ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রধানমন্ত্রীকে আপা বলা যায়, ইউএনওকে নয়

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যদি ক্ষেত্রবিশেষে ‘আপা’ ডাকা যায়, তাহলে একজন নারী ইউএনওকে কেন বেসরকারি লোকজন আপা বলতে পারবে না? সবাই সরকারি চাকরি করে না। যারা সাংবাদিকতার মত সৃজনশীল ও স্বাধীন পেশায় জড়িত তাঁরা যদি কাউকে স্যার/ম্যাডাম না বলে, ভাই কিংবা আপা বলে তাহলে কি সংবিধান বা আইনবিরোধী কিছু করা হয়?

ম্যাজিস্ট্রেট হওন, আর তথ্য অফিসারই হওন, যারা সরকারি চাকরি করেন, তারা সার্ভিসে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সিনিয়রদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। নারী কর্মকর্তাদের অনেকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করে। তবে ‘ম্যাডাম’ শব্দটা রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে বিশেষ অর্থ ও তাৎপর্য বহন করে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে দলের নেতা-কর্মী নির্বিশেষে সবাই ‘ম্যাডাম’ বলে। আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, কদিন আগে পশ্চিমা মিডিয়া কর্তৃক ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধি পাওয়া, বিশ্বের অন্যতম প্রভাব ও ক্ষমতাশালী নারী শেখ হাসিনাকে নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ ‘আপা’ বলে ডাকে। শুধু সামরিক-বেসামরিক আমলারা প্রধানমন্ত্রীকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। আবার অন্য নজিরও আছে। নেতা-কর্মীরা ‘স্যার’ না বললে রাগ করেন, এমন লিডারও বাংলাদেশে আছে।

আমার সাড়ে তিন বছরের ছেলে প্লে গ্রুপে একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিন্তু প্রথমদিন আমার বাচ্চার স্কুলের নারী শিক্ষকদের আমি ‘ম্যাডাম’ বলেছি। মিস বা টিচারও বলা যেতে পারত। জুনিয়র নারী সহকর্মীদেরও আমি শ্রদ্ধামিশ্রিত দুষ্টুমি করে ‘ম্যাডাম’ বলি। আবার সিনিয়র অনেক নারী শিক্ষককে ‘আপা’ বলি। আমাদের উপাচার্যকে রাজনীতির সাথে জড়িত আমার অনেক বন্ধু বা বড় ভাই ‘আপা’ বলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জুনিয়র শিক্ষক হয়ে আমি একজন উপাচার্যকে ‘আপা’ বলি না। আবার অনেক শিক্ষক আপা বলেই সম্বোধন করেন।

তবে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস আর শিক্ষকতার চাকরি এক বিষয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রভাষক সম্পর্কের খাতিরে নিজের টিচার না হলে অনেক সহযোগী অধ্যাপককেও ভাই বলে ফেলে। যদি কখনো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেও বলে ফেলে, কিছু করার থাকে না; পুরো বিষয়টাই নির্ভর করে নিজস্ব বোধ-বিবেচনার উপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিতে স্বাধীনতা চর্চার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু বিসিএসে জয়েন করা একটি ছেলে বা মেয়ের দাপ্তরিককারণে তেমন স্বাধীনতা থাকে না। ক্যাডার সার্ভিসগুলোতে ছেলে-মেয়েদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যাতে ‘বস ইজ অলওয়েস রাইট’ কথাটা চর্চায় পরিণত হয়।

‘বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন’ এর উপর ভিত্তি করে পদোন্নতি হয় সরকারি কর্মকর্তাদের। যে কোনো মূল্যে নিজেদের ‘এসিআর’ ইতিবাচক রাখতে চান কর্মকর্তারা। তবে ক্যাডার সার্ভিসে সবাই সমান কপাল নিয়ে অফিসার হয় না। একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা এএসপির যেভাবে পদোন্নতি হয়, একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সেভাবে হয় না। কলেজের শিক্ষকদেরও একই অবস্থা। যাইহোক, বিসিএস জবে, সামাজিক মূল্যবোধ-নির্ভর প্রকাশ্য সম্বোধন কোনো মূল্য বহন করে না। প্রাইমারি, হাইস্কুল বা কলেজের শিক্ষককে একজন ইউএনও কি কখনো ‘স্যার’ বলেন? যদি বলেন, তাহলে খুবই ভালো। তাঁদের নিজেদের কোনো শিক্ষকের কথা বলছি না। পরিদর্শনে গিয়ে বাদানুবাদকে কেন্দ্র করে একজন শিক্ষককে পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেছিলেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে বড় বড় আমলাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটু খাতির করতে দেখা যায়। কদিন পর হয়ত এই খাতিরও থাকবে না। কারণ বিদেশি পিএইচডি আর মাস্টার্সের অনেক বৃত্তি এখন ম্যাজিস্ট্রেট/ইউএনওদেরকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। বৃত্তিগুলোর অধিকাংশের বিজ্ঞপ্তি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আর আগের মত আসেনা।

দিন দিন বাংলাদেশ যেভাবে আমলাতন্ত্র-কেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, তাতে একসময় হয়ত, অন্য কোনো পেশার মানুষের সম্মান আর অবশিষ্ট বলে কিছু থাকবে না। ডাক্তারদের পর্যন্ত আপা বা ভাই বললে রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে মেরে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। কদিন আগে আমরা দেখলাম, একজন এডিসি আর সিভিল সার্জনের মারমারিকে কেন্দ্র করে ঘটনা কোন পর্যন্ত গড়িয়েছিল! সিভিল সার্জনদের অনেক নতুন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত  ম্যাজিস্ট্রেট বা এএসপি পর্যন্ত ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে চান না বলে অনেক অভিযোগ শুনেছি। আবার জেলায় জেলায় জেলা প্রশাসক আর এসপির মধ্যে কেমন সম্পর্ক বিরাজ করে সেও আমরা জানি। ফেনির জনপ্রিয় ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা সাথে ফোনে কীভাবে একজন ওসি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেয়াদবি করেছিল সেও আমরা দেখেছি। আমি নিজে দেখেছি, একটি থানার ওসি অনুষ্ঠান স্থলে মঞ্চে আরাম কেদারায় বসে আছেন, অথচ সেখানকার ইউএনও মঞ্চের নিচে দূরে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন!

সাংবাদিকদের বেলায় আসি। সাংবাদিকরা সবাই সমান শিক্ষিত নন। আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় বলছি। বিভিন্ন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসেও অনেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাশ করে শত শত ছেলে-মেয়ে সাংবাদিকতা করছে। বিসিএস বা অন্য সরকারি চাকরি বাদ দিয়ে অনেকে সাংবাদিকতা করছেন। এমনকি মেডিক্যাল-বুয়েটের অনেকেই সাংবাদিকতা পেশায় আছেন। আবার দেশের নানা কলেজ থেকে পাশ করেও অনেক সাংবাদিক ঢাকাসহ সারাদেশে স্বীয় দক্ষতা ও মেধার শক্তিতে কাজ করছেন। তবে অনেকে আছেন যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত শুদ্ধতা সিরিয়াসলি প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকে আছেন, যারা শহর-বন্দর-গ্রামে সাংবাদিক নাম দিয়ে দাবড়িয়ে বেড়ান, সাংবাদিকতার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজি, স্থানীয় এমপি বা রাজনৈতিক নেতার ‘দালাল’ হিসেবে কাজ করে বেড়ান। এলাকার কোনো সমস্যা, মানুষের কষ্টের খবর এরা দেন না। সাংবাদিকের পরিচয়কে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে ব্যবহার করেন।  মূলত এই ‘টাউট’ শ্রেণির ‘সাংবাদিক’দের জন্য পেশার সাথে জড়িত সবার প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারনা কাজ করে সমাজে। এরা দুর্নীতিবাজ পুলিশ, আমলা, রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, ঠিকাদার আর নানা ক্ষেত্রের অপরাধীদের সাথে সিন্ডিকেট করে অবৈধ অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান।

মফস্বলে যারা সাংবাদকিতা করেন, তাঁদের অধিকাংশই শুধু সাংবাদিকতা করে জীবিকা নির্বাহ করেন না। পার্টটাইম করেন। কেউ বেসরকারি কলেজ/হাইস্কুলের শিক্ষক, কেউ ব্যবসা করেন, কেউ এলাকায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে বেড়ান।  পার্টটাইম কাজ হিসেবে সাংবাদিকতা করেন ইনারা। বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক পত্রিকা, টেলিভিশন বার রেডিও চ্যানেলের জেলা/উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন এসব সাংবাদিক। অনেক সংবাদমাধ্যম নিজেদের প্রতিনিধিদের মজুরি দিতে পারে, বেশিরভাগই পারে না বা দেয় না। মফস্বলে অনেক সৎ, যোগ্যতাসম্পন্ন, নিয়মিত ভালো মজুরি-প্রাপ্ত সাংবাদিক আছেন। অনেকে আছেন, নিয়মিত মজুরি প্রাপ্ত হলেও, অসততার জন্য সাংবাদিকতা করতে পারেন না। অনেক জেলা প্রতিনিধি এবং ব্যুরো চিফকে ঢাকার সিনিয়র রিপোর্টারদের মতই মজুরি দেন পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকগণ।

এসিল্যান্ড, ইউএনও বা জেলা প্রশাসকদের সংস্পর্শে মূলত মফস্বলের সাংবাদিকরাই আসেন। ঢাকার ‘উচ্চশিক্ষিত’ সাংবাদিকদের সাথে কাজ করা আর মফস্বলের ‘অল্প শিক্ষিত’ সাংবাদিকদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা এক রকম হয় না।  ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রায় সবাই সচিবদের অনেককে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। তবে জুনিয়র সাংবাদিকদের অনেকে আছেন যারা সচিব লেভেলের আমলাদের ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করেন। তবে কোনো সাংবাদিক সিনিয়র হোক, বা জুনিয়র হোক, কোনো আমলাকে স্যার বা ম্যাডাম বলতে বাধ্য নন।  শিক্ষকদেরকে ছাত্র-ছাত্রী না হয়েও অনেকে সম্মান করে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে ঠিকই। না বললেও কিছু করার নাই। পাবলিক বাসে যেমন সবাই সবাইকে ভাই বা আপা বলে সম্বোধন করে। দেশের মন্ত্রীদেরকে বেসরকারি লোকজন ভাই/আপা বলে। কিন্তু সরকারি চাকরি করলে কথা ভিন্ন। সিনিয়রকে স্যার বা ম্যাডাম বলা নিয়মের মধ্যে পড়ে। সাংবাদিকরা সরকারি কোনো চাকরি করেন না।

আমলাতন্ত্র বলি, সাংবাদিকতা বলি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেভাবে বাংলাদেশ চলছে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ জুন বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যন হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে সিস্টেম আমরা আজকে আমরা দেখি, সেই সিস্টেম ব্রিটিশ কলোনিয়াল সিস্টেম। এতে দেশের মঙ্গল হতে পারে না। ব্রিটিশ সিস্টেম করে গিয়েছিল বা যেটা আমাদের দেশে চলছিল অর্থাৎ উপনিবেশবাদীরা দেশকে শোষণ করবার জন্য যে সিস্টেম দেশের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মধ্যে চালু করে গিয়েছিল,সেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সেই সিস্টেম, সেই আইন, সেই সব কিছু, পরিবর্তন করবার নামই বিপ্লব’।

আমলাতন্ত্রের কলোনিয়াল সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর, সকালে সংবিধান বিলের উপর ভাষণ প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কেউ যদি বলেন, গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলব, সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তাহলে তা করতে হবে। কেউ কেউ বলছেন যে, সরকারি কর্মচারীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। তাঁরা অন্য দেশের শাসনতন্ত্রও পড়ুন। সরকারি কর্মচারীরা একটি আলাদা জাতি নয়। তাঁরা আমাদের আমাদের বাপ, আমাদের ভাই। তাঁরা ডিফারেন্ট ক্লাস নয়। ইংরেজ আমলে আইসিএস, আইপিএসদের প্রোটেকশন দেয়া হত।  সেই প্রোটেকশন পাকিস্তান আমলেও দেয়া হত। আমলাতন্ত্রের সেই প্রোটেকশন এ আঘাত করেছি-অন্য জায়গায় আঘাত করিনি। এই ক্লাস রাখতে চাইনা। কারণ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, classless society প্রতিষ্ঠা করতে চাই’।

বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলেন, সেভাবে কিছুই হচ্ছে না। দেশের কৃষক, শ্রমিকসহ নানা কর্মজীবী মানুষের করের টাকায় দেশ চলে। লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেট হয়। সেই বাজেট মেরে খায় এদেশের কিছু আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও সাংবাদিকদের একটা অংশ। শিক্ষক-শিক্ষার্থী- অভিভাবকরা মিলে প্রশ্ন ফাঁস করেন। যদি বঙ্গবন্ধুকে আদর্শ হিসেবে আমরা নিতাম, তাহলে একজন সাংবাদিক ইউএনও কে ‘আপা’ বলে ধমক খেতেন না। সাংবাদিকদেরও হলুদ সাংবাদিক বলে গালি খাওয়া লাগত না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

প্রধানমন্ত্রীকে আপা বলা যায়, ইউএনওকে নয়

আপডেট টাইম : ০৫:৪২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ জানুয়ারী ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যদি ক্ষেত্রবিশেষে ‘আপা’ ডাকা যায়, তাহলে একজন নারী ইউএনওকে কেন বেসরকারি লোকজন আপা বলতে পারবে না? সবাই সরকারি চাকরি করে না। যারা সাংবাদিকতার মত সৃজনশীল ও স্বাধীন পেশায় জড়িত তাঁরা যদি কাউকে স্যার/ম্যাডাম না বলে, ভাই কিংবা আপা বলে তাহলে কি সংবিধান বা আইনবিরোধী কিছু করা হয়?

ম্যাজিস্ট্রেট হওন, আর তথ্য অফিসারই হওন, যারা সরকারি চাকরি করেন, তারা সার্ভিসে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সিনিয়রদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। নারী কর্মকর্তাদের অনেকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করে। তবে ‘ম্যাডাম’ শব্দটা রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে বিশেষ অর্থ ও তাৎপর্য বহন করে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে দলের নেতা-কর্মী নির্বিশেষে সবাই ‘ম্যাডাম’ বলে। আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, কদিন আগে পশ্চিমা মিডিয়া কর্তৃক ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধি পাওয়া, বিশ্বের অন্যতম প্রভাব ও ক্ষমতাশালী নারী শেখ হাসিনাকে নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ ‘আপা’ বলে ডাকে। শুধু সামরিক-বেসামরিক আমলারা প্রধানমন্ত্রীকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। আবার অন্য নজিরও আছে। নেতা-কর্মীরা ‘স্যার’ না বললে রাগ করেন, এমন লিডারও বাংলাদেশে আছে।

আমার সাড়ে তিন বছরের ছেলে প্লে গ্রুপে একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিন্তু প্রথমদিন আমার বাচ্চার স্কুলের নারী শিক্ষকদের আমি ‘ম্যাডাম’ বলেছি। মিস বা টিচারও বলা যেতে পারত। জুনিয়র নারী সহকর্মীদেরও আমি শ্রদ্ধামিশ্রিত দুষ্টুমি করে ‘ম্যাডাম’ বলি। আবার সিনিয়র অনেক নারী শিক্ষককে ‘আপা’ বলি। আমাদের উপাচার্যকে রাজনীতির সাথে জড়িত আমার অনেক বন্ধু বা বড় ভাই ‘আপা’ বলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জুনিয়র শিক্ষক হয়ে আমি একজন উপাচার্যকে ‘আপা’ বলি না। আবার অনেক শিক্ষক আপা বলেই সম্বোধন করেন।

তবে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস আর শিক্ষকতার চাকরি এক বিষয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রভাষক সম্পর্কের খাতিরে নিজের টিচার না হলে অনেক সহযোগী অধ্যাপককেও ভাই বলে ফেলে। যদি কখনো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেও বলে ফেলে, কিছু করার থাকে না; পুরো বিষয়টাই নির্ভর করে নিজস্ব বোধ-বিবেচনার উপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিতে স্বাধীনতা চর্চার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু বিসিএসে জয়েন করা একটি ছেলে বা মেয়ের দাপ্তরিককারণে তেমন স্বাধীনতা থাকে না। ক্যাডার সার্ভিসগুলোতে ছেলে-মেয়েদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যাতে ‘বস ইজ অলওয়েস রাইট’ কথাটা চর্চায় পরিণত হয়।

‘বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন’ এর উপর ভিত্তি করে পদোন্নতি হয় সরকারি কর্মকর্তাদের। যে কোনো মূল্যে নিজেদের ‘এসিআর’ ইতিবাচক রাখতে চান কর্মকর্তারা। তবে ক্যাডার সার্ভিসে সবাই সমান কপাল নিয়ে অফিসার হয় না। একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা এএসপির যেভাবে পদোন্নতি হয়, একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সেভাবে হয় না। কলেজের শিক্ষকদেরও একই অবস্থা। যাইহোক, বিসিএস জবে, সামাজিক মূল্যবোধ-নির্ভর প্রকাশ্য সম্বোধন কোনো মূল্য বহন করে না। প্রাইমারি, হাইস্কুল বা কলেজের শিক্ষককে একজন ইউএনও কি কখনো ‘স্যার’ বলেন? যদি বলেন, তাহলে খুবই ভালো। তাঁদের নিজেদের কোনো শিক্ষকের কথা বলছি না। পরিদর্শনে গিয়ে বাদানুবাদকে কেন্দ্র করে একজন শিক্ষককে পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেছিলেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে বড় বড় আমলাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটু খাতির করতে দেখা যায়। কদিন পর হয়ত এই খাতিরও থাকবে না। কারণ বিদেশি পিএইচডি আর মাস্টার্সের অনেক বৃত্তি এখন ম্যাজিস্ট্রেট/ইউএনওদেরকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। বৃত্তিগুলোর অধিকাংশের বিজ্ঞপ্তি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আর আগের মত আসেনা।

দিন দিন বাংলাদেশ যেভাবে আমলাতন্ত্র-কেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, তাতে একসময় হয়ত, অন্য কোনো পেশার মানুষের সম্মান আর অবশিষ্ট বলে কিছু থাকবে না। ডাক্তারদের পর্যন্ত আপা বা ভাই বললে রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে মেরে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। কদিন আগে আমরা দেখলাম, একজন এডিসি আর সিভিল সার্জনের মারমারিকে কেন্দ্র করে ঘটনা কোন পর্যন্ত গড়িয়েছিল! সিভিল সার্জনদের অনেক নতুন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত  ম্যাজিস্ট্রেট বা এএসপি পর্যন্ত ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে চান না বলে অনেক অভিযোগ শুনেছি। আবার জেলায় জেলায় জেলা প্রশাসক আর এসপির মধ্যে কেমন সম্পর্ক বিরাজ করে সেও আমরা জানি। ফেনির জনপ্রিয় ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা সাথে ফোনে কীভাবে একজন ওসি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেয়াদবি করেছিল সেও আমরা দেখেছি। আমি নিজে দেখেছি, একটি থানার ওসি অনুষ্ঠান স্থলে মঞ্চে আরাম কেদারায় বসে আছেন, অথচ সেখানকার ইউএনও মঞ্চের নিচে দূরে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন!

সাংবাদিকদের বেলায় আসি। সাংবাদিকরা সবাই সমান শিক্ষিত নন। আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় বলছি। বিভিন্ন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসেও অনেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাশ করে শত শত ছেলে-মেয়ে সাংবাদিকতা করছে। বিসিএস বা অন্য সরকারি চাকরি বাদ দিয়ে অনেকে সাংবাদিকতা করছেন। এমনকি মেডিক্যাল-বুয়েটের অনেকেই সাংবাদিকতা পেশায় আছেন। আবার দেশের নানা কলেজ থেকে পাশ করেও অনেক সাংবাদিক ঢাকাসহ সারাদেশে স্বীয় দক্ষতা ও মেধার শক্তিতে কাজ করছেন। তবে অনেকে আছেন যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত শুদ্ধতা সিরিয়াসলি প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকে আছেন, যারা শহর-বন্দর-গ্রামে সাংবাদিক নাম দিয়ে দাবড়িয়ে বেড়ান, সাংবাদিকতার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজি, স্থানীয় এমপি বা রাজনৈতিক নেতার ‘দালাল’ হিসেবে কাজ করে বেড়ান। এলাকার কোনো সমস্যা, মানুষের কষ্টের খবর এরা দেন না। সাংবাদিকের পরিচয়কে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে ব্যবহার করেন।  মূলত এই ‘টাউট’ শ্রেণির ‘সাংবাদিক’দের জন্য পেশার সাথে জড়িত সবার প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারনা কাজ করে সমাজে। এরা দুর্নীতিবাজ পুলিশ, আমলা, রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, ঠিকাদার আর নানা ক্ষেত্রের অপরাধীদের সাথে সিন্ডিকেট করে অবৈধ অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান।

মফস্বলে যারা সাংবাদকিতা করেন, তাঁদের অধিকাংশই শুধু সাংবাদিকতা করে জীবিকা নির্বাহ করেন না। পার্টটাইম করেন। কেউ বেসরকারি কলেজ/হাইস্কুলের শিক্ষক, কেউ ব্যবসা করেন, কেউ এলাকায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে বেড়ান।  পার্টটাইম কাজ হিসেবে সাংবাদিকতা করেন ইনারা। বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক পত্রিকা, টেলিভিশন বার রেডিও চ্যানেলের জেলা/উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন এসব সাংবাদিক। অনেক সংবাদমাধ্যম নিজেদের প্রতিনিধিদের মজুরি দিতে পারে, বেশিরভাগই পারে না বা দেয় না। মফস্বলে অনেক সৎ, যোগ্যতাসম্পন্ন, নিয়মিত ভালো মজুরি-প্রাপ্ত সাংবাদিক আছেন। অনেকে আছেন, নিয়মিত মজুরি প্রাপ্ত হলেও, অসততার জন্য সাংবাদিকতা করতে পারেন না। অনেক জেলা প্রতিনিধি এবং ব্যুরো চিফকে ঢাকার সিনিয়র রিপোর্টারদের মতই মজুরি দেন পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকগণ।

এসিল্যান্ড, ইউএনও বা জেলা প্রশাসকদের সংস্পর্শে মূলত মফস্বলের সাংবাদিকরাই আসেন। ঢাকার ‘উচ্চশিক্ষিত’ সাংবাদিকদের সাথে কাজ করা আর মফস্বলের ‘অল্প শিক্ষিত’ সাংবাদিকদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা এক রকম হয় না।  ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রায় সবাই সচিবদের অনেককে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। তবে জুনিয়র সাংবাদিকদের অনেকে আছেন যারা সচিব লেভেলের আমলাদের ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করেন। তবে কোনো সাংবাদিক সিনিয়র হোক, বা জুনিয়র হোক, কোনো আমলাকে স্যার বা ম্যাডাম বলতে বাধ্য নন।  শিক্ষকদেরকে ছাত্র-ছাত্রী না হয়েও অনেকে সম্মান করে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে ঠিকই। না বললেও কিছু করার নাই। পাবলিক বাসে যেমন সবাই সবাইকে ভাই বা আপা বলে সম্বোধন করে। দেশের মন্ত্রীদেরকে বেসরকারি লোকজন ভাই/আপা বলে। কিন্তু সরকারি চাকরি করলে কথা ভিন্ন। সিনিয়রকে স্যার বা ম্যাডাম বলা নিয়মের মধ্যে পড়ে। সাংবাদিকরা সরকারি কোনো চাকরি করেন না।

আমলাতন্ত্র বলি, সাংবাদিকতা বলি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেভাবে বাংলাদেশ চলছে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ জুন বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যন হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে সিস্টেম আমরা আজকে আমরা দেখি, সেই সিস্টেম ব্রিটিশ কলোনিয়াল সিস্টেম। এতে দেশের মঙ্গল হতে পারে না। ব্রিটিশ সিস্টেম করে গিয়েছিল বা যেটা আমাদের দেশে চলছিল অর্থাৎ উপনিবেশবাদীরা দেশকে শোষণ করবার জন্য যে সিস্টেম দেশের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মধ্যে চালু করে গিয়েছিল,সেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সেই সিস্টেম, সেই আইন, সেই সব কিছু, পরিবর্তন করবার নামই বিপ্লব’।

আমলাতন্ত্রের কলোনিয়াল সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর, সকালে সংবিধান বিলের উপর ভাষণ প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কেউ যদি বলেন, গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলব, সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তাহলে তা করতে হবে। কেউ কেউ বলছেন যে, সরকারি কর্মচারীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। তাঁরা অন্য দেশের শাসনতন্ত্রও পড়ুন। সরকারি কর্মচারীরা একটি আলাদা জাতি নয়। তাঁরা আমাদের আমাদের বাপ, আমাদের ভাই। তাঁরা ডিফারেন্ট ক্লাস নয়। ইংরেজ আমলে আইসিএস, আইপিএসদের প্রোটেকশন দেয়া হত।  সেই প্রোটেকশন পাকিস্তান আমলেও দেয়া হত। আমলাতন্ত্রের সেই প্রোটেকশন এ আঘাত করেছি-অন্য জায়গায় আঘাত করিনি। এই ক্লাস রাখতে চাইনা। কারণ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, classless society প্রতিষ্ঠা করতে চাই’।

বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলেন, সেভাবে কিছুই হচ্ছে না। দেশের কৃষক, শ্রমিকসহ নানা কর্মজীবী মানুষের করের টাকায় দেশ চলে। লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেট হয়। সেই বাজেট মেরে খায় এদেশের কিছু আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও সাংবাদিকদের একটা অংশ। শিক্ষক-শিক্ষার্থী- অভিভাবকরা মিলে প্রশ্ন ফাঁস করেন। যদি বঙ্গবন্ধুকে আদর্শ হিসেবে আমরা নিতাম, তাহলে একজন সাংবাদিক ইউএনও কে ‘আপা’ বলে ধমক খেতেন না। সাংবাদিকদেরও হলুদ সাংবাদিক বলে গালি খাওয়া লাগত না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়