ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধে আসুন এগিয়ে আসি

২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস এলায়েন্স এর আহবানে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, ভাইরাল হেপাটাইটিস এর বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‌‘আমরা অপেক্ষা করি না’।

হেপাটাইটিস এখনই নির্ণয় করতে পরীক্ষা করতে হবে। যার শরীরে হেপাটাইটিস নির্ণয় হবে বা পজেটিভ আসবে- তার তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিতে হবে। আর যাদের নেগেটিভ আসবে-তার জন্য হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে টিকা নিতে হবে। হেপাটাইটিস সি এর কোনো প্রতিরোধক টিকা নেই তাই সর্বাত্তক ব্যক্তিগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভাইরাল হেপাটাইটিস জনিত কারণে পৃথিবীতে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মৃত্যুবরণ করে।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী, ডিরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি পৃথক পৃথক বাণী প্রদান করেন। দিবসটি উপলক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস এলায়েন্স এর প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ কে বিশেষ বাণী প্রদান করেন।

হেপাটাইটিস সম্বন্ধে ধারণা
হেপাটাইটিস (লিভারের প্রদাহ) সাধারণত : এ, বি, সি, ডি ও ই – এই পাঁচ ধরনের ভাইরাস এর কারণে হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ খাদ্য ও পানীয় জল বাহিত। যা থেকে একুইট (তীব্র) হেপাটাইটিস হয়ে থাকে এবং সাধারণত ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে সেরে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক লিভার ফেইলিউর হতে পারে।

হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস গর্ভকালীন অবস্থায় গর্ভবতী মা ও সন্তানের জন্য জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। হেপাটাইটিস-ডি সাধারণত হেপাটাইটিস-বি এর সাথে তার প্রদাহ ক্রিয়া করে থাকে।

প্রধান উদ্বেগ হচ্ছে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ৩৫৪ মিলিয়ন মানুষের হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ রয়েছে, হেপাটাইটিস-বি ২৯৬ মিলিয়ন এবং হেপাটাইটিস-সি ৫৮ মিলিয়ন। যার জন্য প্রায় ১.১ মিলিয়ন মানুষ প্রতি বৎসর মৃত্যুবরণ করে। ভাইরাল হেপাটাইটিস মানুষের মৃত্যুর ১০ম কারণ।

হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার এর প্রধান কারণ। লিভার ক্যান্সার মানুষের মৃত্যুর ক্যান্সার জনিত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। হেপাটাইটিস-বি জনিত ৫৪% এবং হেপাটাইটিস-সি জনিত ৩১% লিভার ক্যান্সার হয়ে থাকে। ভাইরাল হেপাটইটিস জনিত ১০ জনের ৯ জনই জানে না যে তাদের শরীরে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস আছে। নীরবে দীর্ঘদিন ধরে লিভার এর ক্ষতিসাধন করে লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার ও লিভার ফেইলিওর করে থাকে – এ জন্য এই দুই ভাইরাস কে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়।

শিশুদের ক্ষেত্রে এর ভয়াবহতা বেশি। আক্রান্ত মায়ের থেকে সন্তানের অথবা শিশু অবস্থায় আক্রান্ত হলে ৮০% থেকে ৯০% এর দীর্ঘমেয়াদী হেপাটাইটিস হয় এবং প্রায় ২০%-২৫% প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশ্বে মাত্র ১% হেপাটাইটিস-বি এবং ১.৫% হেপাটাইটিস-সি আক্রান্তদের চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬৬ মিলিয়ন এর অধিক। প্রায় ৫.৫% এর হেপাটাইটিস-বি এবং ১% এর কম হেপাটাইটিস-সি রয়েছে। ধারণা করা হয় প্রায় ১ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ তে আক্রান্ত। মোট জনসংখ্যার ৬০% এর অধিক গ্রামে বাস করে। গ্রামীণ জনসাধারণের হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ সম্পর্কে ধারণা অনেক কম।

তাছাড়া সচেতনতা, প্রতিরোধ ব্যবস্থা, চিকিৎসা ও অপ্রতুল। এছাড়া ভাইরাল হেপাটাইটিস সম্পর্কে নানা রকম ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। জটিল অবস্থায় অথবা শেষ পর্যন্ত রোগ নির্ণয় হওয়া রোগ চিকিৎসার নাগালের বাহিরে চলে গিয়ে রোগীর জীবন বিপন্ন হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ চিকিৎসা বেশির ভাগক্ষেত্রে শহর কেন্দ্রীক। অনেক সময় প্রয়োজনে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসা সেবা নাগালের বাহিরে থেকে যায়। ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে আরও এগিয়ে নেওয়া, যাতে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ এর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া যায়।

প্রতিরোধের উপায় সমূহ
হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ রক্ত, রক্তের উপাদান এবং বডি ফ্লুইডস (বীর্য, অশ্রু, মুখের লালা ইত্যাদি) এর মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হয়ে থাকে। নিম্নলিখিত বিষয় সমূহ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।

ক) রক্ত পরিসঞ্চালনের পূর্বে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের জন্য নিশ্চিত নিরীক্ষা অবশ্যকরণীয়। খ) একবার ব্যবহার্য সিরিঞ্জ ও সূচের ব্যবহার নিশ্চিত করণ। গ) নিজস্ব দাঁতের ব্রাশ, রেজার, কাঁচি ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। ঘ) চুল কাটার পরে এবং শেভ করার সময় একবার ব্যবহার্য ব্লেড ব্যবহার। ঙ) নিরাপদ যৌন চার্চা। চ) হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনোক্রমেই রক্ত বা অঙ্গ দানকারী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা যাবে না। জ) নাক-কান ছিদ্র করা এবং টেট্টু করার সময় একই সূচ ব্যবহার না করা। ঘ) সবধরণের সার্জারি এবং দাঁতের চিকিৎসায় জীবাণু মুক্ত যন্ত্র ব্যবহার নিশ্চিত করা।

নির্দিষ্ট নিয়মে টিকা গ্রহণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস-বি প্রতিরোধ করা হয়। টিকা গ্রহণের আগে অবশ্যই হেপাটাইটিস-বি স্ক্রিনিং করে নেওয়া উচিৎ। হেপাটাইটিস সি এর প্রতিরোধক কোনো টিকা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। তাই ব্যক্তিগত প্রতিরোধই এই রোগের একমাত্র প্রতিরোধক ব্যবস্থা। সামাজিক মেলামেশায় (হ্যান্ড শেক, কোলাকুলি) ভাইরাল হেপাটাইটিস ছড়ায় না। এমনকি রোগীর ব্যবহার্য দ্রবাদি যেমন : গ্লাস, চামচ, জামা-কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমেও এই রোগ ছড়ায় না। শুধু যে সমস্ত দ্রব্য রোগীর রক্তের সংস্পর্শে আসে (ক্ষুর, ব্লেড, রেজার, টুথব্রাশ, সূচ) সেগুলোর মাধ্যমেই এই রোগ ছড়াতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার সমগ্র দেশব্যাপী ১৮ হাজার ৫০০ এর অধিক কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে, যা বাংলাদেশ এর স্বাস্থ্যখাতে বিশাল অগ্রগতি। প্রত্যেকটা কমিউনিটি ক্লিনিককে গ্রামীণ বাংলাদেশের ‘ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কমিউনিটি ক্লিনিককে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কার্যক্রম পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এতে হেপাটাইটিস প্রতিরোধের জন্য বার্তা, গ্রামীণ অজানা আক্রান্তদের কাছে পৌঁছাতে, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা’ সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছাতে সহজ হবে। সরকারের সাথে অন্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে। হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন সহজলভ্য করা, চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ মনুষের সহজলভ্য ও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা জরুরি। লাখ লাখ রোগাক্রান্তদের সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাই হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায়।

হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত মা থেকে নবজাতকের সংক্রমণই হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস সংক্রমণের প্রধান কারণ। হেপাটাইটিস-বি এর ক্ষেত্রে প্রায় ৪০% থেকে ৯০% এবং হেপাটাইটিস-সি এর ক্ষেত্রে প্রায় ৫%। জন্মের সময় সংক্রমিত হেপাটাইটিস-বি এর ক্ষেত্রে শিশু বয়সের প্রায় ৯৫% এর ক্রনিক হেপাটাইটিস হয়। যার জন্য নবজাতক ও শিশুদের প্রতিরোধক ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনোগ্লোবিউলিন (প্রয়োজনে) জরুরি। প্রত্যেক গর্ভবতী মায়েদের হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ টেস্ট করা উচিৎ এবং চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতক কে হেপাটাইটিস-বি ভ্যাক্সিন এবং মা হেপাটাইটিস-বি ই-এন্টিজেন / এইচবিভি ডিএনএ পজিটিভ হলে নবজাতক কে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হেপাটাইটিস-বি ভ্যাক্সিন ও হেপাটাইটিস-বি ইমিউনোগ্লোবিউলিন দিতে হবে। পরে আরও দুই ডোজ ভ্যাক্সিন ১-২ মাসে এবং ৬ মাসে দিতে হবে।

আমাদের দেশের প্রায় ৪৮% ডেলিভারি গ্রামের বাড়িতে ধাত্রী / দাই এর মাধ্যমে হয়। গ্রামের গর্ভাবস্থায় নারীদের এই ব্যপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। ধাত্রীদেরও ডেলিভারি এর সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং নবজাতক জন্মের সাথে সাথে ভ্যাক্সিন দেওয়া জরুরি।

বেশির ভাগ দাই বা মিডওয়াইফদের হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন এর ধারণাই নাই, তাদেরও হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাক্সিন এর ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া ভ্যাক্সিন ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন সহজল্যভ্য করা, ইপিআই সিডিউলে বার্থডোজ সংযুক্ত করা, যা বর্তমানে জন্মের ৬ সপ্তাহে ডিপিটি এর সাথে ৬, ১০, ১৪ সপ্তাহে দেওয়া হচ্ছে।

হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত মা থেকে নবজাতকের অথবা অন্যকোনো ভাবে, জন্মের সাথে সাথে, জন্মস্থানে অথবা পরবর্তিতে  শিশু অবস্থায় হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত হলে ৮০% থেকে ৯০% এর দীর্ঘমেয়াদী হেপাটাইটিস হয় এবং অল্প বয়সেই অনেকে মৃত্যুবরণ করে। হেপাটাইটিস বি যত কম বয়সে সংক্রমিত হয় তত জটিলতা এবং মৃত্যুর হার ও বেশি হয়, ৬ বছর এর কম সময়ে সংক্রমিত হলে ঝুকি অনেক বেশি। প্রত্যেক শিশুকে (১৩ বছর এর মধ্যে) হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন দেওয়া জরুরি। হেপাটাইটিস বি বার্থডোজ ও শিশু অবস্থায় হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন সর্বচ্চো প্রয়োগ করা, যাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর লক্ষমাত্রা অনুযায়ী ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ ২০৩০ সালের মধ্যে ০.১% এর কমে, কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।

আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, সরকার, সমগ্র বাংলাদেশে অত্যন্ত সফলতার সাথে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) পরিচালনা করে আসছে এবং এর সফলতার স্বীকৃতি স্বরুপ গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনেশন এন্ড ইমিউনাইজেশন প্রধানমন্ত্রীকে ২০১৯ সালে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করেছে।

আমরা অত্যন্ত গর্বিত। আমরা আশা করছি সম্প্রসারিত টিকাদানের এই সফলতা বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি এর বার্থডোজ, শিশুদের ভ্যাকসিনেশন, সর্বসাধারণের ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

চিকিৎসা
বাংলাদেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ চিকিৎসার সবধরনের মুখে খাওয়া এবং ইনজেকশন বিদ্যমান। হেপাটাইটিস-সি এর আরোগ্য লাভকারী ওষুধ ও পাওয়া যাচ্ছে।

হেপাটাইটিস-বি এর চিকিৎসায় দীর্ঘদিন, মাসের পর মাস চালিয়ে যেতে হয়, কোনো কোনো সময় বছরের পর বছর। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো কারণে অথবা অর্থের অভাবে হঠাৎ রোগী ওষুধ বন্ধ করে দেয়। এতে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস ফ্লেয়ার বা বিস্তার লাভ করে রোগীর অবস্থা জটিলের দিকে চলে যায়। হেপাটাইটিস-সি এর মুখে খাওয়ার ওষুধও প্রায় ৯৫% কার্যকরী। ওষুধটি দামী তাই অনেকেই তা গ্রহণ করতে পারে না। আশার কথা সরকারিভাবে কোনো কোনো সেন্টারে হেপাটাইটিস সি এর ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে – এই কার্যক্রম কে সাধুবাদ জানাই। আশাকরি এই কার্যক্রম দেশের বিভিন্ন সেন্টারে মানুষের দোরগোড়ায় সম্প্রসারিত করা হবে। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ এর ওষুধ সহজলভ্য করা যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা যায়। বাংলাদেশ সরকার কে ভাইরাল হেপাটাইটিস ওষুধের জন্য ভর্তুকি প্রদান করে আক্রান্তদের সাহায্য করা জরুরি।

বাংলাদেশে হেপাটাইটিস নির্মূল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৬৯তম ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলী (২৮ মে ২০১৬) সর্ব সম্মতিক্রমে ১৯৪ টি সদস্য রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৫ টি মূল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, ১। ভ্যাক্সিনেশন, ২। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মা থেকে সন্তানের সংক্রমণ প্রতিরোধ, ৩। নিরাপদ ইন্জেকশন , রক্ত সঞ্চালন ও সার্জিকাল সেফটি, ৪। ক্ষতির মাত্রা কমানো এবং ৫। আক্রান্তদের চিকিৎসা।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ৯০% প্রতিরোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসা পাবে। ৯০% নবজাতক বার্থডোজ পাবে এবং নতুন সংক্রমনের হার ৯০% কমে যাবে। প্রতি বছর মৃত্যুর হার ১.৪ মিলিয়ন থেকে; ০.৫ মিলিয়নের কম হবে। সার্বিকভাবে  ২০৩০ সালের মধ্যে ৭ মিলিয়নের অধিক জীবন রক্ষা পাবে। ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলে আর্থিক বিনিয়োগ জরুরি যা আমাদের এসডিজি ৩ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সহায়ক হবে।

সরকারও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকার এর “ন্যাশনাল অপারেশনাল প্ল্যান ফর ইলিমিনেশন অব ভাইরাল হেপাটাইটিস ইন বাংলাদেশ” একটি সময়োপযোগী উদ্দ্যোগ। ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এই অতিপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ কে স্বাগত জানাচ্ছে এবং এর সাথে সম্পৃক্ত আছে। আশাকরি সাধারণ মানুষের দোর গোড়ায় হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ এর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। উক্ত ন্যাশনাল প্ল্যান বাস্তবায়নে বাংলাদেশে
২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশে ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধ এবং আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানই আমাদের মূল লক্ষ্য। ভাইরাল হেপাটাইটিস মুক্ত প্রজন্মই হবে আগামী দিনের সেরা অর্জন। আসুন আমরা হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করি। ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস মুক্ত বাংলাদেশ গড়ি এটাই হোক বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, মহাসচিব, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধে আসুন এগিয়ে আসি

আপডেট টাইম : ০৪:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩১ জুলাই ২০২৩

২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস এলায়েন্স এর আহবানে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, ভাইরাল হেপাটাইটিস এর বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‌‘আমরা অপেক্ষা করি না’।

হেপাটাইটিস এখনই নির্ণয় করতে পরীক্ষা করতে হবে। যার শরীরে হেপাটাইটিস নির্ণয় হবে বা পজেটিভ আসবে- তার তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিতে হবে। আর যাদের নেগেটিভ আসবে-তার জন্য হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে টিকা নিতে হবে। হেপাটাইটিস সি এর কোনো প্রতিরোধক টিকা নেই তাই সর্বাত্তক ব্যক্তিগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভাইরাল হেপাটাইটিস জনিত কারণে পৃথিবীতে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মৃত্যুবরণ করে।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী, ডিরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি পৃথক পৃথক বাণী প্রদান করেন। দিবসটি উপলক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস এলায়েন্স এর প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ কে বিশেষ বাণী প্রদান করেন।

হেপাটাইটিস সম্বন্ধে ধারণা
হেপাটাইটিস (লিভারের প্রদাহ) সাধারণত : এ, বি, সি, ডি ও ই – এই পাঁচ ধরনের ভাইরাস এর কারণে হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ খাদ্য ও পানীয় জল বাহিত। যা থেকে একুইট (তীব্র) হেপাটাইটিস হয়ে থাকে এবং সাধারণত ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে সেরে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক লিভার ফেইলিউর হতে পারে।

হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস গর্ভকালীন অবস্থায় গর্ভবতী মা ও সন্তানের জন্য জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। হেপাটাইটিস-ডি সাধারণত হেপাটাইটিস-বি এর সাথে তার প্রদাহ ক্রিয়া করে থাকে।

প্রধান উদ্বেগ হচ্ছে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ৩৫৪ মিলিয়ন মানুষের হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ রয়েছে, হেপাটাইটিস-বি ২৯৬ মিলিয়ন এবং হেপাটাইটিস-সি ৫৮ মিলিয়ন। যার জন্য প্রায় ১.১ মিলিয়ন মানুষ প্রতি বৎসর মৃত্যুবরণ করে। ভাইরাল হেপাটাইটিস মানুষের মৃত্যুর ১০ম কারণ।

হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার এর প্রধান কারণ। লিভার ক্যান্সার মানুষের মৃত্যুর ক্যান্সার জনিত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। হেপাটাইটিস-বি জনিত ৫৪% এবং হেপাটাইটিস-সি জনিত ৩১% লিভার ক্যান্সার হয়ে থাকে। ভাইরাল হেপাটইটিস জনিত ১০ জনের ৯ জনই জানে না যে তাদের শরীরে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস আছে। নীরবে দীর্ঘদিন ধরে লিভার এর ক্ষতিসাধন করে লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার ও লিভার ফেইলিওর করে থাকে – এ জন্য এই দুই ভাইরাস কে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়।

শিশুদের ক্ষেত্রে এর ভয়াবহতা বেশি। আক্রান্ত মায়ের থেকে সন্তানের অথবা শিশু অবস্থায় আক্রান্ত হলে ৮০% থেকে ৯০% এর দীর্ঘমেয়াদী হেপাটাইটিস হয় এবং প্রায় ২০%-২৫% প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশ্বে মাত্র ১% হেপাটাইটিস-বি এবং ১.৫% হেপাটাইটিস-সি আক্রান্তদের চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬৬ মিলিয়ন এর অধিক। প্রায় ৫.৫% এর হেপাটাইটিস-বি এবং ১% এর কম হেপাটাইটিস-সি রয়েছে। ধারণা করা হয় প্রায় ১ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ তে আক্রান্ত। মোট জনসংখ্যার ৬০% এর অধিক গ্রামে বাস করে। গ্রামীণ জনসাধারণের হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ সম্পর্কে ধারণা অনেক কম।

তাছাড়া সচেতনতা, প্রতিরোধ ব্যবস্থা, চিকিৎসা ও অপ্রতুল। এছাড়া ভাইরাল হেপাটাইটিস সম্পর্কে নানা রকম ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। জটিল অবস্থায় অথবা শেষ পর্যন্ত রোগ নির্ণয় হওয়া রোগ চিকিৎসার নাগালের বাহিরে চলে গিয়ে রোগীর জীবন বিপন্ন হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ চিকিৎসা বেশির ভাগক্ষেত্রে শহর কেন্দ্রীক। অনেক সময় প্রয়োজনে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসা সেবা নাগালের বাহিরে থেকে যায়। ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে আরও এগিয়ে নেওয়া, যাতে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ এর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া যায়।

প্রতিরোধের উপায় সমূহ
হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ রক্ত, রক্তের উপাদান এবং বডি ফ্লুইডস (বীর্য, অশ্রু, মুখের লালা ইত্যাদি) এর মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হয়ে থাকে। নিম্নলিখিত বিষয় সমূহ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।

ক) রক্ত পরিসঞ্চালনের পূর্বে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের জন্য নিশ্চিত নিরীক্ষা অবশ্যকরণীয়। খ) একবার ব্যবহার্য সিরিঞ্জ ও সূচের ব্যবহার নিশ্চিত করণ। গ) নিজস্ব দাঁতের ব্রাশ, রেজার, কাঁচি ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। ঘ) চুল কাটার পরে এবং শেভ করার সময় একবার ব্যবহার্য ব্লেড ব্যবহার। ঙ) নিরাপদ যৌন চার্চা। চ) হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনোক্রমেই রক্ত বা অঙ্গ দানকারী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা যাবে না। জ) নাক-কান ছিদ্র করা এবং টেট্টু করার সময় একই সূচ ব্যবহার না করা। ঘ) সবধরণের সার্জারি এবং দাঁতের চিকিৎসায় জীবাণু মুক্ত যন্ত্র ব্যবহার নিশ্চিত করা।

নির্দিষ্ট নিয়মে টিকা গ্রহণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস-বি প্রতিরোধ করা হয়। টিকা গ্রহণের আগে অবশ্যই হেপাটাইটিস-বি স্ক্রিনিং করে নেওয়া উচিৎ। হেপাটাইটিস সি এর প্রতিরোধক কোনো টিকা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। তাই ব্যক্তিগত প্রতিরোধই এই রোগের একমাত্র প্রতিরোধক ব্যবস্থা। সামাজিক মেলামেশায় (হ্যান্ড শেক, কোলাকুলি) ভাইরাল হেপাটাইটিস ছড়ায় না। এমনকি রোগীর ব্যবহার্য দ্রবাদি যেমন : গ্লাস, চামচ, জামা-কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমেও এই রোগ ছড়ায় না। শুধু যে সমস্ত দ্রব্য রোগীর রক্তের সংস্পর্শে আসে (ক্ষুর, ব্লেড, রেজার, টুথব্রাশ, সূচ) সেগুলোর মাধ্যমেই এই রোগ ছড়াতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার সমগ্র দেশব্যাপী ১৮ হাজার ৫০০ এর অধিক কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে, যা বাংলাদেশ এর স্বাস্থ্যখাতে বিশাল অগ্রগতি। প্রত্যেকটা কমিউনিটি ক্লিনিককে গ্রামীণ বাংলাদেশের ‘ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কমিউনিটি ক্লিনিককে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কার্যক্রম পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এতে হেপাটাইটিস প্রতিরোধের জন্য বার্তা, গ্রামীণ অজানা আক্রান্তদের কাছে পৌঁছাতে, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা’ সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছাতে সহজ হবে। সরকারের সাথে অন্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে। হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন সহজলভ্য করা, চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ মনুষের সহজলভ্য ও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা জরুরি। লাখ লাখ রোগাক্রান্তদের সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাই হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায়।

হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত মা থেকে নবজাতকের সংক্রমণই হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস সংক্রমণের প্রধান কারণ। হেপাটাইটিস-বি এর ক্ষেত্রে প্রায় ৪০% থেকে ৯০% এবং হেপাটাইটিস-সি এর ক্ষেত্রে প্রায় ৫%। জন্মের সময় সংক্রমিত হেপাটাইটিস-বি এর ক্ষেত্রে শিশু বয়সের প্রায় ৯৫% এর ক্রনিক হেপাটাইটিস হয়। যার জন্য নবজাতক ও শিশুদের প্রতিরোধক ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনোগ্লোবিউলিন (প্রয়োজনে) জরুরি। প্রত্যেক গর্ভবতী মায়েদের হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ টেস্ট করা উচিৎ এবং চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতক কে হেপাটাইটিস-বি ভ্যাক্সিন এবং মা হেপাটাইটিস-বি ই-এন্টিজেন / এইচবিভি ডিএনএ পজিটিভ হলে নবজাতক কে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হেপাটাইটিস-বি ভ্যাক্সিন ও হেপাটাইটিস-বি ইমিউনোগ্লোবিউলিন দিতে হবে। পরে আরও দুই ডোজ ভ্যাক্সিন ১-২ মাসে এবং ৬ মাসে দিতে হবে।

আমাদের দেশের প্রায় ৪৮% ডেলিভারি গ্রামের বাড়িতে ধাত্রী / দাই এর মাধ্যমে হয়। গ্রামের গর্ভাবস্থায় নারীদের এই ব্যপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। ধাত্রীদেরও ডেলিভারি এর সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং নবজাতক জন্মের সাথে সাথে ভ্যাক্সিন দেওয়া জরুরি।

বেশির ভাগ দাই বা মিডওয়াইফদের হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন এর ধারণাই নাই, তাদেরও হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাক্সিন এর ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া ভ্যাক্সিন ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন সহজল্যভ্য করা, ইপিআই সিডিউলে বার্থডোজ সংযুক্ত করা, যা বর্তমানে জন্মের ৬ সপ্তাহে ডিপিটি এর সাথে ৬, ১০, ১৪ সপ্তাহে দেওয়া হচ্ছে।

হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত মা থেকে নবজাতকের অথবা অন্যকোনো ভাবে, জন্মের সাথে সাথে, জন্মস্থানে অথবা পরবর্তিতে  শিশু অবস্থায় হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত হলে ৮০% থেকে ৯০% এর দীর্ঘমেয়াদী হেপাটাইটিস হয় এবং অল্প বয়সেই অনেকে মৃত্যুবরণ করে। হেপাটাইটিস বি যত কম বয়সে সংক্রমিত হয় তত জটিলতা এবং মৃত্যুর হার ও বেশি হয়, ৬ বছর এর কম সময়ে সংক্রমিত হলে ঝুকি অনেক বেশি। প্রত্যেক শিশুকে (১৩ বছর এর মধ্যে) হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন দেওয়া জরুরি। হেপাটাইটিস বি বার্থডোজ ও শিশু অবস্থায় হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন সর্বচ্চো প্রয়োগ করা, যাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর লক্ষমাত্রা অনুযায়ী ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ ২০৩০ সালের মধ্যে ০.১% এর কমে, কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।

আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, সরকার, সমগ্র বাংলাদেশে অত্যন্ত সফলতার সাথে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) পরিচালনা করে আসছে এবং এর সফলতার স্বীকৃতি স্বরুপ গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনেশন এন্ড ইমিউনাইজেশন প্রধানমন্ত্রীকে ২০১৯ সালে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করেছে।

আমরা অত্যন্ত গর্বিত। আমরা আশা করছি সম্প্রসারিত টিকাদানের এই সফলতা বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি এর বার্থডোজ, শিশুদের ভ্যাকসিনেশন, সর্বসাধারণের ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

চিকিৎসা
বাংলাদেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ চিকিৎসার সবধরনের মুখে খাওয়া এবং ইনজেকশন বিদ্যমান। হেপাটাইটিস-সি এর আরোগ্য লাভকারী ওষুধ ও পাওয়া যাচ্ছে।

হেপাটাইটিস-বি এর চিকিৎসায় দীর্ঘদিন, মাসের পর মাস চালিয়ে যেতে হয়, কোনো কোনো সময় বছরের পর বছর। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো কারণে অথবা অর্থের অভাবে হঠাৎ রোগী ওষুধ বন্ধ করে দেয়। এতে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস ফ্লেয়ার বা বিস্তার লাভ করে রোগীর অবস্থা জটিলের দিকে চলে যায়। হেপাটাইটিস-সি এর মুখে খাওয়ার ওষুধও প্রায় ৯৫% কার্যকরী। ওষুধটি দামী তাই অনেকেই তা গ্রহণ করতে পারে না। আশার কথা সরকারিভাবে কোনো কোনো সেন্টারে হেপাটাইটিস সি এর ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে – এই কার্যক্রম কে সাধুবাদ জানাই। আশাকরি এই কার্যক্রম দেশের বিভিন্ন সেন্টারে মানুষের দোরগোড়ায় সম্প্রসারিত করা হবে। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ এর ওষুধ সহজলভ্য করা যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা যায়। বাংলাদেশ সরকার কে ভাইরাল হেপাটাইটিস ওষুধের জন্য ভর্তুকি প্রদান করে আক্রান্তদের সাহায্য করা জরুরি।

বাংলাদেশে হেপাটাইটিস নির্মূল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৬৯তম ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলী (২৮ মে ২০১৬) সর্ব সম্মতিক্রমে ১৯৪ টি সদস্য রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৫ টি মূল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, ১। ভ্যাক্সিনেশন, ২। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মা থেকে সন্তানের সংক্রমণ প্রতিরোধ, ৩। নিরাপদ ইন্জেকশন , রক্ত সঞ্চালন ও সার্জিকাল সেফটি, ৪। ক্ষতির মাত্রা কমানো এবং ৫। আক্রান্তদের চিকিৎসা।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ৯০% প্রতিরোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসা পাবে। ৯০% নবজাতক বার্থডোজ পাবে এবং নতুন সংক্রমনের হার ৯০% কমে যাবে। প্রতি বছর মৃত্যুর হার ১.৪ মিলিয়ন থেকে; ০.৫ মিলিয়নের কম হবে। সার্বিকভাবে  ২০৩০ সালের মধ্যে ৭ মিলিয়নের অধিক জীবন রক্ষা পাবে। ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলে আর্থিক বিনিয়োগ জরুরি যা আমাদের এসডিজি ৩ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সহায়ক হবে।

সরকারও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকার এর “ন্যাশনাল অপারেশনাল প্ল্যান ফর ইলিমিনেশন অব ভাইরাল হেপাটাইটিস ইন বাংলাদেশ” একটি সময়োপযোগী উদ্দ্যোগ। ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এই অতিপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ কে স্বাগত জানাচ্ছে এবং এর সাথে সম্পৃক্ত আছে। আশাকরি সাধারণ মানুষের দোর গোড়ায় হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ এর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। উক্ত ন্যাশনাল প্ল্যান বাস্তবায়নে বাংলাদেশে
২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশে ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধ এবং আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানই আমাদের মূল লক্ষ্য। ভাইরাল হেপাটাইটিস মুক্ত প্রজন্মই হবে আগামী দিনের সেরা অর্জন। আসুন আমরা হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করি। ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস মুক্ত বাংলাদেশ গড়ি এটাই হোক বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, মহাসচিব, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ