বিলুপ্তির পথে শেরপুরের তেঁতুল গাছ, অথচ মুখরোচক আচারের প্রধান উপকরণ তেঁতুল! মাত্র দেড় যুগ আগেও শেরপুরের এমন কোন বাড়ি ছিল না যেখানে একটি হলেও তেঁতুল গাছ না ছিল। তখন জেলার গারো পাহাড়ে আর্থিক সম্ভাবনার অপর নাম ছিল তেঁতুল। আম, কাঁঠাল, কলা, বেল, আদা ও হলুদের সাথে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন হাট-বাজারে জায়গা করে নিয়েছিল টক-মিষ্টি স্বাদের তেঁতুল। তখনকার সময় গাছতলায় পড়ে থাকা তেঁতুল এখন রাখতে পারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা। তেঁতুলের নাম শোনা মাত্রই কার না জিহ্বায় পানি এসে যায়।
তেঁতুলে আসক্তি নেই এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই আছে। ইতোপূর্বে জেলার সর্বত্র বিশেষ করে গারো পাহাড় অঞ্চলে টক-মিষ্টি স্বাদের তেঁতুলের আচারের স্বাদই আলাদা। তখন বিভিন্ন হাট-বাজারেও জমে উঠেতো তেঁতুল বেচাকেনা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কিনে নিয়ে যেতো টক-মিষ্টি তেঁতুল। শেরপুরের কলা-কাঁঠালসহ কৃষিপণ্যে ভরে যেতো হাট-বাজার। তেঁতুল বিভিন্ন হাট-বাজারে ২-৫ টাকা দরে প্রতি কেজি বিক্রি হতো। বর্তমানে তেঁতুলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় সেই টক-মিষ্টি তেঁতুল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা কেজিতে।
কোনো ধরনের কীটনাশক বা পরিচর্যা ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত তেঁতুল লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে তেঁতুল চাষ হতে পারে শেরপুর ও গারো পাহাড়ে। কিন্তু এব্যাপারে কৃষি বিভাগ কৃষকদের সঠিক পরামর্শ দিলে তারা কোন ঝুঁকতেন তেঁতুল গাছ রোপনে। ফল ব্যবসায়ীরা বলেন, তেঁতুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তেঁতুলের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে স্থানীয় বাজারে দামও বেড়ে গেছে। দেশের আচার তৈরির কারখানাগুলোতেও তেঁতুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে গারো পাহাড়ি তেঁতুলের চাহিদা ব্যাপক।
তেঁতুলে কোনো ধরনের কীটনাশকের ব্যবহার প্রয়োজন হয় না বলে গুনাগুণ ও ভাল। কোনো ধরনের বিনিয়োগ বা ঝুঁকি ছাড়াই তেঁতুল বিক্রি করে যে কোন পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আসতে পারে নিঃসন্দেহে। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত তেঁতুলে বিক্রি করে সংসারের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরতে পারে এই জেলার মানুষের।
এলাকার প্রবীণ লোকেরা বলেন, তেঁতুলে লোকসান হয় না বলে তেঁতুলের বাণিজ্যিক চাষ সম্ভাবনাময়। তারা বলেন, একসময় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে হতো বলে ভালো দাম পাওয়া যেত না। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে প্রচুর তেঁতুল ক্রয় করতেন। কিন্তু শেরপুরে ইটভাটা হওয়ার পর শুরু হয় তেঁতুল গাছ নিধন। তেঁতুল গাছ কেটে শুরু হয় ইটভাটায় লাকড়ি হিসেবে বিক্রি। এভাবেই আস্তে আস্তে তেঁতুল গাছ বিলুপ্ত হতে থাকে।
তাছাড়া তখন দেশে আচার ফ্যাক্টরি ও ছিলনা বলে জনসাধারণ তেঁতুল বিক্রি করে পোষাতে পারেননি। তাই ইটভাটায় ভাল দাম পাওয়ায় দেদারসে গাছ কেটে লাকড়ি হিসেবে বিক্রি করে। এভাবেই তেঁতুল গাছ বিলুপ্ত হয়ে যায় শেরপুর থেকে। কিন্তু আচার ফ্যক্টরীগুলো চালু হবার পর থেকে বাড়তে থাকে সেই গাছ তলায় পড়ে থাকা তেঁতুলের চাহিদা ও দাম। তাই আবরো তেঁতুল গাছ রোপন করে শেরপুরের কৃষি পরিবারগুলো ভাল দামে তেঁতুল বিক্রি করে অনায়াসেই আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন বলে অভিঙ্গ মহলের ধারণা। স্থানীয়রা বলেন, একসময় তেঁতুল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো।
এখন আর বসে থাকতে হয় না। বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যায়। ভালো দাম পাওয়ার পাশাপাশি ক্রেতার জন্য অপেক্ষার দিনও শেষ হয়ে গেছে। দেশব্যাপী তেঁতুলের বাজার সৃষ্টি হওয়ায় শেরপুর গারো পাহাড়ে তেঁতুল চাষে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও কৃষি বিভাগ অন্তরিক হলে তেঁতুলেই গারো পাহাড়ের মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: আশরাফুল আলম রাসেল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এক সময়ের প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠতো তেঁতুল গাছ। তখন ও তেঁতুল বিক্রি করে লাভবান হতেন লোকজন। তেঁতুল গাছ লাগানোর পর তেমন কোনো পরিশ্রম করতে হয় না। বড় তেঁতুল গাছ থেকে প্রতি বছর কয়েকশ মণ ফল পাওয়া যায়। সুতরাং তেঁতুল গাছ রোপন এবং সেই রোপিত গাছের তেঁতুলে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যেতে পারে এই গারো জেলা শেরপুরসহ পাহাড়ি উপজেলার জনগণের।