ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরকীয়া কি মৃত্যুকে জায়েজ করে

মরেও শান্তি নেই। খুন, আত্মহত্যা যাই হোক না কেন। কোনো নারীর কপালে যদি এঁকে দেওয়া যায় পরকীয়ার তিলক তো কাজ হয়ে গেল। সেই নারীর ইহকাল, পরকাল সব শেষ। আর বেঁচে থাকতেও নারীর পথরোধের সবচেয়ে সহজ উপায় তার গায়ে পরকীয়ার লেবেল সেঁটে দেওয়া। কোনো নারী পেশাজীবনে বেশ উন্নতি করছে? তর তর করে প্রোমোশনের সিঁড়ি ভাঙছে? নিশ্চয়ই বসের সঙ্গে তার পরকীয়া রয়েছে।

কোনো নারীর স্বামী বিদেশে থাকে। আর সে বিরহে কাতর না হয়ে দিব্যি হাসিখুশি হয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। অবধারিতভাবে সে পরকীয়া করে। আর যদি সেই নারীকে খুন করা হয় তার টাকা হস্তগত করার জন্য কিংবা প্রবাসী স্বামীর চোখে তাকে হেয় করার প্রয়োজন হয়, তাহলে অব্যর্থ ওষুধ পরকীয়ার বদনাম।

এটা আজকে নতুন নয়। সেই শঙ্খমালা রূপকথায় শুনেছিলাম, সওদাগরের আদরিনী স্ত্রী শঙ্খমালাকে পরকীয়ার বদনাম দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ননদ। কোনো মেয়ের লেখা খুব ভালো? সে ভালো কবি, ভালো গল্পকার? অবশ্যই তার পরকীয়া আছে প্রতিষ্ঠিত পুরুষ লেখকদের সঙ্গে। নইলে ‘মেয়ে-মানুষে’ এতো ভালো লিখতে পারে? ওর লেখা তো ওই প্রেমিকই লিখে দেয়। নারীর যাবতীয় সাফল্যের পিছনে রয়েছে তথাকথিত পরকীয়া।
নারীর অপমৃত্যুর পিছনেও রয়েছে ওই একই ‘কমবখত’ পরকীয়া।
কোনো বিবাহিত নারী খুন হয়েছে? ধর্ষণের শিকার হয়েছে? সংবাদটির নিচে একলাইন শুধু যোগ করে দেওয়া হোক ‘পরকীয়ার জের ধরে এই খুন’ কিংবা পরকীয়া প্রেমিকের ধর্ষণের শিকার হয়েছে নারী’। ব্যস তার উপর থেকে সব সহানুভূতি উধাও।

স্ত্রী পরকীয়া করতো, স্বামী তাকে খুন করেছে। আপদ চুকেছে। খুব ভালো কাজ করেছে। এমন নারীর বেঁচে থাকার প্রয়োজন কী? যেন কোনো আইনে লেখা আছে যে, পরকীয়া প্রেম করলে সে নারীকে হত্যা করা জায়েজ।
পরকীয়া কি? সংস্কৃত সাহিত্যের স্বকীয়া-পরকীয়া নায়িকার সেই প্রাচীন অর্থ এখন আর কেউ আমলে নেয় না। যদি নিত তাহলে বিল্বমঙ্গল ইউসুফ জুলেখা আর গোটা বৈষ্ণব সাহিত্যই তো খরচের খাতায় চলে যেত। রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা নিয়ে আর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হতো না। এমনকি বাইবেলের ডেভিড ও বাথশেবার কাহিনীও বাতিল হয়ে যেত।

এখন পরকীয়া বলতে বুঝায় বিবাহিত নারী বা পুরুষের বিয়েবহির্ভূত প্রেম। বুঝলাম। কিন্তু এই বিয়ে বহির্ভুত প্রেমের পালায় যদি বিবাহিত পুরুষ প্রেম করে কোনো অবিবাহিত নারীর সঙ্গে, তাহলে সেটা কিছুটা নরম চোখেই যেন দেখা হয়।
বলা  হয়, বউ বুড়িয়ে গেছে কিংবা হারিয়েছে রূপের চটক, সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে, কিংবা ঝগড়া করে খনখনে স্বরে, স্বামী বেচারা বাধ্য হয়েই অন্যত্র গেছে কিংবা পুরুষ মানুষের মন ঘুরতে কতক্ষণ। এমনি অনেক কথার ফাঁকে স্বামীর পরকীয়ার দোষ চাপে বেচারী ‘বুড়িয়ে যাওয়া’ স্ত্রীর কপালে। অথবা দোষ দেওয়া হয় ‘চটকদার’ অপর নারীকে।
এইভাবে নারীর প্রতিপক্ষ হিসেবে অন্য নারীকে দাঁড় করিয়ে ঘরভাঙার সব দোষ তার ঘাড়ে কৌশলে চাপিয়ে আড়ালে চলে যায় পুরুষটি। বলা হয়, মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের ঘর ভাঙলো ওই সর্বনাশী। আর দৃশ্যপট যদি অন্যরকম হয়? যেখানে নারী হয় বিবাহিত এবং প্রেমিকটি অবিবাহিত কিংবা বিবাহিত? সেখানে অবধারিতভাবে সব বিষাক্ত শর নিক্ষিপ্ত হবে সেই নারীর প্রতি।

আর সেই নারী যদি সন্তানের জননী হয় তাহলে তো অবস্থা আরও খারাপ। হোক না তার স্বামী মাতাল, জুয়ারি, বেকার কিংবা অন্য নারীতে আসক্ত। কখনও বলা হবে না, স্বামীর অবহেলা, নির্যাতন, হতাশা কিংবা অসুখী দাম্পত্যর কারণে অন্যজনের প্রেমে পড়েছে সেই অসহায় নারী। বরং তাকে চিত্রিত করা হবে ‘কামুকী’, ‘দুঃশ্চরিত্রা’ ‘স্বৈরিণী’ ইত্যাদি শত শত বিশ্লেষণে। ঘরে-বাইরে কোথাও এতোটুকু সহানুভূতি বা করুণা কিছুই থাকবে না তার প্রতি।

তার জন্য ঘৃণা এতো প্রবল হবে যে, তার মৃত্যুই যেন জনতাকে স্বস্তি দিবে তখন। এমনকি প্রিয়তম সন্তানও তার প্রতি হবে নির্মম। তার জন্য আত্মীয় বন্ধুদেরও শোক নয়, থাকবে শুধু লজ্জা।

এখানেও কিন্তু প্রেমিক পুরুষটি কিছুটা আড়ালেই থাকবে। তখন বলা হবে না ‘পুরুষ হয়ে অপর পুরুষের ঘর ভাঙলো’। বরং যদি সে অবিবাহিত ও প্রেমিকার চেয়ে বয়সে ছোট হয় তাহলে বলা হবে, ‘ছেলেটার মাথা নষ্ট করেছে ওই ডাইনি’।
আর যদি পুরুষটিও হয় বিবাহিত, তাহলে তার স্ত্রীসহ অন্য আত্মীয়স্বজনরা ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রেমিকার উপর। বলা হবে ‘নষ্ট মহিলা রং-ঢং করে সতী সাধ্বীর ঘর ভেঙেছে’।

তার মানে ঘটনা যাই হোক পরকীয়ার দায় সর্বদা নারীর কাঁধেই বেশি। তখন তার মৃত্যুই হবে সকলের কাম্য। সমাজের অলিখিত পুরুষতান্ত্রিক সংবিধানে এই নারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হবে। সমাজের এই মনোভাবকে পুঁজি করেই চলে একশ্রেণির অপমিডিয়া ও অপসাংবাদিক। (এদের আমি সাংবাদিক বলতে নারাজ। কারণ এখনও সাংবাদিকতা পেশায় আছেন প্রচুর সংখ্যক পরিশ্রমী ও সৎ মানুষ)।

তাই কোনো নারীকে হত্যা করা হলেই এই অপসাংবাদিকরা সুযোগ খোঁজে তার কপালে কারণে-অকারণে পরকীয়ার লেবেল এঁটে দেওয়ার। এর ফলে সেই হত্যাকে জায়েজ করে হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণাকে কমিয়ে আনাও গেল সেইসঙ্গে রসালো কিচ্ছা কাহিনী বিক্রি করে ব্যবসা হলো রমরমা। একই ঢিলে হত্যাকারীদের ‘পারপাস সার্ভ’ আর বিক্রিবাট্টা বাড়ানো। এমন মোক্ষম সুযোগ কেউ ছাড়ে নাকি?

আর মৃত নারীটির প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা, তার ছেলেমেয়েদের প্রতি সহানুভূতি? এসব আবার কী? অতশত কথা মাথায় রেখে আজকাল চলা যায় নাকি?

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

পরকীয়া কি মৃত্যুকে জায়েজ করে

আপডেট টাইম : ০৭:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জুন ২০১৬

মরেও শান্তি নেই। খুন, আত্মহত্যা যাই হোক না কেন। কোনো নারীর কপালে যদি এঁকে দেওয়া যায় পরকীয়ার তিলক তো কাজ হয়ে গেল। সেই নারীর ইহকাল, পরকাল সব শেষ। আর বেঁচে থাকতেও নারীর পথরোধের সবচেয়ে সহজ উপায় তার গায়ে পরকীয়ার লেবেল সেঁটে দেওয়া। কোনো নারী পেশাজীবনে বেশ উন্নতি করছে? তর তর করে প্রোমোশনের সিঁড়ি ভাঙছে? নিশ্চয়ই বসের সঙ্গে তার পরকীয়া রয়েছে।

কোনো নারীর স্বামী বিদেশে থাকে। আর সে বিরহে কাতর না হয়ে দিব্যি হাসিখুশি হয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। অবধারিতভাবে সে পরকীয়া করে। আর যদি সেই নারীকে খুন করা হয় তার টাকা হস্তগত করার জন্য কিংবা প্রবাসী স্বামীর চোখে তাকে হেয় করার প্রয়োজন হয়, তাহলে অব্যর্থ ওষুধ পরকীয়ার বদনাম।

এটা আজকে নতুন নয়। সেই শঙ্খমালা রূপকথায় শুনেছিলাম, সওদাগরের আদরিনী স্ত্রী শঙ্খমালাকে পরকীয়ার বদনাম দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ননদ। কোনো মেয়ের লেখা খুব ভালো? সে ভালো কবি, ভালো গল্পকার? অবশ্যই তার পরকীয়া আছে প্রতিষ্ঠিত পুরুষ লেখকদের সঙ্গে। নইলে ‘মেয়ে-মানুষে’ এতো ভালো লিখতে পারে? ওর লেখা তো ওই প্রেমিকই লিখে দেয়। নারীর যাবতীয় সাফল্যের পিছনে রয়েছে তথাকথিত পরকীয়া।
নারীর অপমৃত্যুর পিছনেও রয়েছে ওই একই ‘কমবখত’ পরকীয়া।
কোনো বিবাহিত নারী খুন হয়েছে? ধর্ষণের শিকার হয়েছে? সংবাদটির নিচে একলাইন শুধু যোগ করে দেওয়া হোক ‘পরকীয়ার জের ধরে এই খুন’ কিংবা পরকীয়া প্রেমিকের ধর্ষণের শিকার হয়েছে নারী’। ব্যস তার উপর থেকে সব সহানুভূতি উধাও।

স্ত্রী পরকীয়া করতো, স্বামী তাকে খুন করেছে। আপদ চুকেছে। খুব ভালো কাজ করেছে। এমন নারীর বেঁচে থাকার প্রয়োজন কী? যেন কোনো আইনে লেখা আছে যে, পরকীয়া প্রেম করলে সে নারীকে হত্যা করা জায়েজ।
পরকীয়া কি? সংস্কৃত সাহিত্যের স্বকীয়া-পরকীয়া নায়িকার সেই প্রাচীন অর্থ এখন আর কেউ আমলে নেয় না। যদি নিত তাহলে বিল্বমঙ্গল ইউসুফ জুলেখা আর গোটা বৈষ্ণব সাহিত্যই তো খরচের খাতায় চলে যেত। রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা নিয়ে আর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হতো না। এমনকি বাইবেলের ডেভিড ও বাথশেবার কাহিনীও বাতিল হয়ে যেত।

এখন পরকীয়া বলতে বুঝায় বিবাহিত নারী বা পুরুষের বিয়েবহির্ভূত প্রেম। বুঝলাম। কিন্তু এই বিয়ে বহির্ভুত প্রেমের পালায় যদি বিবাহিত পুরুষ প্রেম করে কোনো অবিবাহিত নারীর সঙ্গে, তাহলে সেটা কিছুটা নরম চোখেই যেন দেখা হয়।
বলা  হয়, বউ বুড়িয়ে গেছে কিংবা হারিয়েছে রূপের চটক, সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে, কিংবা ঝগড়া করে খনখনে স্বরে, স্বামী বেচারা বাধ্য হয়েই অন্যত্র গেছে কিংবা পুরুষ মানুষের মন ঘুরতে কতক্ষণ। এমনি অনেক কথার ফাঁকে স্বামীর পরকীয়ার দোষ চাপে বেচারী ‘বুড়িয়ে যাওয়া’ স্ত্রীর কপালে। অথবা দোষ দেওয়া হয় ‘চটকদার’ অপর নারীকে।
এইভাবে নারীর প্রতিপক্ষ হিসেবে অন্য নারীকে দাঁড় করিয়ে ঘরভাঙার সব দোষ তার ঘাড়ে কৌশলে চাপিয়ে আড়ালে চলে যায় পুরুষটি। বলা হয়, মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের ঘর ভাঙলো ওই সর্বনাশী। আর দৃশ্যপট যদি অন্যরকম হয়? যেখানে নারী হয় বিবাহিত এবং প্রেমিকটি অবিবাহিত কিংবা বিবাহিত? সেখানে অবধারিতভাবে সব বিষাক্ত শর নিক্ষিপ্ত হবে সেই নারীর প্রতি।

আর সেই নারী যদি সন্তানের জননী হয় তাহলে তো অবস্থা আরও খারাপ। হোক না তার স্বামী মাতাল, জুয়ারি, বেকার কিংবা অন্য নারীতে আসক্ত। কখনও বলা হবে না, স্বামীর অবহেলা, নির্যাতন, হতাশা কিংবা অসুখী দাম্পত্যর কারণে অন্যজনের প্রেমে পড়েছে সেই অসহায় নারী। বরং তাকে চিত্রিত করা হবে ‘কামুকী’, ‘দুঃশ্চরিত্রা’ ‘স্বৈরিণী’ ইত্যাদি শত শত বিশ্লেষণে। ঘরে-বাইরে কোথাও এতোটুকু সহানুভূতি বা করুণা কিছুই থাকবে না তার প্রতি।

তার জন্য ঘৃণা এতো প্রবল হবে যে, তার মৃত্যুই যেন জনতাকে স্বস্তি দিবে তখন। এমনকি প্রিয়তম সন্তানও তার প্রতি হবে নির্মম। তার জন্য আত্মীয় বন্ধুদেরও শোক নয়, থাকবে শুধু লজ্জা।

এখানেও কিন্তু প্রেমিক পুরুষটি কিছুটা আড়ালেই থাকবে। তখন বলা হবে না ‘পুরুষ হয়ে অপর পুরুষের ঘর ভাঙলো’। বরং যদি সে অবিবাহিত ও প্রেমিকার চেয়ে বয়সে ছোট হয় তাহলে বলা হবে, ‘ছেলেটার মাথা নষ্ট করেছে ওই ডাইনি’।
আর যদি পুরুষটিও হয় বিবাহিত, তাহলে তার স্ত্রীসহ অন্য আত্মীয়স্বজনরা ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রেমিকার উপর। বলা হবে ‘নষ্ট মহিলা রং-ঢং করে সতী সাধ্বীর ঘর ভেঙেছে’।

তার মানে ঘটনা যাই হোক পরকীয়ার দায় সর্বদা নারীর কাঁধেই বেশি। তখন তার মৃত্যুই হবে সকলের কাম্য। সমাজের অলিখিত পুরুষতান্ত্রিক সংবিধানে এই নারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হবে। সমাজের এই মনোভাবকে পুঁজি করেই চলে একশ্রেণির অপমিডিয়া ও অপসাংবাদিক। (এদের আমি সাংবাদিক বলতে নারাজ। কারণ এখনও সাংবাদিকতা পেশায় আছেন প্রচুর সংখ্যক পরিশ্রমী ও সৎ মানুষ)।

তাই কোনো নারীকে হত্যা করা হলেই এই অপসাংবাদিকরা সুযোগ খোঁজে তার কপালে কারণে-অকারণে পরকীয়ার লেবেল এঁটে দেওয়ার। এর ফলে সেই হত্যাকে জায়েজ করে হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণাকে কমিয়ে আনাও গেল সেইসঙ্গে রসালো কিচ্ছা কাহিনী বিক্রি করে ব্যবসা হলো রমরমা। একই ঢিলে হত্যাকারীদের ‘পারপাস সার্ভ’ আর বিক্রিবাট্টা বাড়ানো। এমন মোক্ষম সুযোগ কেউ ছাড়ে নাকি?

আর মৃত নারীটির প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা, তার ছেলেমেয়েদের প্রতি সহানুভূতি? এসব আবার কী? অতশত কথা মাথায় রেখে আজকাল চলা যায় নাকি?