বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সৃষ্টিগত কারণে মানুষ সুখের কাঙাল। নিজের সুখের জন্য সে যেন সবকিছুকে বিসর্জন দিতে পারে। সুখের অন্বেষণ একটি মোহ বা নেশা। যে নেশা একটি জীবনকে শেষপ্রান্তে নিয়ে ব্যর্থ করে ছাড়ে। ধরুন, একজন বিপুল সম্পদের মালিক। তার উপার্জিত অর্র্থ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। কিন্তু অঢেল খাবার সজ্জিত টেবিলে তার যেন সবকিছুতে নিষেধ। এটি তার সুখের অন্তরায়। কারণ তার মাঝে স্বস্তি নাই। আবার কারো গাড়ি, বাড়ি, টাকাকড়ির অভাব নাই কিন্তু তিনি সন্তানহীন অথবা তার সন্তান বিপথগামী—এমন ব্যক্তির জীবনে টাকার সুখ থাকলেও শান্তি আর স্বস্তি নেই। গবেষণা বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষও দিনের ২৪ ঘণ্টা সুখী থাকেন না। সুখী মানুষের জীবনেও হতাশা, দুঃখ-কষ্ট আসে। ব্যতিক্রম হলো সুখী মানুষরা হতাশা, দুঃখ-কষ্টকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন, যা অন্যরা পারেন না।
সুসম্পর্ক মানুষকে সুখী থাকতে সাহায্য করে। যারা সমাজে নানা রকম মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রেখে চলেন, তারা অন্যদের তুলনায় আরো সুখী ও সুস্থ থাকেন। এমনকি সুসম্পর্কময় মানুষের দীর্ঘজীবী হন। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ও ভালোবাসা মানুষের মাঝে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। মনে রাখা দরকার, জীবনটা শুধু নিজের জন্য নয়। নিজে ভালো থাকতে হলে চারপাশকে নিয়ে ভালো থাকার মধ্যে জীবনের অন্তর্নিহিত সার্থকতা লুকিয়ে রয়েছে। মানুষ জীবনে সুখ আহরণের জন্য অকাতরে কত সুখ বিসর্জন দেয়? সে শরীর ও মনে সুখ-স্বস্তিকে পরিত্যাগ করে সুখের পেছনে দৌড়ায়। সে বাবা-মা, ভাই-বোন, পরিজনের মায়া ছিন্ন করে সুখের পেছনে দৌড়ায়। জীবনে সুখের জন্য সে যেভাবেই হোক, ধন আহরণ করে। আর ধন আহরণ করতে গিয়ে সে অনেক অনৈতিক পথ বেছে নেয়। অসংখ্য মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নেয় নিজের সুখের জন্য। সে স্ত্রী সন্তানের জন্য, প্রজন্মের পর প্রজন্মের বিলাসিতার জন্য আরো আরো সম্পদ আহরণের নেশায় নিজের মজ্জাগত সুখ, শান্তি ও স্বস্তির সবটুকু বিসর্জন দেয়। এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে অবশেষে সে একাকী হয়ে যায়। তার অঢেল সম্পদ জীবন বাঁচাতে পারে না। টাকা, বাড়ি, গাড়ি- সন্তানকে মানুষ করতে পারে না। সম্পদ নিয়ে হয় সন্তানের কর্তৃত্বের কাড়াকাড়ি। অথবা সম্পদ হয়ে পড়ে অনিরাপদ। এ সম্পদ আহরণই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। জীবন শেষে সে জীবনের স্বস্তি খুঁজে বেড়ায় কখনোবা একাকী জীবনে অথবা অবহেলিত বৃদ্ধাশ্রমে! এই কি তবে সুখ আহরণের পরিণতি!
আমরা ভুলে যাই যে, সুস্থতাই হচ্ছে মানুষের জীবনের সুখের প্রথম ও শেষ নেয়ামক। তাই প্রতিদিন শপথ নিন—আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। এ জন্য মহান প্রতিপালকের কাছে শুকরিয়া জানাই। শুকরিয়া জানাই, কারণ আমার প্রতিপালক আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে অনন্য অসাধারণ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আমরা আশরাফুল মাখলুখাত—সৃষ্টিকুলের সেরা জীব। এটি আমার প্রথম পরিচয়। তারপর ধর্ম, বর্ণ, গোত্র। দরিদ্র দেশের গ্রামের কুঁড়ে ঘরে নাকি উন্নত দেশের বিলাসবহুল অট্টালিকায় জন্মেছি, সেটা আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। আমাদের বিশ্বাস সব মানুষের আত্মমর্যাদা আছে তার মৌলিক সাম্যতার মধ্যে। পৃথিবীর সব মানুষই শান্তি চায়। তার পরও কেন এত অশান্তির হুলিখেলা এ জগতময়। লোভ, হিংসা আর অপ্রয়োজনীয় প্রতিপত্তির অসম প্রতিযোগিতায় আমরা জীবনের মাহাত্ম্য কি ভুলে গেছি। এটাই অশান্তির কারণ।
আমরা কি কখনো ভাবি—অসাধারণ সুন্দর এক পৃথিবীর বাসিন্দা আমরা। আমাদের কর্ম দিয়ে কেন সুন্দর পৃথিবীকে অযথাই কুলষিত করছি। সবাই এক মানব সম্প্রদায়েরই অংশ। সমতার পৃথিবী গড়ার জন্য সবাই সবার সহযোগী হব। এই মনোভাব পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে একই রকম। জীবনের সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকারোক্তি হিসেবে, সদা বিনয়ী হব। সৃষ্টির সৌন্দর্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্বশীল হব। ব্যক্তি জীবনে, পরিবারে, রাষ্ট্রের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ থেকে ভূমিকা পালন করব।
আমরা মানুষ এবং আমরাই শ্রেষ্ঠ—এই শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই এ বাক্য ঘোষণা করেছেন। অতএব আমরা এমন কিছু করব না, যাতে আমার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি অসম্মান করা হয়। আমাদের মাঝে অনন্য, অসাধারণ ক্ষমতা দিয়েছেন আমাদের প্রভু। তাই মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকব। শরীর ও মনের সর্বোত্তম ব্যবহার করব। আমরা চিরজীবী নই—তাই এমন ভোগ বিলাসিতার চিন্তা করব না, যাতে অপরের অধিকার খর্ব হয়। জীবনটা একটা লড়াইয়ের ক্ষেত্র—এ লড়াইয়ে জয়লাভ করার বা টিকে থাকার জন্য সদা সবার জন্য নিরাপদ ও সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন করব। জীবনেরও সমাপ্তি আছে—তাই, হিসাবেরও প্রয়োজন আছে।
আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে ঋণী। পরিবারের কাছে ঋণী। এরপর সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে ঋণী। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই ঋণ আদায়ে কিছু না কিছু করব। এর জন্য প্রথম কাজ হবে ভালো ব্যবহার করা। বিনয় প্রদর্শন করা। সহযোগী মনোভাব নিয়ে কাজ করা। সততার সঙ্গে কাজ করা। বিশ্বাস ভঙ্গ না করা। সত্য কথা বলা। দান করা। প্রতিদিন—ছোট ছোট হলেও, একটি করে হলেও ভালো কাজ করার চেষ্টা করব। ব্যক্তিজীবনে স্থিরতা ও শালীনতা আনব। পারিবারিক শান্তি রক্ষায় ভূমিকা রাখব। পরিবারের প্রতি সর্বোত্তম দায়িত্ব পালন করব। সদাচারণের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখব। অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। মন্দকে ভালো পথে আনার চেষ্টা করব। সব সময় ভালো চিন্তা করব। অন্যকে সৎ পরামর্শ দেব। কারো দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াব। ভালো স্বপ্ন দেখব—আশা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করব। কারণ সবাই মিলে ভালো না থাকলে, শ্রেষ্ঠত্বে মর্যাদা ও জীবনের আনন্দ পাওয়া যাবে না।
লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট