
বিআর-১৫ ১২০-১২৫ ৪.০-৫.০ হাঁ
বিআর-১৬ ১৪৫-১৬৫ ৫.০-৬.০ না
বিআর-১৭ ১২৫-১৩৫ ৪.০-৫.০ হাঁ
বিআর-১৮ ১২৫-১৩৫ ৪.০-৫.০ হাঁ
বিআর-১৯ ১২৫-১৩৫ ৪.০-৫.০ হাঁ
বিআর-২৯ ১৫০-১৬৫ ৬.০-৬.৫ না
সারণি ২ : বোরো মৌসুমের ধান
হাওর অঞ্চলে উচ্চমাত্রার ঢলের বন্যা কখনো কখনো এপ্রিল মাসেই এসে যায়, যখন মেঘালয়/ত্রিপুরার পাহাড়ে অথবা বরাক উপত্যকায় অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয় এবং ঢলের বন্যায় অনেক হাওরের ফসল ডুবে যায়। ব্যাপারটা হলো, কুশিয়ারা, সুরমা ও কংস উপত্যকায় বর্ষাপূর্ব যে কোনো ভারী বৃষ্টিপাতের পানি টাঙ্গুয়ার হাওর সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলকে লক্ষ্য করে এগোয়, তারপর দক্ষিণে সাগরের দিকে গড়ায়। বাংলাদেশে গড় বাত্সরিক বৃষ্টিপাত ২৩০০ মিলিমিটার হলেও সুনামগঞ্জে হয় ৫৫০০ মিলিমিটার। তাই মার্চের শেষে বা এপ্রিল মাসের গোড়ায় বড় ধরনের বৃষ্টিপাত হওয়া এবং সেই কারণে হাওরগুলোর ফসল ডুবে যাবার সম্ভাবনা থাকে খুবই বেশি।
ব্যাপারটা বুঝতে হলে জানতে হবে যে, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সবচেয়ে নিচু এলাকা। আদিকালের এক ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে এলাকাটি ক্রমশ ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দেবে যায়। খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের দক্ষিণ বরাবর ‘ডাউকি চ্যুতি’ এই পরিবর্তনের সাক্ষী। কংস ও সুরমা উপত্যকার এই দেবে যাওয়া অঞ্চলটি একই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং অন্যান্য নদী দ্বারা আগত পলির মাধ্যমে পূরণ হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের পর এই ভরাট প্রক্রিয়া হ্রাস পায়। অতীতে বঙ্গোপসাগরের তীরভূমি মেঘালয়ের পাদদেশে এসে ঠেকত। বর্তমানে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা সমুদ্রতল থেকে গড়ে ২ থেকে ৪ মিটার উঁচু।
বাংলাদেশের মানুষ হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসল ডোবার জন্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিকে দায়ী করেন। দুর্নীতি কোথায় নেই? তবে দুর্নীতি হোক বা না হোক, যেসকল প্রকল্পে বাঁধের উচ্চতা কম ছিল বা বর্ষাকালে যেসকল প্রকল্পের বাঁধ ডুবে যাবার, সেসকল প্রকল্পে বন্যার পানির এই উচ্চতার কারণে বাঁধ ডুবত, ধানও ডুবত। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রহ্মণবাড়িয়ায় যেখানে হাওরের ফসল ডুবেছে সেখানে অধিকাংশ বাঁধই পানি উন্নয়ন বোর্ডের নয়, এবং সেখানে বাঁধের উচ্চতা কম ছিল। তাহলে করণীয় কি? আমরা কি হাওরের ফসলকে ঝুঁকির মধ্যেই রাখব নাকি কোনো সমাধানের পথ খুঁজব? একথা স্পষ্ট যে, ঢলের বন্যার ঝুঁকি যদি এড়াতে হয় তাহলে এপ্রিল আসার আগেই আমাদেরকে ফসল তুলে নিতে হবে। এই ব্যবস্থায় হাইব্রিড ধানের পরিবর্তে স্থানীয় উচ্চ ফলনশীল ধান লাগাতে হবে, এবং তাতে ফলন কম হবে। আর যদি হাইব্রিডই লাগাতে চাই তা’হলে বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে হবে। আমি মনে করি সারা দেশব্যাপী হাইব্রিড ধানের যে প্রভাব তাতে আমাদের ফসল বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চট করে তা’ বন্ধ করা বা বিকল্প ফসল বৈচিত্র্য অভ্যাস করা সম্ভব নয়। তাই বাঁধকেই উঁচু করতে হবে। আমি এটাই ২০০৫ সাল থেকে বলে আসছি। কিন্তু যা হয়, আমাদের সেবা প্রদানকারী সরকারি সংস্থাগুলো সহজ সমাধানের পথে যায় না, বরং সমস্যাকে জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী করে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। এখানেও তাই হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে কনসালট্যান্ট লাগায়, যারা সমস্যাকে আরো জটিল করে যে রিপোর্ট দেয় তা কাজে লাগে না। সমস্যা বরং সময়ের ব্যবধানে আরো বাড়ে। পরিবেশবাদীরাও না বুঝে হৈচৈ করে চলে।
হাওরের সমস্যা সমাধান করতে হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তার পুরনো অকার্যকর দর্শন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজেদের বাঁধ বা স্থাপনা রক্ষা কেবল নয় জনগণের ফসল ও সম্পদ রক্ষার জন্য নীতি পরিবর্তন করতে হবে। আজ অনেক পরে হলেও দেশের দু’টি বড়ো জেলা কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর বসেছে। এই দু’টি জেলার চাষিরা নিজেরা বাঁধ নির্মাণ করে ফসল ঠেকাবার চেষ্টা করে। এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আর যা করতে হবে তা হলো বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো। আমি জানি যেসকল বাঁধের উচ্চতা বেশি সেগুলো ডোবেনি। আর ডুবো বাঁধের দর্শন দুর্নীতির দর্শন। ডুবো বাঁধ মানেই দরিদ্র কৃষকের জীবন ও সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। ধান বাঁচলে বাঁচব, ডুবে গেলে মরব। অথচ পাশেরই একটি প্রকল্পের মতো বাঁধটি উঁচু করলে তাদের ধান ডোবে না। কী দুর্ভাগ্য আমাদের, যখন কোটি কোটি হাওরবাসীর ধান ডুবছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের রিপোর্টে বন্যা নেই। সুরমা, কুশিয়ারা ও কংস উপত্যকায়, অর্থাত্ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর অঞ্চলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যার লেবেল তাই অবশ্যই পাল্টাতে হবে।
হাওর তথা জলাভূমি সংরক্ষণ করার মূল উদ্দেশ্য এর জীবপরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখা, ফসল রক্ষা করা ও মাছের প্রাচুর্য ফিরিয়ে আনা। এব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বাধা আসে পরিবেশবাদীদের তরফ থেকে। তারা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করেন। আমার কথা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জনগণের চলাচলের সুবিধার জন্যে পোল্ডারগুলোর বাঁধগুলোকে বছর বছর মেরামতযোগ্য না করে স্থায়ীভাবে নির্মাণ করতে পারে। তবে ফসল কাটা হয়ে গেলে বাঁধের মুখ কেটে দিয়ে হাওরগুলোর ভেতরে বন্যার পানি প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। আমার প্রস্তাব হাওরগুলিকে স্থায়ীভাবে বন্যামুক্ত করার পক্ষে নয় বরং দুর্নীতির সুযোগ দূর করে হাওরের ফসল রক্ষা করার। এর ফলে হাওর তথা জলাভূমির জীবপরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে ও ফসল রক্ষা করে মাছের প্রাচুর্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। লেখক :প্রকৌশলী, চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইন্সটিটিউট