হাবীবাহ্ নাসরীন:
২০১০ সাল। আমি তখন অনার্স প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কিছুদিন নানাবাড়িতে ছিলাম। তারপর উঠে গেলাম মেসে। ভার্সিটির দুইজন আপু আর আমরা একই ব্যাচের তিনজন মেয়ে। ছয়তলায় দুই কক্ষের সেই বাসাটিতে আমাদের একপ্রকার মানবেতর জীবনই যাপন করতে হয়েছিল।
বাসাটির বাথরুমে কোনো পানির লাইন ছিল না। ফজরের আজানের পরপর একবার পানি দেয়া হতো, তাও ছাদের উপর ট্যাংকিতে জমা হতো আর আমরা সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্কির ভেতর পাইপ দিয়ে একরকম কায়দা করে পানি তুলতাম। এমন দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে আমরা নতুন বাসা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
সবাই মিলে বাসা খুঁজতে যাই। বাড়িওয়ালারা বাসা দেখায়। যখন শোনে শুধু মেয়েরা থাকবো, দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়! কেউ কেউ এমন আচরণ করলো যেন আমরা জেলপালানো দাগী আসামী বা রক্তচোষা ডাইনি- এখনই তাদের বুকে কোপ বসাবো বা ঘাড় মটকে দেবো! তখন ঊনিশ বছর বয়স। জেলা শহর থেকে মা-বাবার কোলের ওম ছেড়ে কেবল রাজধানীর বুকে এসেছি। এমন কোমল বয়সে এমন রূঢ় বাস্তবতা দেখে মনটাই গেল ভেঙে। কেউ আর আমাদের কাছে বাড়িভাড়া দিতে চায় না। যেন আমরা মা-বাবাকে রেখে দূরে থেকে, পড়াশোনার জন্য ঘর ছেড়ে বাইরে এসে মস্তবড় অন্যায় করে ফেলেছি!
তখন মিডটার্ম চলছিল। তারই মাঝে একবেলা পরীক্ষা দেই, আরেকবেলা বাসা খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে একটি বাসা পাওয়া গেল। বাড়িওয়ালাও খুব ভালো ব্যবহার করলেন। আমরা তখনই বাড়িভাড়ার অগ্রিম টাকা পরিশোধ করলাম। এবং পরবর্তী মাসের এক তারিখে গাট্টিবোচকা নিয়ে উঠেও গেলাম। সেপর্যন্ত ঠিক ছিল। ঝামেলা বাঁধলো যখন বাড়িওয়ালা চাচা তার স্ত্রীসমেত আমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে এলেন।
তারা আমাদের বাসা ঘুরেটুরে দেখে বললেন, `ইয়ে মানে, তোমাদের বাসায় চৌকি কই, খাট কই? তোমাদের বাসায় ফার্নিচার এত কম কেন? কোনো ছেলে নেই কেন?` বললাম, `আঙ্কেল, আমরা তো এখানে সংসার করছি না, পড়ালেখা করার জন্য থাকা, তাই ফার্নিচারের বালাই নেই। আর ছেলে মানুষ কোথায় পাবো, অবিবাহিতা মেয়েরা যদি ছেলেদের বাসায় নিয়ে আসি, আপনিই তো তখন আমাদের তাড়িয়ে দেবেন!` বাড়িওয়ালা বললেন, `হায় হায়, তোমরা ব্যাচেলর! আগে বলবে তো! মা, মাগো, তোমরা উঠেই যখন গিয়েছ, তখন এই মাসটা থাকো, আগামী মাসেই তোমরা বাসা ছেড়ে দেবে!`
মেসের বাকি সদস্যরা তখন চুপচাপ। একা আমিই কথা বলছি। বললাম, `বাসা ভাড়া নেয়াটা তো ছেলেখেলা না আঙ্কেল, আজকে উঠতে বলবেন, কাল চলে যেতে বলবেন! আপনি জানেন না, কত কষ্ট করে এই বাসাটা আমরা পেয়েছি। আপনিও তো কারো বাবা। আজ আপনার সন্তান এমন সমস্যায় পড়লে আপনি চুপ করে থাকতেন? আর আমাদের তো কোনো অপরাধ নেই। আপনি আমাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলুন।
আমাদের মা-বাবা যদি তাদের সন্তানকে দূরে রেখে পড়াতে পারে, তবে আপনাদের বাড়িভাড়া দিতে সমস্যা কোথায়? আমরা এখানে প্রত্যেকেই প্রাপ্তবয়স্ক। যদি কখনো কোনো ভুল করি, তবে সে দায় আপনার নয়, আমাদের। আপনি আমাদের অন্তত তিনমাস সময় দিন। তারপর যদি মনে হয়, আমাদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়া উচিৎ নয়, আমরা চলে যাবো।` বাড়িওয়ালা সম্মত হলেন।
ব্যাচেলর জীবনে বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়নি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিশেষ করে যারা ছেলে, তাদের ওপর সন্দেহর তীর তো আরো এক ডিগ্রি উপরে থাকে! বাড়িওয়ালা সবসময় মনে মনে ভাবতে থাকেন, এই বুঝি তার ভাড়াটিয়া ছেলেটির সঙ্গে তার মেয়েটির প্রেম হয়ে গেল, এই বুঝি ছেলেটি তার মেয়েটিকে নিয়ে ভেগে গেল! কখনো যে এমন হয় না, বা হওয়ার আশঙ্কা নেই, সেকথা বলছি না। তবে না হওয়ার পরিমাণই বেশি।
বাড়িওয়ালাদের বুঝতে হবে, নিজের পরিবার-পরিজন-প্রিয়জন ছেড়ে ব্যাচেলর ছেলেগুলো রাজধানীতে আসে পড়াশোনা করতে কিংবা কাজ করতে, তাদের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে নয়। প্রেম করাই যদি জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে তা নিজের বাড়িতে থেকেই করা যায়। সেজন্য সবাইকে ছেড়ে এতটা দূরে এসে বাড়িওয়ালাদের চক্ষুশূল হওয়ার দরকার পড়ে না।
এতক্ষণ যেভাবে হালকাভাবে কথাগুলো লিখে গেলাম, বাস্তবতা কিন্তু এতটা হালকা নয়। ঢাকা শহরে ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া যেন এক মহা সমস্যার নাম। এখানে ব্যাচেলররা যেমন বাড়ি খুঁজতে গিয়ে হয়রান হয়, বাড়িওয়ালারাও তেমনি ব্যাচেলরদের কাছে বাড়িভাড়া দিয়ে অনেক সময় হয়রানিতে পড়েন।
সম্প্রতি গুলশান ট্র্যাজেডি ও সদ্য ঘটে যাওয়া কল্যাণপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পর বাড়িওয়ালাদের সমস্ত আক্ষেপ ও সন্দেহ এসে পড়ছে ব্যাচেলর ভাড়াটিয়াদের ওপর। অনেক বাড়িতে ব্যাচেলর ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দেয়া হয়ে গেছে। কারণ, ভাড়াটিয়া জঙ্গি হলে যে বাড়িওয়ালারও নিস্তার নেই! বাড়িভাড়া দেয়ার সময় ভাড়াটিয়ার প্রয়োজনীয় তথ্য যদি বাড়িওয়ালা নিয়ে থাকেন এবং সংশ্লিষ্ট থানায় তা জমা দিয়ে থাকেন, তবে এই ঝামেলা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু এটা যে বাংলাদেশ!
এখানে প্রায় সব মানুষই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সচেতন নন। এখানে ভাড়াটিয়ারা অলস, বাড়িওয়ালারা লোভী আর পুলিশেরা সুযোগসন্ধানী। এদের অল্প একটু অবহেলার দরুণ ভুক্তভোগী হচ্ছেন হাজারো নিরপরাধ মানুষ। অধরা থেকে যাচ্ছে আসল অপরাধী। ফলশ্রুতিতে আরো বড় অপরাধের সুযোগ পাচ্ছে তারা। একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কয়েকদিন খুব হইচই হয়। তারপর অবস্থা তথৈবচ।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এভাবে আর কতদিন! আগে বাড়িওয়ালারা ব্যাচেলরদের মানুষ মনে করতেন না এরপর থেকে সম্ভবত আরো খারাপকিছু ভাবতে শুরু করবেন। একটি ছেলে বা মেয়ে যদি জীবিকার তাগিদে রাজধানীতে আসে তবে তাকে একটি নিরাপদ আবাস দিতে না পারার ব্যর্থতা আসলে কার? দেশ স্বাধীন এবং আমাদের সরকার গণতান্ত্রিক সরকার। তবে কেন ব্যাচেলর ছেলেমেয়েরা নিরাপদ একটি আশ্রয় পাবে না? এই দেশ কি তাদেরও দেশ নয়? অপরাধ না করেও কেন তারা `অপরাধী` হবে?
মূল অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং নিধন করা দেশের আইনশৃঙ্ক্ষলা বাহিনীর দায়িত্ব। তাতে যদি তারা ব্যর্থ হয়, সেই দায়ভার কেন ব্যাচেলররা নেবে? উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে সাময়িক মুক্তি হয়তো মিলবে, কিন্তু সমাধান আসবে না। ব্যাচেলররা এভাবে সন্দেহ, অসম্মানের শিকার হলে পরবর্তি সময়ে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাই বেশি। দেশের টগবগে এসব নিরপরাধ তরুণদের নিরাপদ আবাসের নিশ্চয়তা দেয়া হোক, তারাই একদিন নিরাপদ একটি দেশ গড়ে তুলবে।