উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন উত্তর কোরিয়াকে যুদ্ধের কিনারায় এনে উপস্থিত করেছেন। আমেরিকার রণতরীর বহর এখন কোরিয়া উপকূলে অবস্থান নিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার যুদ্ধ সম্পর্কীয় কৌশলীদের রণকৌশল নির্ধারণের কথা বলেছেন।
কয়দিন আগে চীনের প্রেসিডেন্ট যখন ওয়াশিংটন সফরে গিয়েছিলেন তখন ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে চীনের প্রেসিডেন্টের সাহায্যে চেয়েছেন। অবশ্য ট্রাম্প এও বলেছেন চীন যদি সাহায্য না করে তবে আমেরিকা একাই তাকে শায়েস্তা করার উদ্যোগ নেবে। আমেরিকার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের সশস্ত্র-বাহিনীও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে রযেছে।
কিম জং উন সবচেয়ে বড় হুমকি তৈরি করেছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের জন্য। কারণ তার ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটের মাঝে উভয় রাষ্ট্রের অবস্থান। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের অবস্থান ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়া পঞ্চম বারের মতো পরমাণু বোমার পরীক্ষা করেছে। এবার ষষ্ঠবারের মত পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে।
তথ্য উপাত্ততে আমেরিকা নিশ্চিত হয়েছে যে আমেরিকায় আঘাত হানতে পারে অনুরূপ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে উত্তর কোরিয়া সক্ষম হয়েছে। এ সংবাদ আমেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরে তার মিত্রদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি করেছে।
উত্তর কোরিয়া দরিদ্রদেশ। তার সঙ্গে চীনসহ কয়েকটা ক্ষুদ্র দেশের ব্যবসা রয়েছে। জাতিসংঘ অবরোধ স্থাপনের পরও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে তাকে বিরত করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যয়বহুল এ অস্ত্র তৈরির টাকা পাচ্ছে কিভাবে তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। অবশ্য উত্তর কোরিয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা জড়িত তারা অনেকটা মাফিয়া চক্রের মত। মাদকদ্রব্য পাচার, মুদ্রা জাল করা, ডিপ্লোম্যাটিক চালানে কেমিক্যাল উইপন পাচার, হ্যাকিংসহ সব অনৈতিক কাজে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রই জড়িত থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশের যে মুদ্রা নিউইয়র্ক রিজার্ভ ব্যাংক থেকে হ্যাকিং হয়েছিলো তাতেও নাকি উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় হ্যাকাররা জড়িত ছিলো। এমন একটি রাষ্ট্রের উত্থান বিশ্বব্যবস্থার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরাইলও কারও কথায় কর্ণপাত না করে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হয়েছে কিন্তু তাদের আচরণ মাফিয়া চক্রের মতো নয়। দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান বিশ্বের দুটি শক্তিশালী শিল্প উন্নত রাষ্ট্র।
এ দুই রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে আনবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার মতো মজবুত অর্থনীতির মালিক হওয়ায় যে কোনও সময় অস্ত্র তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু উভয় রাষ্ট্র সে পথে অগ্রসর হয়নি। অথচ এ দুই রাষ্ট্রই এখন হুমকির সম্মুখীন। তারাই হবে উত্তর কোরিয়ার আক্রমণের প্রথম শিকার।
জাপানের দুটি শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় আনবিক বোমার আঘাতে বিধ্বস্থ হয়েছিলো। জাপান ছাড়া আর কারও আনবিক বোমায় বিধ্বস্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। ১৫ কিলো টনের বোমা পড়েছিলো হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে। তেমন বোমা আঘাত করলে প্রথমে বোমার কেন্দ্রের ২০০ গজের মধ্যে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায় আর তার দুই কিলোমিটারের মাঝে সবকিছু পুড়ে যায়। কয়েক কিলোমিটার জুড়ে মানুষের চামড়ার তৃতীয় স্তর পুড়ে যাবে কারণ বোমা ফেলার পর আকাশে যে অগ্নিগোলক তৈরি হয়েছিল এটা তারই ফল। লাখ দুয়েক মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে লাখ দুয়েক মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে আর এ অসুস্থ মানুষের কাতরানিতে আকাশ ভারি হয়ে উঠবে।
হোয়াইট হাউসের বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর মাঝে কোরিয়াকে নিয়ে কি কূটনৈতিক সমঝোতা হয়েছে জানি না তবে চীনের উচিৎ কোরিয়ার পাগলটাকে সালাম দেওয়া। নয়তো চীনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারণ উত্তর কোরিয়া চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দারিদ্রপীড়িত লক্ষ লক্ষ কোরিয়ার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে চীনে ঢুকে যাবে। আনবিক অস্ত্র দিয়ে উভয়কে উভয় আঘাত করলে আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজ হয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিন্তু আনবিক বোমার আঘাতে উত্তর কোরিয়ার লাখ লাখ লোক প্রাণ হারাবে। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার জনপথ জনমানব শূন্য হয়ে যাবে।
আজকের বিশ্বের উদ্বেগের বিষয় হয়েছে আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার মুখোমুখী অবস্থান। এক খবরে দেখলাম আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজের পেছনে পেছনে নাকি চীন ও রাশিয়ার গোয়েন্দা ডুবুরি জাহাজ অনুসরণ করছে। এ কথা শুনে পিলে চমকে উঠেছে। কারণ, এ তথ্যটা নাকি জাপান দিয়েছে। তাদের সরবরাহ করা তথ্য তো ভুল হতে পারে না। আবার রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে হামলার ব্যাপারে আমেরিকাকে সতর্ক করেছে। ডুবুরি জাহাজের অনুসরণের কথা সত্যি হলে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া চার আনবিক শক্তিধর রাষ্ট্র এখন কোরিয়ান উপকূলে উপস্থিত হয়েছে। এটা একটা ভয়াবহ চিত্র।
আমেরিকার ইউএসএস কার্ল ভিশন পরিপূর্ণ যুদ্ধের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। যে সীমাহীন শক্তিধর মানুষগুলো আনবিক যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে বলছে তা কিন্তু শান্তিকামী বিশ্ববাসীর নাভিশ্বাস উঠছে। এ শক্তিগুলোর সামান্য ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলে বিশ্ব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে।
রাজনীতি এখন অভিজাত রাজনীতিবিদের হাতে নেই। মাফিয়া চক্রের মতো কিছু লোকের হাতে রাজনীতি এবং আনবিক শক্তি গিয়ে পড়েছে। এ কারণেই এত ভীতি।
চীন একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথায় তেমন আত্মবিশ্বাসের একটা সুর উপলব্ধি করেছি।
কোরিয়া টাইমস বলেছে চীনের একটা পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ দল নাকি উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে উত্তর কোরিয়াকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। চীনের এ উদ্যোগ কাজে আসবে বলে অনেক সামরিক বিশ্লেষক আশা করছে। উত্তর কোরিয়া চীনের কাছে নিজ দেশের নিরাপত্তার দাবী জানিয়েছে। অনেকে মনে করছেন চীনের কাছ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস ফেলে হয়তবা উত্তর কোরিয়া তার পরমাণু প্রকল্প থেকে সরে আসতে পারে।
আনিস আলমগীর : সাংবাদিক ও শিক্ষক
anisalamgir@gmail.com