ঢাকা , বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুন্দরবনে ফের অস্ত্রের ঝংকার

দস্যুমুক্ত ঘোষণার ছয় বছর পর ফের দস্যুদের আবির্ভাব দেখা দিয়েছে সুন্দরবনে। সম্প্রতি বনের বিভিন্ন এলাকা ও বনসংলগ্ন সাগরে জেলে অপহরণ, লুটপাটসহ বেশ কয়েকটি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘদিন পর শান্ত বনে শোনা যাচ্ছে দস্যুদের অস্ত্রের ঝংকার। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বন এবং সাগরের জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালরা।

সামনে আসছে সুন্দরবনের গোলপাতা আহরণ মৌসুম। এই গোলপাতা মৌসুমকে লক্ষ্য করেই তৎপরতা শুরু করেছে দস্যুরা। অন্যদিকে ১ সেপ্টেম্বর থেকে টানা ৯ মাস থাকে সুন্দরবনের মৌসুম। এই সময় দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটকরা আসেন সুন্দরবন ভ্রমণে।

দস্যুতা বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের পর্যটনের ওপরও পড়বে বিরূপ প্রভাব। পাশাপাশি সুন্দরবনের বাঘ-হরিণ শিকার ও চোরাচালান বৃদ্ধিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বছরখানেক আগ থেকে পশ্চিম বন বিভাগে সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জের বনে আবির্ভাব ঘটে দস্যুদের। ধীরে ধীরে তা এখন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে বিস্তার ঘটেছে।

প্রথম পর্যায়ে তারা জেলেদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে পূর্ব বন বিভাগে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।রবিবার (২৬ জানুয়ারি) গভীর রাতে বঙ্গোপসাগরের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় জেলেবহরে হানা দেয় একদল দস্যু। ১০-১২ অস্ত্রধারী দস্যু ট্রলারযোগে এসে নিরস্ত্র জেলেদের ট্রলারে উঠে দস্যুতা শুরু করে। এক পর্যায়ে জেলেরা সংঘবদ্ধ হয়ে একটি দেশি বন্দুক ও বেশ কিছু কার্তুজসহ তিন দস্যুকে আটক করতে সক্ষম হন। এ সময় সশস্ত্র এক দস্যু সাগরে পড়ে যায়।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে অন্তত ১৫ জেলেকে অপহরণ করে অন্য দলের দস্যুরা চলে যায়। অপহৃতরা সবাই পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার বিশেষ টহল ফাঁড়ির অধীনে আলোরকোল শুঁটকিপল্লীর জেলে।আটক দস্যুকে সোমবার সকালে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের আলোরকোল ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়ে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
এর আগে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে চাঁদপাই রেঞ্জের ঝাপসি এলাকা থেকে ১০ জেলেকে অপহরণ করে বনদস্যু শফিকুল বাহিনী। পরে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান জেলেরা।

বন বিভাগ জানায়, ২০১৬ সাল থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতায় একে একে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে দস্যু বাহিনীগুলো। সব বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এই সময়ের মধ্যে জেলে-বাওয়ালিদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক গোটা সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়ানো ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে। ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদ জমা দেয় দস্যুরা। আত্মসমর্পণকারী এসব দস্যুরা ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে।

সেই থেকে শান্ত হয়ে ওঠা সুন্দরবনে নির্ভয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন পেশাজীবীরা। নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করে আসছেন পর্যটকরাও। কিন্তু সাম্প্রতিককালে হঠাৎ করে একাধিক দস্যুতার ঘটনা নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে পর্যটন ব্যবসায়ী, বনের পেশাজীবী, বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে।

দুবলার চরের ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, রবিবার মধ্যরাতে আলোরকোলের জেলেরা বঙ্গোপসাগরের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় মাছ ধরার সময় দস্যুরা জেলেবহরে হানা দিয়ে অন্তত ১৫ জন জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এসময় একটি আগ্নেয়াস্ত্র ও বেশ কিছু গোলাবারুদসহ তিন দস্যুকে আটক করে কোস্ট গার্ডের কাছে হস্তান্তর করেন জেলেরা।

আটক দস্যুরা হলেন শ্যামনগর উপজেলার মন্সীগঞ্জ এলাকার রবিউল, মোংলা উপজেলার আমড়াতলা এলাকার মুন্না ও জাহাঙ্গীর।  এরা বনদস্যু মজনু বাহিনীর সদস্য।

মৎস্যজীবী নেতা কামাল আহমেদ বলেন, দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর সুন্দরবন এবং সাগরে বন ও জলদস্যুদের কোনো উৎপাত ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে আবার দস্যুদের আনাগোনা শুরু হওয়ায় জেলে-মহাজন সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। দস্যুদের তৎপরতা বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ট্যুরস অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) প্রচার সম্পাদক শাহেদী ইসলাম রকি বলেন, বনদস্যুদের উৎপাত বাড়লে পর্যটকরা ভ্রমণে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকরা বেশি ভয়ে থাকেন। আমরা প্রায় ছয় বছর নিশ্চিন্তে ট্যুর পরিচালনা করেছি। বর্তমানে কিছু দস্যু বনে ঢুকেছে। এদেরকে এখনই দমন করা না হলে পর্যটন ব্যবসার ক্ষতি হবে।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ নূরুল করিম আশঙ্ক প্রকাশ করে বলেন, দীর্ঘদিন পর দস্যুতার খবরটি বন বিভাগকে ভাবিয়ে তুলেছে। এদেরকে দমনে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ইকো-ট্যুরিজমসহ সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

তিন দস্যু আটক, অপহৃত জেলেদের উদ্ধার এবং দস্যু দমনে অভিযান পরিচালনার বিষয়ে জানতে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের আলোরকোল ক্যাম্পে যোগাযোগ করা হলে তারা এ ব্যাপারে এখনই কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

সুন্দরবনে ফের অস্ত্রের ঝংকার

আপডেট টাইম : ০২:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫
দস্যুমুক্ত ঘোষণার ছয় বছর পর ফের দস্যুদের আবির্ভাব দেখা দিয়েছে সুন্দরবনে। সম্প্রতি বনের বিভিন্ন এলাকা ও বনসংলগ্ন সাগরে জেলে অপহরণ, লুটপাটসহ বেশ কয়েকটি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘদিন পর শান্ত বনে শোনা যাচ্ছে দস্যুদের অস্ত্রের ঝংকার। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বন এবং সাগরের জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালরা।

সামনে আসছে সুন্দরবনের গোলপাতা আহরণ মৌসুম। এই গোলপাতা মৌসুমকে লক্ষ্য করেই তৎপরতা শুরু করেছে দস্যুরা। অন্যদিকে ১ সেপ্টেম্বর থেকে টানা ৯ মাস থাকে সুন্দরবনের মৌসুম। এই সময় দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটকরা আসেন সুন্দরবন ভ্রমণে।

দস্যুতা বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের পর্যটনের ওপরও পড়বে বিরূপ প্রভাব। পাশাপাশি সুন্দরবনের বাঘ-হরিণ শিকার ও চোরাচালান বৃদ্ধিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বছরখানেক আগ থেকে পশ্চিম বন বিভাগে সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জের বনে আবির্ভাব ঘটে দস্যুদের। ধীরে ধীরে তা এখন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে বিস্তার ঘটেছে।

প্রথম পর্যায়ে তারা জেলেদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে পূর্ব বন বিভাগে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।রবিবার (২৬ জানুয়ারি) গভীর রাতে বঙ্গোপসাগরের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় জেলেবহরে হানা দেয় একদল দস্যু। ১০-১২ অস্ত্রধারী দস্যু ট্রলারযোগে এসে নিরস্ত্র জেলেদের ট্রলারে উঠে দস্যুতা শুরু করে। এক পর্যায়ে জেলেরা সংঘবদ্ধ হয়ে একটি দেশি বন্দুক ও বেশ কিছু কার্তুজসহ তিন দস্যুকে আটক করতে সক্ষম হন। এ সময় সশস্ত্র এক দস্যু সাগরে পড়ে যায়।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে অন্তত ১৫ জেলেকে অপহরণ করে অন্য দলের দস্যুরা চলে যায়। অপহৃতরা সবাই পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার বিশেষ টহল ফাঁড়ির অধীনে আলোরকোল শুঁটকিপল্লীর জেলে।আটক দস্যুকে সোমবার সকালে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের আলোরকোল ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়ে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
এর আগে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে চাঁদপাই রেঞ্জের ঝাপসি এলাকা থেকে ১০ জেলেকে অপহরণ করে বনদস্যু শফিকুল বাহিনী। পরে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান জেলেরা।

বন বিভাগ জানায়, ২০১৬ সাল থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতায় একে একে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে দস্যু বাহিনীগুলো। সব বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এই সময়ের মধ্যে জেলে-বাওয়ালিদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক গোটা সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়ানো ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে। ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদ জমা দেয় দস্যুরা। আত্মসমর্পণকারী এসব দস্যুরা ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে।

সেই থেকে শান্ত হয়ে ওঠা সুন্দরবনে নির্ভয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন পেশাজীবীরা। নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করে আসছেন পর্যটকরাও। কিন্তু সাম্প্রতিককালে হঠাৎ করে একাধিক দস্যুতার ঘটনা নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে পর্যটন ব্যবসায়ী, বনের পেশাজীবী, বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে।

দুবলার চরের ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, রবিবার মধ্যরাতে আলোরকোলের জেলেরা বঙ্গোপসাগরের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় মাছ ধরার সময় দস্যুরা জেলেবহরে হানা দিয়ে অন্তত ১৫ জন জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এসময় একটি আগ্নেয়াস্ত্র ও বেশ কিছু গোলাবারুদসহ তিন দস্যুকে আটক করে কোস্ট গার্ডের কাছে হস্তান্তর করেন জেলেরা।

আটক দস্যুরা হলেন শ্যামনগর উপজেলার মন্সীগঞ্জ এলাকার রবিউল, মোংলা উপজেলার আমড়াতলা এলাকার মুন্না ও জাহাঙ্গীর।  এরা বনদস্যু মজনু বাহিনীর সদস্য।

মৎস্যজীবী নেতা কামাল আহমেদ বলেন, দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর সুন্দরবন এবং সাগরে বন ও জলদস্যুদের কোনো উৎপাত ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে আবার দস্যুদের আনাগোনা শুরু হওয়ায় জেলে-মহাজন সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। দস্যুদের তৎপরতা বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ট্যুরস অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) প্রচার সম্পাদক শাহেদী ইসলাম রকি বলেন, বনদস্যুদের উৎপাত বাড়লে পর্যটকরা ভ্রমণে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকরা বেশি ভয়ে থাকেন। আমরা প্রায় ছয় বছর নিশ্চিন্তে ট্যুর পরিচালনা করেছি। বর্তমানে কিছু দস্যু বনে ঢুকেছে। এদেরকে এখনই দমন করা না হলে পর্যটন ব্যবসার ক্ষতি হবে।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ নূরুল করিম আশঙ্ক প্রকাশ করে বলেন, দীর্ঘদিন পর দস্যুতার খবরটি বন বিভাগকে ভাবিয়ে তুলেছে। এদেরকে দমনে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ইকো-ট্যুরিজমসহ সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

তিন দস্যু আটক, অপহৃত জেলেদের উদ্ধার এবং দস্যু দমনে অভিযান পরিচালনার বিষয়ে জানতে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের আলোরকোল ক্যাম্পে যোগাযোগ করা হলে তারা এ ব্যাপারে এখনই কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।