ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গণমাধ্যম মধ্যে কঠিন পরিস্থিতির

রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ যেমন— নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগ সঠিকভাবে এবং যথাযথভাবে কাজ করে কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকার কারণে একে বলা হয়ে থাকে ফোর্থ স্টেট। ১৭৮৭ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, রাজনীতিক, রাজনীতি বিজ্ঞানী অ্যাডমন্ড বার্ক ব্রিটেনের পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তব্যে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে ফোর্থ স্টেট শব্দটি প্রথম উচ্চারণ করেন। তার উচ্চারণ ছিল এই কারণে যে, রাষ্ট্রব্যবস্থা যেন সচল, সজীব, বিশেষ করে কোনো অঙ্গই যেন অচল-অবশ বা দুর্নীতিসহ এমনসব রোগে আক্রান্ত হতে না পারে। ওই জমানায় বর্তমানের মতো নয়, সংবাদপত্রই ছিল একমাত্র মাধ্যম। আজঅব্দি গণতান্ত্রিক সমাজে ফোর্থ স্টেট অর্থাৎ গণমাধ্যম যাতে বাধা-বিঘ্নবিহীনভাবে চলতে পারে তার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। তবে উন্নত সমাজেও একটা দ্বন্দ্ব-লড়াই সর্বদা বিদ্যমান রয়েছে রাষ্ট্রের সঙ্গে, বিশেষ করে নির্বাহী বিভাগ বা সরকারের সঙ্গে। এ কথাটি মনে রাখতেই হবে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকার ওপর। যত বেশি গণতন্ত্র, তত বেশি স্বাধীন গণমাধ্যম—এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এই নিয়মের ছকে যদি আমরা বাংলাদেশকে বিচার-বিশ্লেষণ করি, তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই একটি বিপজ্জনক ও ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। পাকিস্তান আমলে সংবাদ মাধ্যমের লড়াইটা ছিল শাসকদের সঙ্গে। আর এই লড়াই গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে যে, এই লড়াইটি থামেনি, বরং জোরেশোরে এখনো করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বল্পকাল পরেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে ভয়াল থাবা নেমে আসে। আর এই থাবাটি অনিবার্যভাবে এসেছিল গণতান্ত্রিক পথে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে। চারটি সংবাদপত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রেখে বাকি সব বন্ধ করে দেওয়া, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ নানা কালা-কানুন জারি করা হয়। এসবই ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলোপ করে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার যে সর্বব্যাপী উদ্যোগ তখন নেওয়া হয়েছিল, তারই অংশ। এরপর থেকে সামরিক কিংবা বেসামরিক যে সরকারই এসেছে, তাদের সবারই লক্ষ্য ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন বা তাতে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করা। বাধাগ্রস্ত করার কারণও ওই গণতন্ত্র হরণ প্রচেষ্টা। ধারণা করা হয়েছিল, ১৯৯০-এর পরে গণতন্ত্রে যে ইতিবাচক তরঙ্গ দেখা দেবে তাতে গণমাধ্যমও মুক্ত-স্বাধীন হবে। কিন্তু অসহায়ভাবে আমাদের দেখতে হয়েছে এবং হচ্ছে, গণতন্ত্রের তরঙ্গ তো আসেইনি, পাওয়া যায়নি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও। আগেই বলা হয়েছে, সমাজে সঠিকমাত্রায় গণতন্ত্র থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও সঠিক মাত্রায় থাকবে— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান সময়ে এখানেই হচ্ছে বড় সমস্যা ও সংকট। আরও একটি বিষয় সবাইকে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব, ক্ষুণ্ন, বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি বা বিপন্ন করার জন্য সব সময়ই যে লিখিত আইন-কানুনের প্রয়োজন পড়ে তা নয়। ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র নানা কৌশল ও ফন্দি-ফিকির যেমন করে, তেমনি অরাষ্ট্রীয় (নন স্টেট ফ্যাক্টর) শক্তিগুলোও এর সুযোগ নেয় নানাভাবে, যেমনটা এখন নেওয়া হচ্ছে। ওই সব ফন্দি-ফিকিরে যখন কাজ হয় না তখন সরকার সর্বশক্তি নিয়ে নেমে পড়ে। আর এই সর্বশক্তি নিয়ে নামার অর্থই হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ প্রয়াস। কখনো কখনো কামিয়াব হওয়ার পরেও তা ধরে রাখতে এমনটা করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাষ্ট্রযন্ত্র ও ক্ষমতার অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র উভয়ই তত্পর হয়ে ওঠে। এ কথাটি সত্য যে, ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করার চেষ্টা করা হলে তার প্রথম ধাক্কাটি এসে লাগে গণমাধ্যমের ওপরে। কারণ এরকম পরিস্থিতিতে শাসক সব সময়ই গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ মনে করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে আস্তে আস্তে অলিখিতভাবে কিছু বাধা-নিষেধ আরোপিত হয়। এ ছাড়া সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও নানা বাক্যবাণ ছোড়া হতে থাকে। টেলিভিশন টকশোতে যারা কিছু কথাবার্তা বলতেন তাদের নিশিকুটুম্ব বলেও সম্বোধন করা হয়েছিল। বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করা হয়; ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা-হামলা হতে থাকে। এ সবের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য প্রযুক্তি আইন দিয়ে স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিস্থিতিকে কঠিন-কঠোর বেড়াজালে আটকে ফেলা হয়েছে। অনেক কিছুর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ৫৭ ধারা—যাতে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া এই আইনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির এই অবাধ যুগে এমন একটি আইন থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ভীতির জন্ম নেয় এবং অবাধ স্বাধীনতার যুগটি পরিণত হয় অবাধ স্বাধীনতাহীনতার যুগে। এই আইনের শিকার হয়েছেন অনেকেই। তাছাড়া সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা এখন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে এসে হাজির হয়েছে সম্প্রচার নীতিমালা। জাতীয় সম্প্রচার আইনের বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা হলে থাকবে শাস্তি। জাতীয় সম্প্রচার আইনের বিধি-বিধান বা প্রবিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড, কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। এরপরও সম্প্রচার আইনে অপরাধ চলতে থাকলে প্রতিদিনের জন্য অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার সুযোগ থাকবে। প্রচলিত আইনে গণমাধ্যম কোনো দোষত্রুটি করে থাকলে আইন অনুযায়ী তার বিচার হওয়া সম্ভব। এমতাবস্থায় নতুন এই নীতিমালার যৌক্তিকতা কতটুকু? তবে তাদের দিক থেকে যৌক্তিকতা হচ্ছে—গণমাধ্যমের ওপরে কালাকানুন আরোপ করা। এ পর্যন্তও ক্ষান্ত দিলেও হতো। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, গণমাধ্যম মনিটরিং সেল গঠিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এটুকুই বলা যায় যে, এই মনিটরিং সেল কী মনিটর করবে তা সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়াও এতদিন নির্জীব ও দুর্বল অবস্থার প্রেস কাউন্সিল হঠাৎ করে আবার সচল হয়ে উঠেছে। প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরও উদ্দেশ্য পরিষ্কার। প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকতার মান রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রের সুরক্ষা দেবে এমনটাই কথা ছিল এর গঠনকালে। কিন্তু নতুন যে বিধান করা হচ্ছে তাতে সংবাদপত্রের প্রকাশনা সর্বোচ্চ ৩০ দিন বন্ধ রাখা যাবে। কোথাও গণতন্ত্র বলে যদি সামান্যও কিছু থাকে তাহলে সংবাদপত্রের প্রকাশনা একদিনের জন্যও বন্ধ করার বিধান নেই। এহেন এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব ও বিপন্ন করার পাশাপাশি সংবিধান স্বীকৃত চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার ওপরও হাত পড়েছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বিচারপতি পটার স্টুয়ার্ডের একটি উদ্ধৃতি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন— ‘সেন্সরশিপ সমাজের উপরে যে অবিশ্বাস, তারই প্রতিফলন।’ স্বাধীন ও বাধা-বিঘ্নহীন গণমাধ্যম এবং চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার অনুপস্থিতির সুযোগটি যতটা না শাসক পক্ষ পায়, তার চেয়েও এর সুযোগটি বেশি নিয়ে থাকে জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদসহ অরাষ্ট্রীয় শক্তিসমূহ। তবে এ কথাও বলতে হবে, এই সরকারই প্রথম অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিতের জন্য তথ্য কমিশন গঠন করে দিয়েছে। এ ছাড়া মানবাধিকার কমিশনসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক অমর্ত্য সেনের দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস গ্রন্থে তিনি বলেছেন—‘আনুষ্ঠানিকভাবে কী কী প্রতিষ্ঠান আছে, শুধু তা দিয়ে গণতন্ত্রের মূল্যায়ন হয় না; ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর বহু মানুষের কণ্ঠস্বরগুলো শোনা যাচ্ছে কি না সেটাও দেখতে হবে’। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, গণমাধ্যমের ওপরে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে, একে বিপন্ন করে সেই কণ্ঠস্বরগুলো যাতে আর শুনতে পাওয়া না যায় তার যাবতীয় এন্তেজাম চলছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী—গণমাধ্যমের ওপরে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীনরা লাভবান হয় না কখনোই। বরং মুক্ত গণমাধ্যম থাকলে ক্ষমতাসীনরাই বেশি লাভবান হয়। ১৯৬০-এর দশকে চীন ও ভারতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল এবং এতে চীনে বেশি সংখ্যায় মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাও সে তুং তেমন মতটিই দিয়েছিলেন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

গণমাধ্যম মধ্যে কঠিন পরিস্থিতির

আপডেট টাইম : ০৪:৫৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ মে ২০১৬

রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ যেমন— নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগ সঠিকভাবে এবং যথাযথভাবে কাজ করে কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকার কারণে একে বলা হয়ে থাকে ফোর্থ স্টেট। ১৭৮৭ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, রাজনীতিক, রাজনীতি বিজ্ঞানী অ্যাডমন্ড বার্ক ব্রিটেনের পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তব্যে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে ফোর্থ স্টেট শব্দটি প্রথম উচ্চারণ করেন। তার উচ্চারণ ছিল এই কারণে যে, রাষ্ট্রব্যবস্থা যেন সচল, সজীব, বিশেষ করে কোনো অঙ্গই যেন অচল-অবশ বা দুর্নীতিসহ এমনসব রোগে আক্রান্ত হতে না পারে। ওই জমানায় বর্তমানের মতো নয়, সংবাদপত্রই ছিল একমাত্র মাধ্যম। আজঅব্দি গণতান্ত্রিক সমাজে ফোর্থ স্টেট অর্থাৎ গণমাধ্যম যাতে বাধা-বিঘ্নবিহীনভাবে চলতে পারে তার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। তবে উন্নত সমাজেও একটা দ্বন্দ্ব-লড়াই সর্বদা বিদ্যমান রয়েছে রাষ্ট্রের সঙ্গে, বিশেষ করে নির্বাহী বিভাগ বা সরকারের সঙ্গে। এ কথাটি মনে রাখতেই হবে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকার ওপর। যত বেশি গণতন্ত্র, তত বেশি স্বাধীন গণমাধ্যম—এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এই নিয়মের ছকে যদি আমরা বাংলাদেশকে বিচার-বিশ্লেষণ করি, তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই একটি বিপজ্জনক ও ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। পাকিস্তান আমলে সংবাদ মাধ্যমের লড়াইটা ছিল শাসকদের সঙ্গে। আর এই লড়াই গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে যে, এই লড়াইটি থামেনি, বরং জোরেশোরে এখনো করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বল্পকাল পরেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে ভয়াল থাবা নেমে আসে। আর এই থাবাটি অনিবার্যভাবে এসেছিল গণতান্ত্রিক পথে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে। চারটি সংবাদপত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রেখে বাকি সব বন্ধ করে দেওয়া, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ নানা কালা-কানুন জারি করা হয়। এসবই ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলোপ করে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার যে সর্বব্যাপী উদ্যোগ তখন নেওয়া হয়েছিল, তারই অংশ। এরপর থেকে সামরিক কিংবা বেসামরিক যে সরকারই এসেছে, তাদের সবারই লক্ষ্য ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন বা তাতে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করা। বাধাগ্রস্ত করার কারণও ওই গণতন্ত্র হরণ প্রচেষ্টা। ধারণা করা হয়েছিল, ১৯৯০-এর পরে গণতন্ত্রে যে ইতিবাচক তরঙ্গ দেখা দেবে তাতে গণমাধ্যমও মুক্ত-স্বাধীন হবে। কিন্তু অসহায়ভাবে আমাদের দেখতে হয়েছে এবং হচ্ছে, গণতন্ত্রের তরঙ্গ তো আসেইনি, পাওয়া যায়নি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও। আগেই বলা হয়েছে, সমাজে সঠিকমাত্রায় গণতন্ত্র থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও সঠিক মাত্রায় থাকবে— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান সময়ে এখানেই হচ্ছে বড় সমস্যা ও সংকট। আরও একটি বিষয় সবাইকে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব, ক্ষুণ্ন, বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি বা বিপন্ন করার জন্য সব সময়ই যে লিখিত আইন-কানুনের প্রয়োজন পড়ে তা নয়। ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র নানা কৌশল ও ফন্দি-ফিকির যেমন করে, তেমনি অরাষ্ট্রীয় (নন স্টেট ফ্যাক্টর) শক্তিগুলোও এর সুযোগ নেয় নানাভাবে, যেমনটা এখন নেওয়া হচ্ছে। ওই সব ফন্দি-ফিকিরে যখন কাজ হয় না তখন সরকার সর্বশক্তি নিয়ে নেমে পড়ে। আর এই সর্বশক্তি নিয়ে নামার অর্থই হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ প্রয়াস। কখনো কখনো কামিয়াব হওয়ার পরেও তা ধরে রাখতে এমনটা করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাষ্ট্রযন্ত্র ও ক্ষমতার অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র উভয়ই তত্পর হয়ে ওঠে। এ কথাটি সত্য যে, ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করার চেষ্টা করা হলে তার প্রথম ধাক্কাটি এসে লাগে গণমাধ্যমের ওপরে। কারণ এরকম পরিস্থিতিতে শাসক সব সময়ই গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ মনে করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে আস্তে আস্তে অলিখিতভাবে কিছু বাধা-নিষেধ আরোপিত হয়। এ ছাড়া সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও নানা বাক্যবাণ ছোড়া হতে থাকে। টেলিভিশন টকশোতে যারা কিছু কথাবার্তা বলতেন তাদের নিশিকুটুম্ব বলেও সম্বোধন করা হয়েছিল। বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করা হয়; ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা-হামলা হতে থাকে। এ সবের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য প্রযুক্তি আইন দিয়ে স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিস্থিতিকে কঠিন-কঠোর বেড়াজালে আটকে ফেলা হয়েছে। অনেক কিছুর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ৫৭ ধারা—যাতে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া এই আইনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির এই অবাধ যুগে এমন একটি আইন থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ভীতির জন্ম নেয় এবং অবাধ স্বাধীনতার যুগটি পরিণত হয় অবাধ স্বাধীনতাহীনতার যুগে। এই আইনের শিকার হয়েছেন অনেকেই। তাছাড়া সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা এখন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে এসে হাজির হয়েছে সম্প্রচার নীতিমালা। জাতীয় সম্প্রচার আইনের বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা হলে থাকবে শাস্তি। জাতীয় সম্প্রচার আইনের বিধি-বিধান বা প্রবিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড, কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। এরপরও সম্প্রচার আইনে অপরাধ চলতে থাকলে প্রতিদিনের জন্য অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার সুযোগ থাকবে। প্রচলিত আইনে গণমাধ্যম কোনো দোষত্রুটি করে থাকলে আইন অনুযায়ী তার বিচার হওয়া সম্ভব। এমতাবস্থায় নতুন এই নীতিমালার যৌক্তিকতা কতটুকু? তবে তাদের দিক থেকে যৌক্তিকতা হচ্ছে—গণমাধ্যমের ওপরে কালাকানুন আরোপ করা। এ পর্যন্তও ক্ষান্ত দিলেও হতো। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, গণমাধ্যম মনিটরিং সেল গঠিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এটুকুই বলা যায় যে, এই মনিটরিং সেল কী মনিটর করবে তা সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়াও এতদিন নির্জীব ও দুর্বল অবস্থার প্রেস কাউন্সিল হঠাৎ করে আবার সচল হয়ে উঠেছে। প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরও উদ্দেশ্য পরিষ্কার। প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকতার মান রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রের সুরক্ষা দেবে এমনটাই কথা ছিল এর গঠনকালে। কিন্তু নতুন যে বিধান করা হচ্ছে তাতে সংবাদপত্রের প্রকাশনা সর্বোচ্চ ৩০ দিন বন্ধ রাখা যাবে। কোথাও গণতন্ত্র বলে যদি সামান্যও কিছু থাকে তাহলে সংবাদপত্রের প্রকাশনা একদিনের জন্যও বন্ধ করার বিধান নেই। এহেন এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব ও বিপন্ন করার পাশাপাশি সংবিধান স্বীকৃত চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার ওপরও হাত পড়েছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বিচারপতি পটার স্টুয়ার্ডের একটি উদ্ধৃতি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন— ‘সেন্সরশিপ সমাজের উপরে যে অবিশ্বাস, তারই প্রতিফলন।’ স্বাধীন ও বাধা-বিঘ্নহীন গণমাধ্যম এবং চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার অনুপস্থিতির সুযোগটি যতটা না শাসক পক্ষ পায়, তার চেয়েও এর সুযোগটি বেশি নিয়ে থাকে জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদসহ অরাষ্ট্রীয় শক্তিসমূহ। তবে এ কথাও বলতে হবে, এই সরকারই প্রথম অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিতের জন্য তথ্য কমিশন গঠন করে দিয়েছে। এ ছাড়া মানবাধিকার কমিশনসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক অমর্ত্য সেনের দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস গ্রন্থে তিনি বলেছেন—‘আনুষ্ঠানিকভাবে কী কী প্রতিষ্ঠান আছে, শুধু তা দিয়ে গণতন্ত্রের মূল্যায়ন হয় না; ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর বহু মানুষের কণ্ঠস্বরগুলো শোনা যাচ্ছে কি না সেটাও দেখতে হবে’। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, গণমাধ্যমের ওপরে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে, একে বিপন্ন করে সেই কণ্ঠস্বরগুলো যাতে আর শুনতে পাওয়া না যায় তার যাবতীয় এন্তেজাম চলছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী—গণমাধ্যমের ওপরে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীনরা লাভবান হয় না কখনোই। বরং মুক্ত গণমাধ্যম থাকলে ক্ষমতাসীনরাই বেশি লাভবান হয়। ১৯৬০-এর দশকে চীন ও ভারতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল এবং এতে চীনে বেশি সংখ্যায় মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাও সে তুং তেমন মতটিই দিয়েছিলেন।