ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উন্নত বাংলাদেশের রূপকার

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ১৯৭১ স্বাধীনতা লাভের পর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জাতির মননে স্বনির্ভরতার চেতনায় যে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের এক জঘন্য নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেই স্বপ্নের অবসান হয়। তারপর থেকে উল্টোপথে হেঁটেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পথ দেখানো বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শচ্যুত সেই বাংলাদেশের যাত্রাকাল ২১ বছরের মাথায় ক্ষমতাসীন হয় বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে শুরু হয় পথ হারানো বাংলাদেশের সঠিক পথে আসার পালা। দীর্ঘ ২১ বছরের কণ্টকাকীর্ণ রাজনীতির ধূম্রজাল থেকে দেশকে আলোকিত পথের দিশা দেখানোর কাজটি সুকঠিন ছিল বৈকি। তবু অনড় ছিলেন অদম্য সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেই পিতা বঙ্গবন্ধুর গড়ে তোলা দলটির হাল ধরেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অস্থিরতা আর জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তিনি চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ, হাট-ঘাট-মাঠ। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ছুটে গেছেন দেশের জনগণের কাছে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, স্বপ্ন আর প্রত্যাশার কথাগুলো খুব কাছে গিয়ে শুনেছেন। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রীতি ভালোবাসায় ধন্য হয়ে তিনি রচনা করেছেন উন্নত এক বাংলাদেশের রূপকল্প। ২০০৮ সালটি যেন বাংলাদেশের ভাগ্যচক্রে আশার আলো নিয়ে আসে। দূরদর্শী নেত্রী শেখ হাসিনা পিতার মতো ঠিক ধরতে পেরেছেন বাঙালি জাতির সাঁইকি। তাই তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বীজ বুনে দিতে সক্ষম হন বাংলাদেশের জনগণের মানসপটে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকরের সাহসী উদ্যোগ তরুণসমাজের চেতনার স্ফুরণ ঘটায়। কেননা, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যকর হবে—এটা নিছক একটা দুঃস্বপ্ন ছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী চিন্তা-চেতনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব ষড়যন্ত্র, বাধা অতিক্রম করে বিচার কার্যকর করে বিশ্বে অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেন। জঙ্গিবাদ নির্মূলে শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ জিরো টলারেন্স এবং সুদৃঢ় অবস্থান বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের অন্যতম একটি কারণ। এজন্য তিনি জীবনবাজি রেখেছেন। নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছেন দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি। দেশীয় এবং বিশ্ব ষড়যন্ত্রকে তিনি দূরদর্শিতা ও সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করে নেতৃত্বের অনুপম আদর্শিক স্থান দখল করে নিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি সাহসিকতা, উদারতা এবং মানবিকতার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্বনেতৃত্বের সমীহ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল স্থাপন, ১০০টি স্থানে ইকনোমিক জোন, সমুদ্র বিজয় ও সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগানো, রেলের উন্নয়ন ও রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো নির্মাণ, নারীর ক্ষমতায়নে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন, স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মাতৃ মৃত্যুর হার কমানো, গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাদ্য ঘাটতির দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ফরেন রিজার্ভ বৃদ্ধি, রফতানি খাত ও আয় বৃদ্ধি, তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল বিপ্লব প্রভৃতি কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে দেশকে তিনি স্বল্প সময়ে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার নেতৃত্বে দূরদর্শিতার স্বীকৃতি ও প্রশংসায় অভিষিক্ত হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ এখন আর সেই বাংলাদেশটি নেই। বাংলাদেশ এখন রূপকল্প ২০২১ সালের সূবর্ণ জয়ন্তীতে স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধির উদ্যাপনের জন্য প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১-এ উন্নত বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড : শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই নন, বিশ্বে নারী নেতৃত্বের বিকাশ এবং উন্নয়নের রূপকার হিসেবে তিনি নন্দিত। প্রধানমন্ত্রী নারী নেতৃত্বে সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানজনক ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম স্থানে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ১৫৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এই অগ্রগতির স্বীকৃতি সরূপ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ‘গ্লোবাল সামিট অব উইমেন’ বাংলাদেশসহ এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারী শিক্ষা ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের জন্য এই পুরস্কার দিয়েছে। এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বর্তমান ১৮ জন জাতীয় নারী নেতার মধ্যে অন্যতম হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। নারী জাগরণে এ ভূখণ্ডে কাজ করে গেছেন অনেক মহীয়সী নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নে ইতিহাস সৃষ্টি করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারী রাজনীতিবিদদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে প্রাশিত ‘উইমেন প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড প্রাইম মিনিস্টারস’ নামক বইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারকর্মী রিচার্ড ও ব্রিয়েনের লেখা এই বইয়ে প্রচ্ছদে বিশ্বের আরো ছয় নারী রাষ্ট্রনায়কের পাশাপাশি স্থান পেয়েছেন শেখ হাসিনা। বইটিতে রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহস, ঝুঁকি, প্রজ্ঞা এবং অবদানভিত্তিক সাজানো হয়েছে তার জীবনী।

নারীর ক্ষমতায়নে অনুপম নেতৃত্বের স্বাক্ষর : ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিকভাবেও নারীদের ক্ষমতায়ন করার কাজটি শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ৩০ শতাংশ কোটা সুনির্দিষ্ট করেন। শেখ হাসিনার হাত ধরেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মেয়েদের খেলাধুলার ব্যবস্থা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নারী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাবিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ উপনেতা, হুইপ-স্পিকার, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, কৃষিসহ সংস্থাপন, ডাক-টেলিযোগাযোগ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ বড় বড় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্বই শুধু নয়, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর, এসএসএফ, সচিব পদসহ সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বহু প্রতিষ্ঠানের গুরুদায়িত্বে নারীদের আসীন করে যে নারী ক্ষমতায়নের যে দ্বার উন্মোচন করেছেন, তা বাংলাদেশের পূর্ববর্তী কোনো সরকারই দাবি করতে পারবে না। শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম সফলতা হলো বাংলাদেশের নারীরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও জায়গা করে নিয়েছে। পাশাপাশি নারী কূটনীতিক, বিমানের বৈমানিক, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের নারীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত থেকে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখছেন।

সামাজিক এবং মানবোন্নয়নের অনেক সূচকেই বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ বিশ্বের অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন বারবার। মানবসূচক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিস্মিত জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা। পৃথিবীর রাষ্ট্র নায়কদের ইতিহাসে শেখ হাসিনা উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তার হৃদয়ে দেশ ও মানবতার জন্য আত্মত্যাগের স্থান অবারিত। তিনি এখন বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক। উন্নত বাংলাদেশের রূপকার।

উন্নয়নের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে হয়েছিল। তবে সেই রাষ্ট্র গড়ার সময় তিনি পাননি। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে একে একে কর্মসূচি হাতে নেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের অভ্যন্তরে সর্বক্ষেত্রেই এই সময়ে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। যোগাযোগ ক্ষেত্রে সারা দেশের চিত্র পাল্টে গেছে। ঢাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে সব মহাসড়কই চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা সরে যাওয়া সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। রাজধানীতে নতুন নতুন ফ্লাইওভার তৈরি করা হচ্ছে। বাস্তবায়নাধীন রয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প। গড়ে তোলা হয়েছে হাতিরঝিলের মতো দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। দীর্ঘদিন জুলে থাকা সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান। ভারতের সঙ্গে অনিষ্পন্ন ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। যে চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালের ১ আগস্ট রাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় হয়।

ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় ইন্টারনেট ব্যবহারে সহজলভ্যতা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য, দুর্যোগ মোকাবিলা, কৃষি উন্নয়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ, নারীর ক্ষমতায়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রেই সেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এসব উন্নয়ন কর্মসূচি তাকে বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকারে পরিণত করেছে।

লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

উন্নত বাংলাদেশের রূপকার

আপডেট টাইম : ১০:২৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ অক্টোবর ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ১৯৭১ স্বাধীনতা লাভের পর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জাতির মননে স্বনির্ভরতার চেতনায় যে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের এক জঘন্য নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেই স্বপ্নের অবসান হয়। তারপর থেকে উল্টোপথে হেঁটেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পথ দেখানো বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শচ্যুত সেই বাংলাদেশের যাত্রাকাল ২১ বছরের মাথায় ক্ষমতাসীন হয় বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে শুরু হয় পথ হারানো বাংলাদেশের সঠিক পথে আসার পালা। দীর্ঘ ২১ বছরের কণ্টকাকীর্ণ রাজনীতির ধূম্রজাল থেকে দেশকে আলোকিত পথের দিশা দেখানোর কাজটি সুকঠিন ছিল বৈকি। তবু অনড় ছিলেন অদম্য সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেই পিতা বঙ্গবন্ধুর গড়ে তোলা দলটির হাল ধরেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অস্থিরতা আর জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তিনি চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ, হাট-ঘাট-মাঠ। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ছুটে গেছেন দেশের জনগণের কাছে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, স্বপ্ন আর প্রত্যাশার কথাগুলো খুব কাছে গিয়ে শুনেছেন। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রীতি ভালোবাসায় ধন্য হয়ে তিনি রচনা করেছেন উন্নত এক বাংলাদেশের রূপকল্প। ২০০৮ সালটি যেন বাংলাদেশের ভাগ্যচক্রে আশার আলো নিয়ে আসে। দূরদর্শী নেত্রী শেখ হাসিনা পিতার মতো ঠিক ধরতে পেরেছেন বাঙালি জাতির সাঁইকি। তাই তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বীজ বুনে দিতে সক্ষম হন বাংলাদেশের জনগণের মানসপটে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকরের সাহসী উদ্যোগ তরুণসমাজের চেতনার স্ফুরণ ঘটায়। কেননা, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যকর হবে—এটা নিছক একটা দুঃস্বপ্ন ছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী চিন্তা-চেতনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব ষড়যন্ত্র, বাধা অতিক্রম করে বিচার কার্যকর করে বিশ্বে অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেন। জঙ্গিবাদ নির্মূলে শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ জিরো টলারেন্স এবং সুদৃঢ় অবস্থান বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের অন্যতম একটি কারণ। এজন্য তিনি জীবনবাজি রেখেছেন। নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছেন দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি। দেশীয় এবং বিশ্ব ষড়যন্ত্রকে তিনি দূরদর্শিতা ও সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করে নেতৃত্বের অনুপম আদর্শিক স্থান দখল করে নিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি সাহসিকতা, উদারতা এবং মানবিকতার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্বনেতৃত্বের সমীহ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল স্থাপন, ১০০টি স্থানে ইকনোমিক জোন, সমুদ্র বিজয় ও সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগানো, রেলের উন্নয়ন ও রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো নির্মাণ, নারীর ক্ষমতায়নে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন, স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মাতৃ মৃত্যুর হার কমানো, গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাদ্য ঘাটতির দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ফরেন রিজার্ভ বৃদ্ধি, রফতানি খাত ও আয় বৃদ্ধি, তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল বিপ্লব প্রভৃতি কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে দেশকে তিনি স্বল্প সময়ে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার নেতৃত্বে দূরদর্শিতার স্বীকৃতি ও প্রশংসায় অভিষিক্ত হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ এখন আর সেই বাংলাদেশটি নেই। বাংলাদেশ এখন রূপকল্প ২০২১ সালের সূবর্ণ জয়ন্তীতে স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধির উদ্যাপনের জন্য প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১-এ উন্নত বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড : শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই নন, বিশ্বে নারী নেতৃত্বের বিকাশ এবং উন্নয়নের রূপকার হিসেবে তিনি নন্দিত। প্রধানমন্ত্রী নারী নেতৃত্বে সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানজনক ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম স্থানে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ১৫৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এই অগ্রগতির স্বীকৃতি সরূপ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ‘গ্লোবাল সামিট অব উইমেন’ বাংলাদেশসহ এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারী শিক্ষা ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের জন্য এই পুরস্কার দিয়েছে। এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বর্তমান ১৮ জন জাতীয় নারী নেতার মধ্যে অন্যতম হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। নারী জাগরণে এ ভূখণ্ডে কাজ করে গেছেন অনেক মহীয়সী নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নে ইতিহাস সৃষ্টি করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারী রাজনীতিবিদদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে প্রাশিত ‘উইমেন প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড প্রাইম মিনিস্টারস’ নামক বইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারকর্মী রিচার্ড ও ব্রিয়েনের লেখা এই বইয়ে প্রচ্ছদে বিশ্বের আরো ছয় নারী রাষ্ট্রনায়কের পাশাপাশি স্থান পেয়েছেন শেখ হাসিনা। বইটিতে রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহস, ঝুঁকি, প্রজ্ঞা এবং অবদানভিত্তিক সাজানো হয়েছে তার জীবনী।

নারীর ক্ষমতায়নে অনুপম নেতৃত্বের স্বাক্ষর : ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিকভাবেও নারীদের ক্ষমতায়ন করার কাজটি শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ৩০ শতাংশ কোটা সুনির্দিষ্ট করেন। শেখ হাসিনার হাত ধরেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মেয়েদের খেলাধুলার ব্যবস্থা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নারী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাবিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ উপনেতা, হুইপ-স্পিকার, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, কৃষিসহ সংস্থাপন, ডাক-টেলিযোগাযোগ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ বড় বড় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্বই শুধু নয়, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর, এসএসএফ, সচিব পদসহ সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বহু প্রতিষ্ঠানের গুরুদায়িত্বে নারীদের আসীন করে যে নারী ক্ষমতায়নের যে দ্বার উন্মোচন করেছেন, তা বাংলাদেশের পূর্ববর্তী কোনো সরকারই দাবি করতে পারবে না। শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম সফলতা হলো বাংলাদেশের নারীরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও জায়গা করে নিয়েছে। পাশাপাশি নারী কূটনীতিক, বিমানের বৈমানিক, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের নারীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত থেকে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখছেন।

সামাজিক এবং মানবোন্নয়নের অনেক সূচকেই বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ বিশ্বের অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন বারবার। মানবসূচক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিস্মিত জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা। পৃথিবীর রাষ্ট্র নায়কদের ইতিহাসে শেখ হাসিনা উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তার হৃদয়ে দেশ ও মানবতার জন্য আত্মত্যাগের স্থান অবারিত। তিনি এখন বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক। উন্নত বাংলাদেশের রূপকার।

উন্নয়নের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে হয়েছিল। তবে সেই রাষ্ট্র গড়ার সময় তিনি পাননি। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে একে একে কর্মসূচি হাতে নেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের অভ্যন্তরে সর্বক্ষেত্রেই এই সময়ে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। যোগাযোগ ক্ষেত্রে সারা দেশের চিত্র পাল্টে গেছে। ঢাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে সব মহাসড়কই চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা সরে যাওয়া সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। রাজধানীতে নতুন নতুন ফ্লাইওভার তৈরি করা হচ্ছে। বাস্তবায়নাধীন রয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প। গড়ে তোলা হয়েছে হাতিরঝিলের মতো দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। দীর্ঘদিন জুলে থাকা সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান। ভারতের সঙ্গে অনিষ্পন্ন ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। যে চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালের ১ আগস্ট রাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় হয়।

ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় ইন্টারনেট ব্যবহারে সহজলভ্যতা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য, দুর্যোগ মোকাবিলা, কৃষি উন্নয়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ, নারীর ক্ষমতায়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রেই সেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এসব উন্নয়ন কর্মসূচি তাকে বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকারে পরিণত করেছে।

লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক