ঢাকা , বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা হস্তান্তর কি শান্তিপূর্ণভাবে হবে

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার প্রায় দু’সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা দূর হয়নি। ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচকমণ্ডলীর ৩০৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হলেও এখন অবধি তা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাইডেনকে এখন অবধি শুভেচ্ছা জানাননি এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য বাইডেনকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাননি। অথচ ২০১৬ সালের এই দিনে ট্রাম্প যখন হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন, তখন বারাক ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই প্রথম আমন্ত্রণ না জানানোর মতো ঘটনা ঘটল। অতীতে এ রকমটি হয়নি কখনও।

ট্রাম্প নিজে বারবার বলে আসছেন নির্বাচনে ‘কারচুপি’ হয়েছে। এ নিয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোতে একাধিক মামলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্প ও তার আইনজীবীরা সুপ্রিমকোর্টে যাবেন বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। মামলা পরিচালনার জন্য প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ট্রাম্প দেশের কয়েকজন শীর্ষ আইনজীবীকে এ কাজের জন্য নিয়োগ করেছেন। যদিও সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, ট্রাম্প ও তার আইনজীবীরা এখন অবধি ‘ভোট চুরির’ কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। একটা যুক্তি ট্রাম্প নিজে উপস্থাপন করেছেন যে, নির্ধারিত সময়ের পর যেসব ‘পোস্টাল ভোট’ এসেছে, তা গ্রহণ করা যাবে না।

তিনি পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ভোট গণনার ক্ষেত্রে এ অভিযোগটি উত্থাপন করেছেন। তবে এটা সবাই জানে যে ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা ব্যাপক হারে এবার ‘পোস্টাল ব্যালট’ প্রদান করেছেন। এর মূল কারণ করোনাভাইরাস। এ করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত করেছে। তবে মার্কিন ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে কারচুপির সম্ভাবনা কম। তারপরও রিপাবলিকান শিবিরের পক্ষ থেকে এ দাবিটি জোরালো করা হয়েছে। এ দাবি নিয়েই তারা সুপ্রিমকোর্টে যাবেন। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভোট জালিয়াতির যে অভিযোগ করেছেন, তা বাতিল করেছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাইবার-সিকিউরিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিআইএসএ)।

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে যখন এক ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর একটি বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। পম্পেও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের একজন। ৯ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, জানুয়ারিতে Smooth transition of power to a second term for President Trump (Townhall 10 November)। অর্থাৎ ট্রাম্প জানুয়ারিতেই তার দ্বিতীয় টার্ম শুরু করবেন। পম্পেও সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও সিআইএ’র প্রধান ছিলেন। তিনি যখন এ ধরনের একটি কথা বলেন, তখন বিতর্কের মাত্রা বাড়ে বৈকি! ১০ নভেম্বর কলামিস্ট ফ্রেড কাপলান নিউজ ম্যাগাজিন SLATE-এ একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যার শিরোনাম ‘Trump is Making a Serious Attempt to Hold onto Power’। মূল বক্তব্য হচ্ছে, যেভাবেই হোক ট্রাম্প ক্ষমতা ধরে রাখতে চাচ্ছেন! দেশরক্ষা মন্ত্রী এসপারকে চাকরিচ্যুত করে তিনি এ মেসেজটিই দিলেন যে তিনি এখনও ক্ষমতায়।

ট্রাম্প কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়া এবং জো বাইডেনকে শুভেচ্ছা না জানানো মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটা খারাপ দৃষ্টান্ত রেখে গেল। অতীতে অনেক ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বার নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেননি। জেরাল্ড ফোর্ড (১৯৭৪-১৯৭৭), জিমি কার্টার (১৯৭৭-১৯৮১) ও জর্জ বুশের (১৯৮৯-১৯৯২) কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। আবার ২২তম প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের (১৮৮৫-১৮৮৯) কথাও আমরা এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে পারি। তিনি ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট, কিন্তু নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী বেঞ্জামিন হ্যারিসনের কাছে হেরে যান। কিন্তু ১৮৯২ সালের নির্বাচনে তিনি আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিজয়ী হন। তিনি ১৮৯৩ সালে দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় থাকেন ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক এখন বলার চেষ্টা করছেন যে, বয়সের কারণে ২০২৪ সালে বাইডেনের পক্ষে হয়তো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব হবে না (তখন তার বয়স হবে ৮২ বছর); সেক্ষেত্রে ট্রাম্প আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন! তবে এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। কী হবে বা হতে পারে, তা এ মুহূর্তে বলা যাবে না।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করতেন, তাতে খোদ রিপাবলিকান পার্টির মাঝেও এক ধরনের অসন্তুষ্টি ছিল। তিনি একটি পারিবারিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার মেয়ে ইভানকা ও জামাই কুশনার ‘বিশেষ উপদেষ্টা’র পদ নিয়ে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়েও তিনি ট্যাক্স দিতেন মাত্র ৭৫০ ডলার, যা বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তিনি তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে চাপিয়ে দিতেন। ব্যবসা আর রাজনীতি যে দুটি ভিন্ন জিনিস- এটা বুঝতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি রাষ্ট্র চালাতেন। তিনি ব্যবসা বোঝেন। কর ফাঁকির বিষয়টি বোঝেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের বিশ্ব আসরে যে একটি ভূমিকা আছে, যেখানে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করে না, এটা ট্রাম্প বোঝেননি। ফলে শুধু চীন নয়, ট্রেডিশনাল মিত্রদের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এখন জো বাইডেন বিশ্ব আসরে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কতটা ফিরিয়ে আনতে পারবেন- এ প্রশ্ন অনেকের।

এখানে বলা ভালো, জো বাইডেন একজন সিনেটর হিসেবে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সিনেট কমিটিতে কাজ করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি ২০০১-০৩ ও ২০০৭-০৯ সময়ে দু-দুবার সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির সদস্য ছিলেন। ফলে বৈদেশিক সম্পর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ আলোকেই বলা যায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এখন দেখার পালা এ অঞ্চলে তিনি কীভাবে মার্কিন স্বার্থ আদায়ে উদ্যোগী হন। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ হিসাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হচ্ছে চীনের (১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার)। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি দেশকে এককাতারে নিয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার প্রভাব বলয় বিস্তার করছে বলে অনেকে মনে করেন। যদিও এটা ঠিক, অতীতে চীন কখনও কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল না। দেশটির আধিপত্য বিস্তারের কোনো ইতিহাসও নেই। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চীনের এ কর্মসূচির ব্যাপারে সন্দিহান। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশীয়-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি খুবই জরুরি। এ অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। দক্ষিণ চীন সাগরে তেলের রিজার্ভ রয়েছে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ব্যারেল, আর গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার জ্বালানি চাহিদার অনেকটাই মেটাবে। যুক্তরাষ্ট্রও চায় এ জ্বালানি সম্পদের ভাগিদার হতে। সুতরাং এখানেও একটা চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক ও মালবাহী জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরের জলপথ ব্যবহার করে চলাচল করে। এ কারণেই এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বেইজিং, যা মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। তাই চীনকে মোকাবেলায় জাপানকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তার আরেকটি কারণ। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভয়টা ওই দেশকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীনের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে তার নৌবাহিনীকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করাতে পারে, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সামরিক কৌশলগত জলসীমা হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা রয়েছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৬০ শতাংশ সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর। সেক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন এ ধরনের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাইডেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন বেশি।

ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে পশ্চিম ইউরোপ তথা ন্যাটোভুক্ত দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। ন্যাটোর দেশগুলোকে ন্যাটোতে দেয়া অনুদানের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছেন। তিনি মুসলমান বিদ্বেষের কারণে কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি সমঝোতা থেকে ট্রাম্প বেরিয়ে গেছেন। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক ঝুঁকি কমেনি, বরং বেড়েছে। তার প্রো-ইসরাইলি নীতি ফিলিস্তিনি সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে গেছে। এ সংকট সমাধানের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

মোদ্দা কথা, ট্রাম্প গেল চার বছরে বিশ্বকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তা থেকে বেরিয়ে না এলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব আসরে একা হয়ে যাবে। তাতে করে সুবিধা নেবে চীন। কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে দুটো বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, দুই. বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে কোভিড-১৯-এর টিকা পৌঁছে দেয়া। এ দুটি ক্ষেত্রে যদি যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রশাসন কোনো ভূমিকা নেয়, তাহলে তা দেশটির ভাবমূর্তি উদ্ধারে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব আসরে তার অবস্থানও শক্তিশালী করবে। আশার কথা, জো বাইডেন দুটি ক্ষেত্রেই ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে (কপ-২১) ফিরে যাবে। একইসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফিরে গিয়ে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মোকাবেলায়ও একটি ভূমিকা রাখবে। এদিকে চীন দেরিতে হলেও জো বাইডেনের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে।

তবে আশঙ্কার জায়গা আছে অনেক। ১. পেনসিলভানিয়ার একজন বিচারপতি একটি রায় দিয়েছেন- তাতে তিনি বলেছেন, যে ভোটগুলো পরে এসেছিল এবং যা আলাদা করে রাখতে বলা হয়েছিল, তা গণনা করা যাবে না। ওই বিচারপতির মতো পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের সেক্রেটারি অব স্টেট ক্যাথি বুকভার নির্বাচনের আগে ১ নভেম্বর (২০২০) যে আদেশ জারি করেছিলেন (পোস্টাল ব্যালট সংক্রান্ত), তা ওই রাজ্যের নির্বাচন সংক্রান্ত বিধিমালার সেকশন ১৩০৮(এইচ)কে সমর্থন করে না (Townhall, Nov. 12)। এই আদেশ ট্রাম্প সমর্থকদের দাবিকে সমর্থন করবে। শুধু তাই নয়, ট্রাম্পের আইনজীবী গুলিয়ানি দাবি করেছেন, ৬ লাখ ৫০ হাজার ভোট অবৈধভাবে ফিলাডেলফিয়া ও পিটসবার্গে গণনা করা হয়েছে (ZeroHedge, 12 Nov.)। গুলিয়ানির বক্তব্য ও কোর্টের রায় অনেকটা একই। ২. নিউজ পোর্টাল Alter Net-এর একটি প্রতিবেদন ‘We’re Witnessing the birth of a dangerous new strain in the right-wing movement’ (11 Nov.)। এটি লিখেছেন Joshua Holland। বক্তব্য স্পষ্ট- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের জমানায় উগ্র দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটেছে। 3. Hoffpost-এর একটি শিরোনাম ‘Why Trumps transition chaos is a national security nightmare’ (11 Nov.). প্রতিবেদক লিখছেন, ট্রাম্প আরও ১০ সপ্তাহ ‘কমান্ডার ইন চিফ’ হিসেবে থাকবেন। এ সময়ে তার যে কোনো সিদ্ধান্ত সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে যাবে। ৪. কোনো কোনো নিউজ পোর্টাল (OEN) আশঙ্কা করছে, Trump and Republicans Staging a Hayes/Tilden Coup; They Don’t Need to Win Lawsuits, Just Stall (Rob Kall-এর প্রবন্ধ, 11 Nov.)। ১৮৭৬ সালের নির্বাচনে (হায়েস-রিপাবলিকান বনাম টিলডেন ডেমোক্র্যাট) এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ২৭০ নির্বাচনকমণ্ডলীর ভোট উভয় প্রার্থী পাওয়ায় প্রতিনিধি পরিষদে বিষয়টি যায় এবং অত্যন্ত কৌশলে হায়েসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। এ ধরনের একটি অপচেষ্টাকে ‘coup attempt’ বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। Dahlia LithwickI তার প্রবন্ধে এই ‘coup attempt’-এর কথা বলেছেন (Slate, 10 Nov.)।

২০ জানুয়ারি নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেবেন। মাঝখানে এখনও অনেক কিছু ঘটতে পারে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায়- এ পরিস্থিতি মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রতিটি দেশকে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে গণতন্ত্রের ‘সবক’ দেয়। এখন নিজ দেশের গণতন্ত্রই প্রশ্নের মুখে। শেষ অবধি জো বাইডেনকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে। কিন্তু ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পর একের পর এক যা ঘটে চলেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।

তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

tsrahmanbd@yahoo.com

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা হস্তান্তর কি শান্তিপূর্ণভাবে হবে

আপডেট টাইম : ০৫:১৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার প্রায় দু’সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা দূর হয়নি। ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচকমণ্ডলীর ৩০৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হলেও এখন অবধি তা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাইডেনকে এখন অবধি শুভেচ্ছা জানাননি এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য বাইডেনকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাননি। অথচ ২০১৬ সালের এই দিনে ট্রাম্প যখন হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন, তখন বারাক ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই প্রথম আমন্ত্রণ না জানানোর মতো ঘটনা ঘটল। অতীতে এ রকমটি হয়নি কখনও।

ট্রাম্প নিজে বারবার বলে আসছেন নির্বাচনে ‘কারচুপি’ হয়েছে। এ নিয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোতে একাধিক মামলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্প ও তার আইনজীবীরা সুপ্রিমকোর্টে যাবেন বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। মামলা পরিচালনার জন্য প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ট্রাম্প দেশের কয়েকজন শীর্ষ আইনজীবীকে এ কাজের জন্য নিয়োগ করেছেন। যদিও সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, ট্রাম্প ও তার আইনজীবীরা এখন অবধি ‘ভোট চুরির’ কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। একটা যুক্তি ট্রাম্প নিজে উপস্থাপন করেছেন যে, নির্ধারিত সময়ের পর যেসব ‘পোস্টাল ভোট’ এসেছে, তা গ্রহণ করা যাবে না।

তিনি পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ভোট গণনার ক্ষেত্রে এ অভিযোগটি উত্থাপন করেছেন। তবে এটা সবাই জানে যে ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা ব্যাপক হারে এবার ‘পোস্টাল ব্যালট’ প্রদান করেছেন। এর মূল কারণ করোনাভাইরাস। এ করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত করেছে। তবে মার্কিন ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে কারচুপির সম্ভাবনা কম। তারপরও রিপাবলিকান শিবিরের পক্ষ থেকে এ দাবিটি জোরালো করা হয়েছে। এ দাবি নিয়েই তারা সুপ্রিমকোর্টে যাবেন। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভোট জালিয়াতির যে অভিযোগ করেছেন, তা বাতিল করেছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাইবার-সিকিউরিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিআইএসএ)।

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে যখন এক ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর একটি বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। পম্পেও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের একজন। ৯ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, জানুয়ারিতে Smooth transition of power to a second term for President Trump (Townhall 10 November)। অর্থাৎ ট্রাম্প জানুয়ারিতেই তার দ্বিতীয় টার্ম শুরু করবেন। পম্পেও সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও সিআইএ’র প্রধান ছিলেন। তিনি যখন এ ধরনের একটি কথা বলেন, তখন বিতর্কের মাত্রা বাড়ে বৈকি! ১০ নভেম্বর কলামিস্ট ফ্রেড কাপলান নিউজ ম্যাগাজিন SLATE-এ একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যার শিরোনাম ‘Trump is Making a Serious Attempt to Hold onto Power’। মূল বক্তব্য হচ্ছে, যেভাবেই হোক ট্রাম্প ক্ষমতা ধরে রাখতে চাচ্ছেন! দেশরক্ষা মন্ত্রী এসপারকে চাকরিচ্যুত করে তিনি এ মেসেজটিই দিলেন যে তিনি এখনও ক্ষমতায়।

ট্রাম্প কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়া এবং জো বাইডেনকে শুভেচ্ছা না জানানো মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটা খারাপ দৃষ্টান্ত রেখে গেল। অতীতে অনেক ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বার নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেননি। জেরাল্ড ফোর্ড (১৯৭৪-১৯৭৭), জিমি কার্টার (১৯৭৭-১৯৮১) ও জর্জ বুশের (১৯৮৯-১৯৯২) কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। আবার ২২তম প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের (১৮৮৫-১৮৮৯) কথাও আমরা এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে পারি। তিনি ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট, কিন্তু নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী বেঞ্জামিন হ্যারিসনের কাছে হেরে যান। কিন্তু ১৮৯২ সালের নির্বাচনে তিনি আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিজয়ী হন। তিনি ১৮৯৩ সালে দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় থাকেন ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক এখন বলার চেষ্টা করছেন যে, বয়সের কারণে ২০২৪ সালে বাইডেনের পক্ষে হয়তো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব হবে না (তখন তার বয়স হবে ৮২ বছর); সেক্ষেত্রে ট্রাম্প আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন! তবে এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। কী হবে বা হতে পারে, তা এ মুহূর্তে বলা যাবে না।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করতেন, তাতে খোদ রিপাবলিকান পার্টির মাঝেও এক ধরনের অসন্তুষ্টি ছিল। তিনি একটি পারিবারিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার মেয়ে ইভানকা ও জামাই কুশনার ‘বিশেষ উপদেষ্টা’র পদ নিয়ে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়েও তিনি ট্যাক্স দিতেন মাত্র ৭৫০ ডলার, যা বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তিনি তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে চাপিয়ে দিতেন। ব্যবসা আর রাজনীতি যে দুটি ভিন্ন জিনিস- এটা বুঝতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি রাষ্ট্র চালাতেন। তিনি ব্যবসা বোঝেন। কর ফাঁকির বিষয়টি বোঝেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের বিশ্ব আসরে যে একটি ভূমিকা আছে, যেখানে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করে না, এটা ট্রাম্প বোঝেননি। ফলে শুধু চীন নয়, ট্রেডিশনাল মিত্রদের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এখন জো বাইডেন বিশ্ব আসরে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কতটা ফিরিয়ে আনতে পারবেন- এ প্রশ্ন অনেকের।

এখানে বলা ভালো, জো বাইডেন একজন সিনেটর হিসেবে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সিনেট কমিটিতে কাজ করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি ২০০১-০৩ ও ২০০৭-০৯ সময়ে দু-দুবার সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির সদস্য ছিলেন। ফলে বৈদেশিক সম্পর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ আলোকেই বলা যায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এখন দেখার পালা এ অঞ্চলে তিনি কীভাবে মার্কিন স্বার্থ আদায়ে উদ্যোগী হন। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ হিসাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হচ্ছে চীনের (১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার)। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি দেশকে এককাতারে নিয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার প্রভাব বলয় বিস্তার করছে বলে অনেকে মনে করেন। যদিও এটা ঠিক, অতীতে চীন কখনও কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল না। দেশটির আধিপত্য বিস্তারের কোনো ইতিহাসও নেই। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চীনের এ কর্মসূচির ব্যাপারে সন্দিহান। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশীয়-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি খুবই জরুরি। এ অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। দক্ষিণ চীন সাগরে তেলের রিজার্ভ রয়েছে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ব্যারেল, আর গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার জ্বালানি চাহিদার অনেকটাই মেটাবে। যুক্তরাষ্ট্রও চায় এ জ্বালানি সম্পদের ভাগিদার হতে। সুতরাং এখানেও একটা চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক ও মালবাহী জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরের জলপথ ব্যবহার করে চলাচল করে। এ কারণেই এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বেইজিং, যা মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। তাই চীনকে মোকাবেলায় জাপানকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তার আরেকটি কারণ। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভয়টা ওই দেশকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীনের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে তার নৌবাহিনীকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করাতে পারে, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সামরিক কৌশলগত জলসীমা হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা রয়েছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৬০ শতাংশ সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর। সেক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন এ ধরনের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাইডেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন বেশি।

ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে পশ্চিম ইউরোপ তথা ন্যাটোভুক্ত দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। ন্যাটোর দেশগুলোকে ন্যাটোতে দেয়া অনুদানের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছেন। তিনি মুসলমান বিদ্বেষের কারণে কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি সমঝোতা থেকে ট্রাম্প বেরিয়ে গেছেন। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক ঝুঁকি কমেনি, বরং বেড়েছে। তার প্রো-ইসরাইলি নীতি ফিলিস্তিনি সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে গেছে। এ সংকট সমাধানের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

মোদ্দা কথা, ট্রাম্প গেল চার বছরে বিশ্বকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তা থেকে বেরিয়ে না এলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব আসরে একা হয়ে যাবে। তাতে করে সুবিধা নেবে চীন। কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে দুটো বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, দুই. বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে কোভিড-১৯-এর টিকা পৌঁছে দেয়া। এ দুটি ক্ষেত্রে যদি যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রশাসন কোনো ভূমিকা নেয়, তাহলে তা দেশটির ভাবমূর্তি উদ্ধারে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব আসরে তার অবস্থানও শক্তিশালী করবে। আশার কথা, জো বাইডেন দুটি ক্ষেত্রেই ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে (কপ-২১) ফিরে যাবে। একইসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফিরে গিয়ে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মোকাবেলায়ও একটি ভূমিকা রাখবে। এদিকে চীন দেরিতে হলেও জো বাইডেনের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে।

তবে আশঙ্কার জায়গা আছে অনেক। ১. পেনসিলভানিয়ার একজন বিচারপতি একটি রায় দিয়েছেন- তাতে তিনি বলেছেন, যে ভোটগুলো পরে এসেছিল এবং যা আলাদা করে রাখতে বলা হয়েছিল, তা গণনা করা যাবে না। ওই বিচারপতির মতো পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের সেক্রেটারি অব স্টেট ক্যাথি বুকভার নির্বাচনের আগে ১ নভেম্বর (২০২০) যে আদেশ জারি করেছিলেন (পোস্টাল ব্যালট সংক্রান্ত), তা ওই রাজ্যের নির্বাচন সংক্রান্ত বিধিমালার সেকশন ১৩০৮(এইচ)কে সমর্থন করে না (Townhall, Nov. 12)। এই আদেশ ট্রাম্প সমর্থকদের দাবিকে সমর্থন করবে। শুধু তাই নয়, ট্রাম্পের আইনজীবী গুলিয়ানি দাবি করেছেন, ৬ লাখ ৫০ হাজার ভোট অবৈধভাবে ফিলাডেলফিয়া ও পিটসবার্গে গণনা করা হয়েছে (ZeroHedge, 12 Nov.)। গুলিয়ানির বক্তব্য ও কোর্টের রায় অনেকটা একই। ২. নিউজ পোর্টাল Alter Net-এর একটি প্রতিবেদন ‘We’re Witnessing the birth of a dangerous new strain in the right-wing movement’ (11 Nov.)। এটি লিখেছেন Joshua Holland। বক্তব্য স্পষ্ট- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের জমানায় উগ্র দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটেছে। 3. Hoffpost-এর একটি শিরোনাম ‘Why Trumps transition chaos is a national security nightmare’ (11 Nov.). প্রতিবেদক লিখছেন, ট্রাম্প আরও ১০ সপ্তাহ ‘কমান্ডার ইন চিফ’ হিসেবে থাকবেন। এ সময়ে তার যে কোনো সিদ্ধান্ত সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে যাবে। ৪. কোনো কোনো নিউজ পোর্টাল (OEN) আশঙ্কা করছে, Trump and Republicans Staging a Hayes/Tilden Coup; They Don’t Need to Win Lawsuits, Just Stall (Rob Kall-এর প্রবন্ধ, 11 Nov.)। ১৮৭৬ সালের নির্বাচনে (হায়েস-রিপাবলিকান বনাম টিলডেন ডেমোক্র্যাট) এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ২৭০ নির্বাচনকমণ্ডলীর ভোট উভয় প্রার্থী পাওয়ায় প্রতিনিধি পরিষদে বিষয়টি যায় এবং অত্যন্ত কৌশলে হায়েসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। এ ধরনের একটি অপচেষ্টাকে ‘coup attempt’ বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। Dahlia LithwickI তার প্রবন্ধে এই ‘coup attempt’-এর কথা বলেছেন (Slate, 10 Nov.)।

২০ জানুয়ারি নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেবেন। মাঝখানে এখনও অনেক কিছু ঘটতে পারে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায়- এ পরিস্থিতি মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রতিটি দেশকে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে গণতন্ত্রের ‘সবক’ দেয়। এখন নিজ দেশের গণতন্ত্রই প্রশ্নের মুখে। শেষ অবধি জো বাইডেনকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে। কিন্তু ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পর একের পর এক যা ঘটে চলেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।

তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

tsrahmanbd@yahoo.com