দক্ষিণে দেশখ্যাত বঙ্গবন্ধু সেতু। পশ্চিমে যমুনা নদী আর সিরাজগঞ্জ জেলা। উত্তরে যমুনার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। পূর্বে টাঙ্গাইল জেলা। এর মধ্যে ভূঞাপুর উপজেলার অর্জুনা আর গাবসারা ইউনিয়নের কয়েকটি চরের অবস্থান।
যমুনার পলিবাহিত এইসব চর যমুনা নদী বেষ্টিত। মাঝখানে বড় দুটি ইউনিয়নে বসতি গড়ে উঠেছে অনেক আগেই। যদিও বর্ষায় থাকে থৈথৈ জল। উজান থেকে নেমে আসা ¯্েেরত চরগুলো ডুবে যায় বিশাল জলরাশিতে। নৌকায় এপার ওপার যাতায়াত করতে হয় জনপদের মানুষকে। আর শুকনো মৌসুমে চরাঞ্চলের উর্বর ভুমি ফুঁসে উঠে বৈচিত্র্যময় ফসলে। যেন সবুজের সমারোহ।
পলিবাহিত হওয়ার কারণে চরের উর্বরতা শক্তি অনেক বেশি। যে কারণে ওই মৌসুমে চরে চরে ভুট্টা, বাদাম, আলু, মাসকালাই, মরিচ, মুলা, শিম, লাউ, জিরা, সজ, পেয়াজ, রসুন, গম, কাউন ইত্যাদি ফসলের ব্যাপক চাষ হয়। নানা ফসলে দিগন্ত জুড়ে দেখা যায় সবুজের সমারোহ। চরের বাড়িগুলোর প্রতিটি যেন একেকটি খামার। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় চাষ হয় সবজি।
চরের নারী-পুরুষ সমান তালে মাঠ ঘাটে কাজ করে। বর্ষার ছয় মাস তাদের তেমন কাজ থাকে না। তাই বাকি ছয় মাস কাজ করেই জীবনযাপনের অর্থের জোগান ঠিক রাখেন ওই চরাঞ্চলের মানুষ। পুরুষের সাথে মাঠে নারীরাও কাজ করেন। এমনটাই জানা গেছে চর শুশুয়া, অর্জুনা, চর গোবিন্দসহ কয়েকটি চরের মানুষের সাথে কথা বলে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের রবি মৌসুমে ভুঞাপুর উপজেলায় সরিষা চাষ হয়েছে ৩৫৭০ হেক্টর। এর মধ্যে উফসী ২৫৯৫ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ৯৭৫ হেক্টর। ভুট্টা ২৮৫১ হেক্টর, চিনাবাদাম ১৩২০ হেক্টর, মুসুর ৫২২, খেসারি ১০১২ হেক্টর, কালোজিরা ১০ হেক্টর, মিষ্টি আলু ৫৭ হেক্টর, মরিচ ৮৫ হেক্টর, শাকসবজি ৪৭০ হেক্টর, পেয়াজ ৫২ হেক্টর, আলু ৩৮ হেক্টর, রসুন ৩৪ হেক্টর, ধনিয়া ২৪ হেক্টর, গম ৪৮০ হেক্টর, মাষকালাই ১২২৪ ও রোপা আমন ৬১১৫ হেক্টর।
সরেজমিনে অর্জুনা আর গাবসারা ইউনিয়নে গিয়ে জানা যায়, চরাঞ্চলের চাষাবাদের বিভিন্ন তথ্য। নলিন থেকে নৌকায় করে যমুনা নদী পার হলেই চরশুশুয়া গ্রাম। নদীর পাড় উঠে দেখা যায় সবুজ আর সবুজ। দুই পাশে শস্য ক্ষেতের মাঝ খানে মেঠো পথ। ডানপাশে মাসকালাই আর বাঁপাশে ভুট্টার খেত। কিছুটা এগিয়ে যাবার পর দেখা হয় আহাম্মদ খান আলী (৫৫) নামের এক কৃষকের সাথে। তার হাতে কাস্তে আর রশি। তার ভাষ্যমতে এলাকার নাম গুলো ভিন্ন ভিন্ন চরের নামে রাখা হয়েছে। এসব চরে এই সময়ে গম, ভুট্টা, শাক, সবজি, মরিচ, মুলা, ধান, শিম, লাউসহ বিভিন্ন চাষ হয়। তিনি হাত দিয়ে দূরে একটি চর দেখালেন, যেখানে তার ২ বিঘা মরিচের চাষ। এখানে তিন বিঘা জমিতে মাষকালাই, দেড় বিঘা জমিতে ধান, ৫ বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছেন তিনি। খান আলী জানালেন, চরে চাষ করতে তেমন কোন সারের প্রয়োজন হয় না। অল্প খরচে অধিক ফসল ফলানো যায়।
চর শ^শুয়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় সরকারি ইবরাহীম খাঁ কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, চরের প্রায় সবাই কৃষি কাজের সাথে জড়িত। কম বেশি সবাই কৃষি কাজ করে। চরাঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি কাজ। তার বাবাও একজন কৃষক। তারা সব ধরনের ফসল চাষ করে। কম খরচে অধিক ফসল পাওয়া যায়। চরে বেশি চাষ হয় ভুট্টা।
রাজীব মিয়া (২৩) নামের এক কৃষক বলেন, এবার তিনি তিন বিঘা ভুট্টা, দুই বিঘা মাষকালাই ও ১৫ শতাংশ কালো জিরা চাষ করেছেন। শুধু রাজীব, আব্দুর রহমান, গোলাম রব্বানী, জাহাঙ্গীর আলমই নন, তাদের মত চর তালতলা, চর শুশুয়া, বেহারির চর, জঙ্গিচর, চরসোহাগভাগা, চরকালিপুর, চরচন্দনি, চরবাসুদেবসহ প্রায় সব চরের মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। কৃষি কাজ করে চলে তাদের জীবন জীবিকা।
প্রতিবছর তারা কৃষি কাজে ভালো লাভ পান। বাড়িতে গবাদিপশু পালন করেও লাভবান হন। বর্ষাকালে কৃষিকাজ থাকে না বিধায় এই মৌসুমে কৃষি ফসলের পাশাপাশি বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া পালন করেন তারা। বর্ষার আগেই অবশ্য গবাদিপশু বিক্রি করে দেয় এসব চরাঞ্চলের কৃষকরা।
স্থানীয় চেয়ারম্যান দিদারুল আলম খান মাহবুব বাসসকে জানান, চরের কৃষকদের সরকারিভাবে কৃষি সেবা প্রণোদনাও দেয়া হয়ে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ঘোড়ার গাড়ি আর মাথায় করে ফসল ঘরে তুলতে হয় চাষীদের।
ভুঞাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, এসব চরাঞ্চল কিছু কিছু কৃষি ফসলের জন্য বিশেষ উপযোগী। বাদাম, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, মরিচসহ কিছু ফসল ভালো জন্মে। বন্যায় চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পলি পড়ে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষি ফসলের ভালো ফলন হয়ে থাকে।