ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমার-আপনার পরিচয় এবং উপলব্ধি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

কয়েকটি সাংসারিক উদাহরণ
বছর বছর জায়গাজমি ও বাড়িঘরের ট্যাক্স বা খাজনা দিতে হয়। বছরে একবার ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ করাতে হয়; গাড়ির ফিটনেস রিনিউ করাতে হয়, গাড়ির ইন্স্যুরেন্সের কাগজও রিনিউ করাতে হয়। গ্রামবাংলার বিভিন্ন শহরে, উপজেলা ও গ্রামগঞ্জে এখন মোটরচালিত রিকশা এবং ব্যাটারিচালিত তিন চাকার অটো বা টুকটুক দেখা যায়। এসব রিকশা বা অটো সারা দিন চালানোর পর সন্ধ্যায় বা রাত্রি ৯টা-১০টায় ব্যাটারি বা মোটরগুলোকে চার্জে দেয়া হয়। সারা রাত ধরে চার্জ হয়ে থাকে। সকালবেলা ফ্রেশ হয়ে পূর্ণ শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ। ব্যাটারির চার্জ কমে গেলেই ফোনটিকে চার্জে লাগিয়ে দেয়া হয়। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চার্জ কত দূর হলো বা হলো না, সেটা দেখা যায়। অন্য ধরনের উদাহরণ দেই। ঘরের জানালা বা দরজায় পর্দা থাকে, ময়লা হলে ধুয়ে আবার লাগানো হয়। বেশি পুরনো হয়ে গেলে পর্দাটা ফেলে দিয়ে নতুন পর্দা লাগানো হয়। প্রত্যেক দেশের নাগরিক পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছেন। পাসপোর্টের মেয়াদ পাঁচ বছর; ভবিষ্যতে এটা ১০ বছর করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগে; সেটারও নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে।
প্রস্তুতি বা গন্তব্য সম্পর্কিত দৃষ্টান্ত
একেবারে দেশীয় উদাহরণ দিই। আপনি চট্টগ্রামের লোক, ঢাকায় থাকেন, ঢাকা মহানগরে গুরুত্বপূর্ণ অফিসে চাকরি করেন। শুক্র-শনি সাপ্তাহিক ছুটি। আগামী শুক্র-শনিবারে আপনাকে চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে ভীষণ জরুরি কাজে; কিন্তু আগামী রোববার সকালে ঢাকার অফিসেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে; ফেরত আসতেই হবে; অতএব, আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে শুধু চট্টগ্রামগামী টিকিট কিনবেন না; চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী টিকিটও সুনিশ্চিতভাবে আপনার হাতে রাখতে হবে। অর্থাৎ যাত্রাপথের উভয় দিকের টিকিট হাতে থাকতে হবে। বিদেশের কথা বলি। আপনি ঢাকা থেকে প্যারিস যাচ্ছেন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। সময় কম। ঢাকায় বসেই প্যারিসে কোন হোটেলে উঠবেন, কোন হোটেলে থাকবেন, সেটা নিশ্চিত করা ভালো। তাহলে প্যারিসে নামার পর হোটেল খুঁজে সময় নষ্ট হবে না। দেশের ভেতরে ভ্রমণের সময়েও মানুষ যাত্রার আগেই গন্তব্যস্থলের বন্দোবস্ত করে রাখে। ঢাকা থেকে আকাশপথে চট্টগ্রাম গেলে বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম মহানগরের কেন্দ্রস্থলে কিভাবে যাবেন সেই ব্যবস্থা আগেই করতে হয়। ঢাকা থেকে যাওয়ার প্লেন যদি চট্টগ্রামে বিকেল ৪টায় নামে, তাহলে আপনার গাড়িটিও বিকেল ৪টার আগেই ওখানে উপস্থিত থাকতে হবে। ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছার পর যদি আপনার গাড়ি আসার জন্য খবর দেন, তাহলে আপনাকে এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হবে, ওই সময়টা অপচয় হবে।
শুরুতেই শেষের অবস্থা নিশ্চিত করতে হয়
ওপরের দু’টি অনুচ্ছেদে কথাগুলো বললাম বা উদাহরণগুলো দিলাম, কয়েকটি বিষয় উপস্থাপনের নিমিত্তে, ব্যবহারিক জীবনে চার্জ এবং রিচার্জের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে। শক্তি বা ক্ষমতা ক্ষয়িষ্ণু, অর্থাৎ ক্ষয় হতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটাকে শক্তিমান বা রিচার্জ করা যায়। আরো একটি বিষয় তুলে ধরতে, কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, সব কর্মেরই একটা সময় বা মেয়াদ আছে। সব কিছুরই ব্যবহার করার একটা মেয়াদ আছে। পৃথিবীর জীবনটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, এর যেমন শুরু আছে তেমনি শেষও আছে। জীবনের মেয়াদকে যদি বহু ভাগে বিভক্ত করি তাহলে প্রতিটি ভাগেরই শুরু আর শেষ আছে। শুরু করার সময়, কল্পনা বা অনুমান থাকে যে, শেষটি কী রকম হবে? ব্যবসার জগৎ থেকে উদাহরণ দিই। বাংলাদেশের ব্যবসাজগতে এখন প্রতিযোগিতা হচ্ছে অধিক থেকে অধিকতর মুনাফার, ক্রেতাকে ঠকানোর এবং অসততার। যেমন, বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ী যখন রমজানের দুই মাস আগে ছোলা বা খেজুর আমদানি করেন, তিনি এমনভাবে হিসাব করেন যেন রোজার মাসে বিক্রির পর তার হাতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ অবশ্যই থাকে। চাকরিজীবন থেকে উদাহরণ দিচ্ছি। পুলিশের সার্জেন্ট বা অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে ঢুকলেন; আপনার লক্ষ্য থাকে অন্তত থানার ওসি হওয়া এবং যখন থানার ওসি হওয়ার সময় কাছে চলে আসে, তখন লক্ষ্য থাকে পছন্দের থানার ওসি হওয়া অর্থাৎ যে থানায় সুবিধা বেশি, সেই থানার ওসি হওয়া। আপনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে ঢুকলেন; লক্ষ্য থাকে অন্ততপক্ষে যেকোনো জেলার পুলিশ সুপার হওয়া। পুলিশ সুপার হওয়ার সময় কাছে এলে, আপনার লক্ষ্য হয় পছন্দের জেলার পুলিশ সুপার হওয়া। প্রফেশনাল মাইন্ডেড পুলিশ অফিসার হলে তিনি এমন একটি পোস্টিং চান যেখানে তিনি দক্ষতা দেখাতে পারবেন; তাহলে সিনিয়রদের নজরে পড়বেন। সাম্প্রতিককালে অর্থাৎ গত ১৫-২০ বছর ধরে সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও মেজর সাহেবদের অন্যতম লক্ষ্য হয়, জাতিসঙ্ঘের অধীনে মিশনে যাওয়া। চেষ্টা থাকে, যেখানে ঝুঁকি কম এবং ভাতা বেশি এ ধরনের মিশনের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করা। প্রফেশনাল মাইন্ডেড অফিসারেরা লক্ষ্য স্থির করেন কখন স্টাফ কলেজ শেষ করবেন এবং কিভাবে একটি ভালো ইআরই বা স্টাফ অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবেন অথবা অধিনায়কত্ব পাওয়ার সময় কাছে এলে চেষ্টা করা হয় একটা ভালো ব্যাটালিয়নের বা ভালো ইউনিটের অধিনায়ক হতে।
জীবনের চার্জ ও রিচার্জ
ওপরের অনুচ্ছেদগুলোর আলোচনার প্রেক্ষাপটে আজকের কলামে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা করতে চাই, জীবনের কোনো অংশ রিচার্জেবল কি না বা পরিবর্তনযোগ্য কি না অথবা জীবনের শেষ গন্তব্যস্থলে আমার রিসিপশন কী রকম হবে, সেখানকার প্রস্তুতি এখন কতটুকু নিলাম সেসব বিষয়। সম্মানিত পাঠক, আমার জীবনকে বা জীবনের কোনো অংশকে যদি মোবাইল ফোনের ব্যাটারি মনে করি, তাহলে এটা রিচার্জেবল। শরীরের শক্তি আংশিকভাবে রিচার্জেবল, আংশিকভাবে রিচার্জেবল নয়। অর্থাৎ দিনের শেষে ক্লান্ত হওয়ার পর খাওয়া-দাওয়া করলে শক্তি রিচার্জ হয়; কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়সে, শক্তি যতই রিচার্জ হোক, ২৫-৩০ বছরের তরুণের মতো হবে না। কিন্তু মনের শক্তির ব্যাপারে একটু ভিন্নতা আছে। মনের শক্তি যেকোনো সময়ই ক্ষয়িষ্ণু, আবার যেকোনো সময় ইচ্ছা করলে প্রক্রিয়া করে রিচার্জ করা যায়। আমার জীবনের কোনো কর্ম বা অভ্যাসকে যদি ঘরের পর্দা মনে করি, তাহলে এটা পরিবর্তনযোগ্য। আমার চলমান জীবনের শুরু ছিল, এখন চলছে; কিন্তু একদিন-না-একদিন তা শেষ হবেই। কবরকে যদি আমার পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে মনে করি, তাহলে আমাকে প্রস্তুতি নিতে হবে, ওই গন্তব্যস্থলে পৌঁছার জন্য এবং সেখানে আমার কেমন রিসিপশন হবে সেটা সম্পর্কে চিন্তার জন্য। যারা রিসিপশনের দায়িত্বে থাকবেন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে (প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়) পরোক্ষভাবে তথা ইবাদতে ও অনুভূতিতে। অতএব, এই পর্যায়ে আমরা আলোচনা করতে চাই, উপলব্ধি করতে চাই- আমি কে তথা আমার পরিচয় কী? আমার কী কাজ, আমার কাজ কতটুকু করতে পারলাম বা কতটুকু করতে পারলাম না। কোন প্রকারের কতটুকু লাভের উদ্দেশ্যে কী কী কাজ করলাম এবং বাস্তবে সেই লাভ বা লভ্যাংশ কতটুকু পেলাম? এই আলোচনা অনেকের কাছে অপছন্দনীয় হতে পারে। আলোচনা পড়ার পর, কেউ বলতে পারেন এটা ভীতু মানুষ বা পলায়নপর মনোবৃত্তির মানুষের লেখা। অপরপক্ষে কেউ বলতেই পারেন, এটা সাহসী আত্মসমালোচনা, এটা সময়োপযোগী আত্মোপলব্ধি।
আমার প্রথম পরিচয় ‘মানুষ’
আমি আমার পরিচয়কে পাঁচটি আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে পারি। আমার পরিচয়ের প্রথম আঙ্গিক হলো একজন মানুষ। মহান সৃৃষ্টিকর্তা নিজের ইচ্ছায়, নিজের পরিকল্পনায় মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিকর্তা একজন কারিগর; সৃষ্টিকর্তা নিজের সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিধিবিধান, উপদেশ-পরামর্শ ইত্যাদি প্রদান করেছেন। অতএব, আমি মানুষ হিসেবে আমার সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত এই বিধিবিধান ও পরামর্শগুলো মান্য করে চলাই উত্তম। তবে আমি যদি আমার সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করি, সেটা আলাদা কথা। অতএব, আমার এই কলামের কোনো কথাই ওইসব ব্যক্তির জন্য নয়, যারা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করেন। আমরা পৃথিবীর মানুষ। সৃষ্টিকর্তাই আমাদের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে পাঠিয়েছেন; গায়ের রঙ কালো সাদা বাদামি- এরূপ ভিন্ন ভিন্ন করেছেন; চেহারা চ্যাপ্টা গোলগাল খাড়া খাড়া এরূপ ভিন্ন ভিন্ন করে বানিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তাই মানুষে মানুষে যোগাযোগের জন্য বুদ্ধি দিয়েছেন, দক্ষতা দিয়েছেন, যেগুলোর নাম ভাষা। সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক মানুষকে আলাদাভাবে বোধশক্তি দিয়েছেন। শত শত কোটি মানুষ স্বাভাবিক আকৃতি ও গঠনের হলেও হাজার হাজার মানুষ আছে যারা প্রতিবন্ধী বা বিকলাঙ্গ। আমি যেহেতু স্বাভাবিক সেহেতু মনে করি, আমাকে যা যা দিয়েছেন তার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত; আমার অন্য মানুষের প্রতি সহমর্মী হওয়া প্রয়োজন; বিশেষ করে যারা অস্বাভাবিক, অসম্পূর্ণ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন। সৃষ্টিকর্তা আমাকে শিখিয়েছেন, অল্প চিন্তা করতে সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে; বেশি চিন্তা করতে সৃষ্টিকে নিয়ে।
এই চিন্তা করতে করতে আমার বোধশক্তি এসেছে, আমি একগুচ্ছ বিশ্বাসকে ধারণ করেছি। আমি মুসলমান।
আমার দ্বিতীয় পরিচয় ‘মুসলমান’
আমি কিন্তু ঠিক জানি না, কোন দিন মুসলমান হয়েছি। আমরা জাগতিক আলোচনা করছি, আধ্যাত্মিক নয়। মুসলমানিত্ব যদি প্রকৃতি হয় তথা স্বাভাবিকতা হয়, তাহলে আমি জন্মের মুহূর্ত থেকে মুসলমান; কিন্তু তা জানতাম না। কারণ, আমি একান্তই শিশু ছিলাম। যখন একটু বড় হলাম তখন বড়দের থেকে দেখে দেখে কিছু অভ্যাস রপ্ত করলাম এবং বড়রাও আমাকে কিছু জিনিস শেখাতে থাকলেন। বুঝতে শিখলাম, আমি মুসলমান। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মুসলমান হিসেবে আমার দায়িত্ব, আমার কর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন হতে থাকলাম। আরো যখন বয়স বাড়ল তখন আমি সচেতনভাবেই সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম এই কারণে যে, তিনি আমাকে মুসলমান পরিবারে পাঠিয়েছেন এবং এমন পরিবেশে রেখেছেন যেন মুসলমানিত্ব আমি ধরে রাখতে পারি। আমি যেমন মুসলমান, তেমনি মুসলমান নয় এমন প্রচুর মানুষ আছেন আমাদের প্রতিবেশী; যেমনÑ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, তারাও মানুষ। আমাদের পরস্পরকে একই বন্ধনে আবদ্ধ করে আমাদের মনুষ্যত্ববোধ এবং সর্বাবস্থায় মনুষ্যত্ববোধকেই অন্য সব বোধ বা উপলব্ধির ওপরে স্থান দিতে হবে।
আমার তৃতীয় পরিচয় ‘আমি বাঙালি’
শৈশবে যখন মুখে ভাষা আসছিল, তখন আমি অনুকরণ করেছিলাম। সব শিশুই পিতামাতা, ভাইবোনদের মুখের ভাষাকে অনুকরণ করে। আমি অনুকরণ করেছিলাম বাংলা। কারণ আমার মায়ের ভাষা, পিতার ভাষা বাংলা। অতএব, আমি বাংলায় কথা বলে বাঙালি। আরো পরে আবিষ্কার করেছি, পৃথিবীর যে ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছি সে ভূখণ্ডের নাম বঙ্গ; অর্থাৎ এই ভূখণ্ডের সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে। আমরা সমষ্টিগতভাবেও বাঙালি। আমরা যেমন বাঙালি তেমনি অন্য ভাষায় কথা বলে- এ রকম মানুষও যথেষ্ট আছে আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের সমাজে একই ভূখণ্ডে।
আমার চতুর্থ পরিচয় ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা’
ব্যক্তিগতভাবে ১৯৪৯ সালের অক্টোবরের ৪ তারিখ, আমি যে রাজনৈতিক ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলাম সেটার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এটা ছিল পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের অংশ। ওই রাষ্ট্রের আরেকটি প্রদেশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। আয়তনে বড় ছিল পশ্চিম পাকিস্তান; তবে জনসংখ্যায় বড় ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষাদীক্ষা, চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাঙালিদের তুলনায় পশ্চিম অংশের মানুষ অনেক বেশি অগ্রসর ছিল। পাকিস্তান আমলে ওই পশ্চিমারা, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অবহেলা করত; তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত; বৈষম্য ও বঞ্চিত করত। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এবং ওই পশ্চিমারা সবাই মুসলমান ছিলাম এবং মুসলমান হিসেবে সাম্যভিত্তিক অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি কাম্য ছিল, তথাপি মুসলমানিত্ব দাবিকে চরমভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। ফলে বাঙালি মুসলমানদের বা মুসলমান বাঙালিদের মন, পশ্চিমাদের (তথা পশ্চিম পাকিস্তানিদের) প্রতি বিষিয়ে ওঠে। ফলে রাজনৈতিক আন্দোলন হলো। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এই সমস্যার সমাধান হতে হতেও একদম শেষ মুহূর্তে নস্যাৎ হয়ে যায়। এ জন্যও পশ্চিমারা দায়ী। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির হাতে একমাত্র বিকল্প ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা। ওই চেষ্টার নাম, ওই প্রক্রিয়ার নাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। কেউ জীবন বাজি রেখে, আবার কেউ এতটুকু ঝুঁকি না নিয়ে, এই যুদ্ধে শরিক হলেন। উদাহরণস্বরূপ, আমি নিজে জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে গিয়েছিলাম; আমার মতো এ রকম আরো হাজার হাজার ছিল। যুদ্ধে যায়নি এমন লোকের সংখ্যাও কোটি কোটি। যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এমন লোকের সংখ্যাও হাজার হাজার। যা হোক, আমার কথায় ফিরে যাই।
বাঙালির ইচ্ছা ও ভারতের ইচ্ছা
ঘটনাক্রমে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত তখন পাকিস্তানের প্রতি এতটাই বৈরী ছিল যে, তারা চাচ্ছিল পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরো হোক। ভারতের ইচ্ছা ছিল, প্রয়োজনে তারা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সাহায্য করবে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার প্রক্রিয়ায়। ১৯৭১ সালের প্রথম তিন মাসের কথা বলছি। ঘটনা পরিক্রমার ওই পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে অবহেলা করবেন, অস্বীকার করবেন। ইয়াহিয়া এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো উভয়ে মিলে ভারতের হাতে যেন প্লেটে সাজিয়ে একটি ঘটনা উপহার দিলেন; একটি অজুহাত ও একটি পরিস্থিতি উপহার দিলেন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি গন্তব্যস্থল উপহার দিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে, স্ট্র্যাটেজিক কো-ইনসিডেন্স বা কৌশলগত ঘটনার মিলগুলোর মধ্যে অন্যতম উদাহরণ হলো- বাঙালির স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছা এবং ভারতের পাকিস্তান ভাঙার ইচ্ছা, এই দু’টি ভিন্ন সরলরেখার শেষ প্রান্তে এক বিন্দুতে এসে মিলিত হওয়া। এর সময়কাল ছিল ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল। আমার কথায় ফিরে আসি। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে আমার চতুর্থ পরিচয়, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করেছি, যার নাম বাংলাদেশ। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। তাহলে আমার পঞ্চম পরিচয় বাংলাদেশকে নিয়ে।
আমার পঞ্চম পরিচয় ‘আমি বাংলাদেশী’
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে, তিরিশ লাখ তথা লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে, লাখ লাখ পুরুষ ও নারীর সম্ভ্রম ও ইজ্জতের বিনিময়ে, কোটি কোটি পুরুষ ও মহিলার কষ্টের বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশ অর্জন করেছি। আমরা মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান যেটাই বলি না কেন, আমরা বাংলাদেশী। আমি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি বা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি বা ঢাকা মহানগরের মোহাম্মদপুরের উর্দুতে কথা বলি কিংবা নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শহরের উর্দুতে কথা বলি অথবা পুরান ঢাকার ভাষায় কথা বলি, বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মুরংদের ভাষায় কথা বলি, আমরা সবাই বাংলাদেশী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সীমানার ভেতরে বসবাসকারী সবার পরিচয় বাংলাদেশী। যে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, সে বাংলাদেশকে নিয়ে পরিচিত হয়ে আমি গর্বিত।
রমজান মাসের অন্যতম পরিচয়
এখন পবিত্র রমজান মাস চলছে। এ মাস হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক হালনাগাদ করার মাস। রমজান মাস দুর্বলচিত্তের ব্যাটারিকে রিচার্জ করার মাস। রমজান মাস হচ্ছে দুর্বল হয়ে যাওয়া বিশ্বাসকে শক্তিশালী করার মাস। রমজান মাস হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া ভালো অভ্যাসগুলোকে আবার প্রতিষ্ঠিত করার মাস। রমজান মাস হচ্ছে একটি সুযোগ, যেখানে দাঁড়িয়ে দুরবিন যন্ত্র (টেলিস্কোপ) চোখে লাগিয়ে, দূর গন্তব্যস্থল দেখার জন্য, তথা পায়ের নিচে যে মাটি সেই মাটিতে যখন এই দেহ চলে যাবে তখনকার অবস্থা মূল্যায়নের জন্য। এই পবিত্র রমজান মাসই উত্তম সময়, অনুসন্ধান করার জন্য, তল্লাশি ও খোঁজখবর নেয়ার জন্য। কিসের অনুসন্ধান, কার খোঁজখবর? অন্যতম আমার নিজের। পরিধি একটু যদি বাড়াই তাহলে আমাদের সবার সমষ্টিগত।
অনেক প্রশ্ন, আমার ও আপনার জন্য
প্রথমেই প্রশ্ন করি, মানুষ হিসেবে আমরা কি দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করছি? আমরা কি মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছি, নাকি মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত? আমরা কি দরিদ্রকে সাহায্য করছি, নাকি দরিদ্রকে আরো শোষণ করছি? এরপর প্রশ্ন করি, একজন মুসলমান হিসেবে কি যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করছি? আমি কি সৎ কাজে উৎসাহ এবং অসৎ কাজে বাধা দেই? আমি কি শান্তির সপক্ষে প্রচারণা চালাই, নাকি অশান্তির প্রচার করি? আমি কি পবিত্র কুরআন শরিফ পড়েছি? আমি কি আমার পরিবারকে ইসলাম সম্পর্কে সচেতন করেছি? একজন বাঙালি হিসেবে কি পুরোপুরি দায়িত্ব পালন করছি? আমার ভাষাকে কি অন্য ভাষার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারছি? তারপর প্রশ্ন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার দায়িত্ব কি শেষ? মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যুদ্ধ করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনেছি; কিন্তু জনগণের জন্য কি মুক্তি এসেছে? যুদ্ধ করতে গিয়ে যে ত্যাগ স্বীকার করলাম, এর কি মূল্যায়ন হয়েছে? পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে ভিন্ন সাম্যবাদী বা কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বাংলাদেশ কি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? না কি, আমরা আরেকটি করপোরেট হাউজ বানালাম, যার নাম ‘বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড’? এবারে প্রশ্ন করি, একজন বাংলাদেশী হিসেবে কি আমার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করছি? তিস্তার পানি আনার জন্য কি আমি যথেষ্ট সংগ্রাম করছি? সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কি যথেষ্ট প্রতিবাদ জানাচ্ছি? আমার দেশের স্বার্থ রক্ষায় আমি কি সোচ্চার, নাকি নীরব প্রতিবাদী? সম্মানিত পাঠক, এই কলামে যেখানে যেখানে ‘আমি’ শব্দ পাচ্ছেন, সেখানে যদি কষ্ট করে, আপনি আপনার নাম বসিয়ে দেন অথবা আপনাকে কল্পনা করেন, তাহলেই এই কলামের লেখক আমি (মেজর জেনারেল ইবরাহিম বীর প্রতীক) এবং আপনি একই ফ্রিকোয়েন্সিতে বা একই তরঙ্গে কথা বলতে পারব, চিন্তা করতে পারব দেশকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে, ধর্মকে নিয়ে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

আমার-আপনার পরিচয় এবং উপলব্ধি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

আপডেট টাইম : ০৬:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জুন ২০১৬
কয়েকটি সাংসারিক উদাহরণ
বছর বছর জায়গাজমি ও বাড়িঘরের ট্যাক্স বা খাজনা দিতে হয়। বছরে একবার ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ করাতে হয়; গাড়ির ফিটনেস রিনিউ করাতে হয়, গাড়ির ইন্স্যুরেন্সের কাগজও রিনিউ করাতে হয়। গ্রামবাংলার বিভিন্ন শহরে, উপজেলা ও গ্রামগঞ্জে এখন মোটরচালিত রিকশা এবং ব্যাটারিচালিত তিন চাকার অটো বা টুকটুক দেখা যায়। এসব রিকশা বা অটো সারা দিন চালানোর পর সন্ধ্যায় বা রাত্রি ৯টা-১০টায় ব্যাটারি বা মোটরগুলোকে চার্জে দেয়া হয়। সারা রাত ধরে চার্জ হয়ে থাকে। সকালবেলা ফ্রেশ হয়ে পূর্ণ শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ। ব্যাটারির চার্জ কমে গেলেই ফোনটিকে চার্জে লাগিয়ে দেয়া হয়। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চার্জ কত দূর হলো বা হলো না, সেটা দেখা যায়। অন্য ধরনের উদাহরণ দেই। ঘরের জানালা বা দরজায় পর্দা থাকে, ময়লা হলে ধুয়ে আবার লাগানো হয়। বেশি পুরনো হয়ে গেলে পর্দাটা ফেলে দিয়ে নতুন পর্দা লাগানো হয়। প্রত্যেক দেশের নাগরিক পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছেন। পাসপোর্টের মেয়াদ পাঁচ বছর; ভবিষ্যতে এটা ১০ বছর করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগে; সেটারও নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে।
প্রস্তুতি বা গন্তব্য সম্পর্কিত দৃষ্টান্ত
একেবারে দেশীয় উদাহরণ দিই। আপনি চট্টগ্রামের লোক, ঢাকায় থাকেন, ঢাকা মহানগরে গুরুত্বপূর্ণ অফিসে চাকরি করেন। শুক্র-শনি সাপ্তাহিক ছুটি। আগামী শুক্র-শনিবারে আপনাকে চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে ভীষণ জরুরি কাজে; কিন্তু আগামী রোববার সকালে ঢাকার অফিসেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে; ফেরত আসতেই হবে; অতএব, আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে শুধু চট্টগ্রামগামী টিকিট কিনবেন না; চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী টিকিটও সুনিশ্চিতভাবে আপনার হাতে রাখতে হবে। অর্থাৎ যাত্রাপথের উভয় দিকের টিকিট হাতে থাকতে হবে। বিদেশের কথা বলি। আপনি ঢাকা থেকে প্যারিস যাচ্ছেন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। সময় কম। ঢাকায় বসেই প্যারিসে কোন হোটেলে উঠবেন, কোন হোটেলে থাকবেন, সেটা নিশ্চিত করা ভালো। তাহলে প্যারিসে নামার পর হোটেল খুঁজে সময় নষ্ট হবে না। দেশের ভেতরে ভ্রমণের সময়েও মানুষ যাত্রার আগেই গন্তব্যস্থলের বন্দোবস্ত করে রাখে। ঢাকা থেকে আকাশপথে চট্টগ্রাম গেলে বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম মহানগরের কেন্দ্রস্থলে কিভাবে যাবেন সেই ব্যবস্থা আগেই করতে হয়। ঢাকা থেকে যাওয়ার প্লেন যদি চট্টগ্রামে বিকেল ৪টায় নামে, তাহলে আপনার গাড়িটিও বিকেল ৪টার আগেই ওখানে উপস্থিত থাকতে হবে। ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছার পর যদি আপনার গাড়ি আসার জন্য খবর দেন, তাহলে আপনাকে এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হবে, ওই সময়টা অপচয় হবে।
শুরুতেই শেষের অবস্থা নিশ্চিত করতে হয়
ওপরের দু’টি অনুচ্ছেদে কথাগুলো বললাম বা উদাহরণগুলো দিলাম, কয়েকটি বিষয় উপস্থাপনের নিমিত্তে, ব্যবহারিক জীবনে চার্জ এবং রিচার্জের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে। শক্তি বা ক্ষমতা ক্ষয়িষ্ণু, অর্থাৎ ক্ষয় হতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটাকে শক্তিমান বা রিচার্জ করা যায়। আরো একটি বিষয় তুলে ধরতে, কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, সব কর্মেরই একটা সময় বা মেয়াদ আছে। সব কিছুরই ব্যবহার করার একটা মেয়াদ আছে। পৃথিবীর জীবনটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, এর যেমন শুরু আছে তেমনি শেষও আছে। জীবনের মেয়াদকে যদি বহু ভাগে বিভক্ত করি তাহলে প্রতিটি ভাগেরই শুরু আর শেষ আছে। শুরু করার সময়, কল্পনা বা অনুমান থাকে যে, শেষটি কী রকম হবে? ব্যবসার জগৎ থেকে উদাহরণ দিই। বাংলাদেশের ব্যবসাজগতে এখন প্রতিযোগিতা হচ্ছে অধিক থেকে অধিকতর মুনাফার, ক্রেতাকে ঠকানোর এবং অসততার। যেমন, বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ী যখন রমজানের দুই মাস আগে ছোলা বা খেজুর আমদানি করেন, তিনি এমনভাবে হিসাব করেন যেন রোজার মাসে বিক্রির পর তার হাতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ অবশ্যই থাকে। চাকরিজীবন থেকে উদাহরণ দিচ্ছি। পুলিশের সার্জেন্ট বা অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে ঢুকলেন; আপনার লক্ষ্য থাকে অন্তত থানার ওসি হওয়া এবং যখন থানার ওসি হওয়ার সময় কাছে চলে আসে, তখন লক্ষ্য থাকে পছন্দের থানার ওসি হওয়া অর্থাৎ যে থানায় সুবিধা বেশি, সেই থানার ওসি হওয়া। আপনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে ঢুকলেন; লক্ষ্য থাকে অন্ততপক্ষে যেকোনো জেলার পুলিশ সুপার হওয়া। পুলিশ সুপার হওয়ার সময় কাছে এলে, আপনার লক্ষ্য হয় পছন্দের জেলার পুলিশ সুপার হওয়া। প্রফেশনাল মাইন্ডেড পুলিশ অফিসার হলে তিনি এমন একটি পোস্টিং চান যেখানে তিনি দক্ষতা দেখাতে পারবেন; তাহলে সিনিয়রদের নজরে পড়বেন। সাম্প্রতিককালে অর্থাৎ গত ১৫-২০ বছর ধরে সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও মেজর সাহেবদের অন্যতম লক্ষ্য হয়, জাতিসঙ্ঘের অধীনে মিশনে যাওয়া। চেষ্টা থাকে, যেখানে ঝুঁকি কম এবং ভাতা বেশি এ ধরনের মিশনের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করা। প্রফেশনাল মাইন্ডেড অফিসারেরা লক্ষ্য স্থির করেন কখন স্টাফ কলেজ শেষ করবেন এবং কিভাবে একটি ভালো ইআরই বা স্টাফ অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবেন অথবা অধিনায়কত্ব পাওয়ার সময় কাছে এলে চেষ্টা করা হয় একটা ভালো ব্যাটালিয়নের বা ভালো ইউনিটের অধিনায়ক হতে।
জীবনের চার্জ ও রিচার্জ
ওপরের অনুচ্ছেদগুলোর আলোচনার প্রেক্ষাপটে আজকের কলামে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা করতে চাই, জীবনের কোনো অংশ রিচার্জেবল কি না বা পরিবর্তনযোগ্য কি না অথবা জীবনের শেষ গন্তব্যস্থলে আমার রিসিপশন কী রকম হবে, সেখানকার প্রস্তুতি এখন কতটুকু নিলাম সেসব বিষয়। সম্মানিত পাঠক, আমার জীবনকে বা জীবনের কোনো অংশকে যদি মোবাইল ফোনের ব্যাটারি মনে করি, তাহলে এটা রিচার্জেবল। শরীরের শক্তি আংশিকভাবে রিচার্জেবল, আংশিকভাবে রিচার্জেবল নয়। অর্থাৎ দিনের শেষে ক্লান্ত হওয়ার পর খাওয়া-দাওয়া করলে শক্তি রিচার্জ হয়; কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়সে, শক্তি যতই রিচার্জ হোক, ২৫-৩০ বছরের তরুণের মতো হবে না। কিন্তু মনের শক্তির ব্যাপারে একটু ভিন্নতা আছে। মনের শক্তি যেকোনো সময়ই ক্ষয়িষ্ণু, আবার যেকোনো সময় ইচ্ছা করলে প্রক্রিয়া করে রিচার্জ করা যায়। আমার জীবনের কোনো কর্ম বা অভ্যাসকে যদি ঘরের পর্দা মনে করি, তাহলে এটা পরিবর্তনযোগ্য। আমার চলমান জীবনের শুরু ছিল, এখন চলছে; কিন্তু একদিন-না-একদিন তা শেষ হবেই। কবরকে যদি আমার পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে মনে করি, তাহলে আমাকে প্রস্তুতি নিতে হবে, ওই গন্তব্যস্থলে পৌঁছার জন্য এবং সেখানে আমার কেমন রিসিপশন হবে সেটা সম্পর্কে চিন্তার জন্য। যারা রিসিপশনের দায়িত্বে থাকবেন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে (প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়) পরোক্ষভাবে তথা ইবাদতে ও অনুভূতিতে। অতএব, এই পর্যায়ে আমরা আলোচনা করতে চাই, উপলব্ধি করতে চাই- আমি কে তথা আমার পরিচয় কী? আমার কী কাজ, আমার কাজ কতটুকু করতে পারলাম বা কতটুকু করতে পারলাম না। কোন প্রকারের কতটুকু লাভের উদ্দেশ্যে কী কী কাজ করলাম এবং বাস্তবে সেই লাভ বা লভ্যাংশ কতটুকু পেলাম? এই আলোচনা অনেকের কাছে অপছন্দনীয় হতে পারে। আলোচনা পড়ার পর, কেউ বলতে পারেন এটা ভীতু মানুষ বা পলায়নপর মনোবৃত্তির মানুষের লেখা। অপরপক্ষে কেউ বলতেই পারেন, এটা সাহসী আত্মসমালোচনা, এটা সময়োপযোগী আত্মোপলব্ধি।
আমার প্রথম পরিচয় ‘মানুষ’
আমি আমার পরিচয়কে পাঁচটি আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে পারি। আমার পরিচয়ের প্রথম আঙ্গিক হলো একজন মানুষ। মহান সৃৃষ্টিকর্তা নিজের ইচ্ছায়, নিজের পরিকল্পনায় মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিকর্তা একজন কারিগর; সৃষ্টিকর্তা নিজের সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিধিবিধান, উপদেশ-পরামর্শ ইত্যাদি প্রদান করেছেন। অতএব, আমি মানুষ হিসেবে আমার সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত এই বিধিবিধান ও পরামর্শগুলো মান্য করে চলাই উত্তম। তবে আমি যদি আমার সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করি, সেটা আলাদা কথা। অতএব, আমার এই কলামের কোনো কথাই ওইসব ব্যক্তির জন্য নয়, যারা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করেন। আমরা পৃথিবীর মানুষ। সৃষ্টিকর্তাই আমাদের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে পাঠিয়েছেন; গায়ের রঙ কালো সাদা বাদামি- এরূপ ভিন্ন ভিন্ন করেছেন; চেহারা চ্যাপ্টা গোলগাল খাড়া খাড়া এরূপ ভিন্ন ভিন্ন করে বানিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তাই মানুষে মানুষে যোগাযোগের জন্য বুদ্ধি দিয়েছেন, দক্ষতা দিয়েছেন, যেগুলোর নাম ভাষা। সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক মানুষকে আলাদাভাবে বোধশক্তি দিয়েছেন। শত শত কোটি মানুষ স্বাভাবিক আকৃতি ও গঠনের হলেও হাজার হাজার মানুষ আছে যারা প্রতিবন্ধী বা বিকলাঙ্গ। আমি যেহেতু স্বাভাবিক সেহেতু মনে করি, আমাকে যা যা দিয়েছেন তার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত; আমার অন্য মানুষের প্রতি সহমর্মী হওয়া প্রয়োজন; বিশেষ করে যারা অস্বাভাবিক, অসম্পূর্ণ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন। সৃষ্টিকর্তা আমাকে শিখিয়েছেন, অল্প চিন্তা করতে সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে; বেশি চিন্তা করতে সৃষ্টিকে নিয়ে।
এই চিন্তা করতে করতে আমার বোধশক্তি এসেছে, আমি একগুচ্ছ বিশ্বাসকে ধারণ করেছি। আমি মুসলমান।
আমার দ্বিতীয় পরিচয় ‘মুসলমান’
আমি কিন্তু ঠিক জানি না, কোন দিন মুসলমান হয়েছি। আমরা জাগতিক আলোচনা করছি, আধ্যাত্মিক নয়। মুসলমানিত্ব যদি প্রকৃতি হয় তথা স্বাভাবিকতা হয়, তাহলে আমি জন্মের মুহূর্ত থেকে মুসলমান; কিন্তু তা জানতাম না। কারণ, আমি একান্তই শিশু ছিলাম। যখন একটু বড় হলাম তখন বড়দের থেকে দেখে দেখে কিছু অভ্যাস রপ্ত করলাম এবং বড়রাও আমাকে কিছু জিনিস শেখাতে থাকলেন। বুঝতে শিখলাম, আমি মুসলমান। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মুসলমান হিসেবে আমার দায়িত্ব, আমার কর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন হতে থাকলাম। আরো যখন বয়স বাড়ল তখন আমি সচেতনভাবেই সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম এই কারণে যে, তিনি আমাকে মুসলমান পরিবারে পাঠিয়েছেন এবং এমন পরিবেশে রেখেছেন যেন মুসলমানিত্ব আমি ধরে রাখতে পারি। আমি যেমন মুসলমান, তেমনি মুসলমান নয় এমন প্রচুর মানুষ আছেন আমাদের প্রতিবেশী; যেমনÑ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, তারাও মানুষ। আমাদের পরস্পরকে একই বন্ধনে আবদ্ধ করে আমাদের মনুষ্যত্ববোধ এবং সর্বাবস্থায় মনুষ্যত্ববোধকেই অন্য সব বোধ বা উপলব্ধির ওপরে স্থান দিতে হবে।
আমার তৃতীয় পরিচয় ‘আমি বাঙালি’
শৈশবে যখন মুখে ভাষা আসছিল, তখন আমি অনুকরণ করেছিলাম। সব শিশুই পিতামাতা, ভাইবোনদের মুখের ভাষাকে অনুকরণ করে। আমি অনুকরণ করেছিলাম বাংলা। কারণ আমার মায়ের ভাষা, পিতার ভাষা বাংলা। অতএব, আমি বাংলায় কথা বলে বাঙালি। আরো পরে আবিষ্কার করেছি, পৃথিবীর যে ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছি সে ভূখণ্ডের নাম বঙ্গ; অর্থাৎ এই ভূখণ্ডের সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে। আমরা সমষ্টিগতভাবেও বাঙালি। আমরা যেমন বাঙালি তেমনি অন্য ভাষায় কথা বলে- এ রকম মানুষও যথেষ্ট আছে আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের সমাজে একই ভূখণ্ডে।
আমার চতুর্থ পরিচয় ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা’
ব্যক্তিগতভাবে ১৯৪৯ সালের অক্টোবরের ৪ তারিখ, আমি যে রাজনৈতিক ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলাম সেটার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এটা ছিল পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের অংশ। ওই রাষ্ট্রের আরেকটি প্রদেশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। আয়তনে বড় ছিল পশ্চিম পাকিস্তান; তবে জনসংখ্যায় বড় ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষাদীক্ষা, চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাঙালিদের তুলনায় পশ্চিম অংশের মানুষ অনেক বেশি অগ্রসর ছিল। পাকিস্তান আমলে ওই পশ্চিমারা, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অবহেলা করত; তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত; বৈষম্য ও বঞ্চিত করত। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এবং ওই পশ্চিমারা সবাই মুসলমান ছিলাম এবং মুসলমান হিসেবে সাম্যভিত্তিক অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি কাম্য ছিল, তথাপি মুসলমানিত্ব দাবিকে চরমভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। ফলে বাঙালি মুসলমানদের বা মুসলমান বাঙালিদের মন, পশ্চিমাদের (তথা পশ্চিম পাকিস্তানিদের) প্রতি বিষিয়ে ওঠে। ফলে রাজনৈতিক আন্দোলন হলো। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এই সমস্যার সমাধান হতে হতেও একদম শেষ মুহূর্তে নস্যাৎ হয়ে যায়। এ জন্যও পশ্চিমারা দায়ী। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির হাতে একমাত্র বিকল্প ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা। ওই চেষ্টার নাম, ওই প্রক্রিয়ার নাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। কেউ জীবন বাজি রেখে, আবার কেউ এতটুকু ঝুঁকি না নিয়ে, এই যুদ্ধে শরিক হলেন। উদাহরণস্বরূপ, আমি নিজে জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে গিয়েছিলাম; আমার মতো এ রকম আরো হাজার হাজার ছিল। যুদ্ধে যায়নি এমন লোকের সংখ্যাও কোটি কোটি। যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এমন লোকের সংখ্যাও হাজার হাজার। যা হোক, আমার কথায় ফিরে যাই।
বাঙালির ইচ্ছা ও ভারতের ইচ্ছা
ঘটনাক্রমে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত তখন পাকিস্তানের প্রতি এতটাই বৈরী ছিল যে, তারা চাচ্ছিল পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরো হোক। ভারতের ইচ্ছা ছিল, প্রয়োজনে তারা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সাহায্য করবে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার প্রক্রিয়ায়। ১৯৭১ সালের প্রথম তিন মাসের কথা বলছি। ঘটনা পরিক্রমার ওই পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে অবহেলা করবেন, অস্বীকার করবেন। ইয়াহিয়া এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো উভয়ে মিলে ভারতের হাতে যেন প্লেটে সাজিয়ে একটি ঘটনা উপহার দিলেন; একটি অজুহাত ও একটি পরিস্থিতি উপহার দিলেন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি গন্তব্যস্থল উপহার দিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে, স্ট্র্যাটেজিক কো-ইনসিডেন্স বা কৌশলগত ঘটনার মিলগুলোর মধ্যে অন্যতম উদাহরণ হলো- বাঙালির স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছা এবং ভারতের পাকিস্তান ভাঙার ইচ্ছা, এই দু’টি ভিন্ন সরলরেখার শেষ প্রান্তে এক বিন্দুতে এসে মিলিত হওয়া। এর সময়কাল ছিল ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল। আমার কথায় ফিরে আসি। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে আমার চতুর্থ পরিচয়, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করেছি, যার নাম বাংলাদেশ। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। তাহলে আমার পঞ্চম পরিচয় বাংলাদেশকে নিয়ে।
আমার পঞ্চম পরিচয় ‘আমি বাংলাদেশী’
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে, তিরিশ লাখ তথা লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে, লাখ লাখ পুরুষ ও নারীর সম্ভ্রম ও ইজ্জতের বিনিময়ে, কোটি কোটি পুরুষ ও মহিলার কষ্টের বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশ অর্জন করেছি। আমরা মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান যেটাই বলি না কেন, আমরা বাংলাদেশী। আমি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি বা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি বা ঢাকা মহানগরের মোহাম্মদপুরের উর্দুতে কথা বলি কিংবা নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শহরের উর্দুতে কথা বলি অথবা পুরান ঢাকার ভাষায় কথা বলি, বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মুরংদের ভাষায় কথা বলি, আমরা সবাই বাংলাদেশী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সীমানার ভেতরে বসবাসকারী সবার পরিচয় বাংলাদেশী। যে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, সে বাংলাদেশকে নিয়ে পরিচিত হয়ে আমি গর্বিত।
রমজান মাসের অন্যতম পরিচয়
এখন পবিত্র রমজান মাস চলছে। এ মাস হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক হালনাগাদ করার মাস। রমজান মাস দুর্বলচিত্তের ব্যাটারিকে রিচার্জ করার মাস। রমজান মাস হচ্ছে দুর্বল হয়ে যাওয়া বিশ্বাসকে শক্তিশালী করার মাস। রমজান মাস হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া ভালো অভ্যাসগুলোকে আবার প্রতিষ্ঠিত করার মাস। রমজান মাস হচ্ছে একটি সুযোগ, যেখানে দাঁড়িয়ে দুরবিন যন্ত্র (টেলিস্কোপ) চোখে লাগিয়ে, দূর গন্তব্যস্থল দেখার জন্য, তথা পায়ের নিচে যে মাটি সেই মাটিতে যখন এই দেহ চলে যাবে তখনকার অবস্থা মূল্যায়নের জন্য। এই পবিত্র রমজান মাসই উত্তম সময়, অনুসন্ধান করার জন্য, তল্লাশি ও খোঁজখবর নেয়ার জন্য। কিসের অনুসন্ধান, কার খোঁজখবর? অন্যতম আমার নিজের। পরিধি একটু যদি বাড়াই তাহলে আমাদের সবার সমষ্টিগত।
অনেক প্রশ্ন, আমার ও আপনার জন্য
প্রথমেই প্রশ্ন করি, মানুষ হিসেবে আমরা কি দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করছি? আমরা কি মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছি, নাকি মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত? আমরা কি দরিদ্রকে সাহায্য করছি, নাকি দরিদ্রকে আরো শোষণ করছি? এরপর প্রশ্ন করি, একজন মুসলমান হিসেবে কি যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করছি? আমি কি সৎ কাজে উৎসাহ এবং অসৎ কাজে বাধা দেই? আমি কি শান্তির সপক্ষে প্রচারণা চালাই, নাকি অশান্তির প্রচার করি? আমি কি পবিত্র কুরআন শরিফ পড়েছি? আমি কি আমার পরিবারকে ইসলাম সম্পর্কে সচেতন করেছি? একজন বাঙালি হিসেবে কি পুরোপুরি দায়িত্ব পালন করছি? আমার ভাষাকে কি অন্য ভাষার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারছি? তারপর প্রশ্ন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার দায়িত্ব কি শেষ? মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যুদ্ধ করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনেছি; কিন্তু জনগণের জন্য কি মুক্তি এসেছে? যুদ্ধ করতে গিয়ে যে ত্যাগ স্বীকার করলাম, এর কি মূল্যায়ন হয়েছে? পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে ভিন্ন সাম্যবাদী বা কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বাংলাদেশ কি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? না কি, আমরা আরেকটি করপোরেট হাউজ বানালাম, যার নাম ‘বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড’? এবারে প্রশ্ন করি, একজন বাংলাদেশী হিসেবে কি আমার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করছি? তিস্তার পানি আনার জন্য কি আমি যথেষ্ট সংগ্রাম করছি? সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কি যথেষ্ট প্রতিবাদ জানাচ্ছি? আমার দেশের স্বার্থ রক্ষায় আমি কি সোচ্চার, নাকি নীরব প্রতিবাদী? সম্মানিত পাঠক, এই কলামে যেখানে যেখানে ‘আমি’ শব্দ পাচ্ছেন, সেখানে যদি কষ্ট করে, আপনি আপনার নাম বসিয়ে দেন অথবা আপনাকে কল্পনা করেন, তাহলেই এই কলামের লেখক আমি (মেজর জেনারেল ইবরাহিম বীর প্রতীক) এবং আপনি একই ফ্রিকোয়েন্সিতে বা একই তরঙ্গে কথা বলতে পারব, চিন্তা করতে পারব দেশকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে, ধর্মকে নিয়ে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com