বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ দেশ ও মানুষের মঙ্গল আকাঙ্ক্ষায় নিমগ্ন হয়েছে তার চিন্তা ও কর্মধারা। দেশপ্রেমের ফল্গুধারায় উদ্বেলিত হয়েছে তার হৃদয়। মত ও পথের ভিন্নতা আড়াল করেনি মানবিকতা ও ন্যায়ের পথ। ছিল না ভেদ-বুদ্ধির অন্ধকার। আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি। ‘সবার সঙ্গে মিত্রতা, নয় কারও প্রতি শত্রুতা’- এই ছিল তার কর্মধারা। রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাসে নিরাসক্ত ছিলেন না তিনি। কিন্তু কোনো দল-মতের প্রতি ছিল না প্রশ্নহীন আনুগত্য। উন্মুক্ত ছিল হৃদয়। জাতির প্রয়োজনে উদ্যোগ ও উদ্যমে অগ্রসর হয়েছেন স্বকীয় কর্মধারায়, সংযত-সীমিত থেকেছেন নিজ পরিসরে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে গণতন্ত্র, সুশাসন, সমাজ, সংস্কৃতি ও সংকটের কথা বলেছেন। এটি কোনো দলীয় অবয়বে বিচার করা যায় না। এটি ছিল তার দেশপ্রেম, আদর্শ ও নীতিবোধের সাহসী প্রকাশ। তিনি বরেণ্য শিক্ষাবিদ, দেশের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ।
তিনি কর্তব্যের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন সবসময়। জ্ঞানের বাতিঘর ছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই পুণ্য’। মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে ব্যয় করেছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। শুধু উপদেশ নয়, নিজের আচরণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন সততা, সাহস, সংযম ও শৃঙ্খলা। সজ্জন ও সুন্দর মনের মানুষ হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। নম্রতা, ভদ্রতা ও সৌজন্য ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৫ ডিসেম্বর। সে হিসাবে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৮ বছর। তার আদি বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জে বসতি গড়ে তার পরিবার। তার পিতাও ছিলেন একজন শিক্ষক। মা গৃহিণী। ছাত্রজীবনে মেধাবী হিসেবে তার সুনাম ছিল। নিতান্ত পড়ুয়া ছাত্র ছিলেন না তিনি। সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বোধ ও নেতৃত্বের গুণাবলি ছিল তার। এক পর্যায়ে তিনি রাজশাহী কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। ১৯৬১ সালে আবার ইংরেজিতে এমএ করেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৭৭ সালে কানাডার বিখ্যাত কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতনামা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর আনুকূল্যে তিনি যোগদানপত্র পান। ভালো ছাত্র, ভালো বক্তা ও অধ্যয়নপিপাসু এমাজউদ্দীন নিজেকে ভালো শিক্ষক হিসেবে সহজেই প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমান্বয়ে প্রক্টর, প্রভোস্ট, উপ-উপাচার্য ও উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা ছিল তার। পরবর্তী সময়ে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন। গবেষণা ও লেখালেখিতে অধিকতর মনোনিবেশ করেন।
অর্ধ শতাব্দীর অধিককাল অধ্যাপনা-গবেষণায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থেকে প্রফেসর এমাজউদ্দীন প্রায় ৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘এমাজউদ্দীন রচনাসমগ্র’ বেরিয়েছে গত বছর। আত্মজীবনী লিখছিলেন অবশেষে। এ গ্রন্থগুলোর অধিকাংশই বাংলায়। এগুলো ছিল শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচির পরিপূরক। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে তিনিই পথিকৃৎ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান তথা সমাজবিজ্ঞানের এমন কোনো ক্ষেত্র বা বিষয়বস্তু নেই যে বিষয়ে তিনি কলম ধরেননি। এছাড়া তার সম্পাদিত গ্রন্থ রয়েছে বেশ কয়েকটি।
প্রফেসর এমাজউদ্দীনের জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণের পর বলা যায়, মানবের তরেই বেঁচে ছিলেন তিনি। তার উদ্দেশে বলতে চাই- ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’
ড. আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়