ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরে ধান পরিমাপে শুভংকরের ফাঁকি : ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক

পাহাড়ী জনপদকে তাঁদের সরলতার সুযোগে উৎপাদিত পণ্যে দামে ও ওজনে ঠকানো হতো বলে শুনেছি। সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ সহয়তায় তাঁরা শিক্ষা দীক্ষায় প্রভূত উন্নত হওয়ায় সেখানে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। পাহাড়ি জনতাকে এখন আর ঠকানো বা প্রতারণা করা সহজ নয়। সংগঠিত হয়ে তাঁরা পাই পাই করে হিসাব চেয়ে এখন অনেক কিছুই আদায় করে নিচ্ছে। কিন্তু হাওর এলাকায় বইছে উল্টো স্রোত। একবিংশ শতাব্দির আলোকিত সময়েও হাওর অঞ্চল তিমির থেকে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করছে।

অসংগঠিত হাওরবাসি ন্যায় সংগত অধিকার হতে বঞ্চিত; বহুমূখী সমস্যা, ভোগান্তি ও প্রতারণা তাঁদের নিত্য সঙ্গী । শুধু ধান, মৎস্য ও পাথর সম্পদ দিয়ে হাওর জাতীয় অর্থনীতিতে যে যোগান দেয় তার কিয়দাংশ হাওর উন্নয়নে ব্যবহার করলে এতো দিনে কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। এত দিনের বঞ্চণার গ্যাপ পূরণে বর্তমানে বেশী বরাদ্দের দাবী রাখে। বাংলার পাট সম্পদ দিয়ে যেমন ‘ইসলামাবাদ’ তৈরী বাঙালী মেনে নেয়নি, তেমনি হাওরকে বঞ্চিত করে হাওরের ধান, মৎস্য ও পাথর সম্পদ বেশী দিন ব্যবহার করা যাবে না । সকল দ্রোহের মূলে রয়েছে বঞ্চনা, অবজ্ঞা আর অবহেলা। আমাদের মনে রাখা উচিত শক্তির পরিমাপ হয় নেগেটিভ ধবংত্নক ক্ষমতা দিয়ে।

ছবিঃ বি: আলীমুজ্জামান রনী

বাংলার শস্য ভান্ডার হচ্ছে হাওর-ভাটি অঞ্চল। কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, মেীলভীবাজার, সিলেট ও বি.বাড়ীয়া জেলা নিয়ে গঠিত প্রায় পাঁচ হাজার বর্গ মাইল আয়তনের হাওর এলাকায় প্রায় দুই কোটি লোক বাস করে। হাওরে একটি মাত্র ফসল-ধান চাষ হয়। দেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ ধান এ হাওর এলাকায় উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত ধানের মাত্র এক দশমাংশ ধান হাওরে ব্যবহৃত হয়। বাকী সব ধান দেশের অন্যত্র, হাওর এলাকার বাহরে সরবরাহ হয়ে থাকে। শুকনা সময়ে উৎপাদিত ধান সারা বর্ষায় জুড়ে বেপারি নৌকায় করে দেশ ব্যাপী সরবরাহ হয়। হাওর অঞ্চলে নেই বড় কোন গুদাম ও চাতাল। ফলে, বড় বড় ধানের বেপারি নৌকা, আইত্ল্ল্যা নৌকা, লঞ্চ. কার্গো ভরে হাজার হাজার মন ধান আশুগঞ্জ, ভৈরব, মদনগঞ্জ, সিলেটে চলে যায়। এ ধান চাল হয়ে ছড়িয়ে পরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, কিছু অংশ ভ্যালু এড্ হয়ে হাওরে ফিরে আসে, আসা-যাওয়ার দ্বিমূখী খরচ যোগ হয়ে চাল বিক্রি হয় অধিক দামে। ধান বিক্রি ও চাল কেনা, এ দুই সময়ই কৃষক  ‘শাখের করাত’র মতো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দামে কম দেয়া এবং ওজনে বেশী নেয়া, হাওর এলাকার কৃষকের ললাটের লিখন, একটি নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাওর অঞ্চলে ধান ক্রয় বিক্রয়ে এখনো মান্ধাতার আমলের হাতে মাপা দাঁড়ি পাল্লা ব্যবহৃত হয়। কেনার সময় সের এবং বিক্রির সময় কেজি ওজনের পাথর ব্যবহর করা হয়। পাঁচ সের করে ওজনের পাথর দিয়ে হাতে মাপা বিশেষ ভাবে তৈরী নিক্তি দিয়ে ধান মাপা হয়। এ ধান ক্রয়ের সাথে জড়িত এক শ্রেণীর দালাল যারা, স্থানীয়ভাবে ”কইয়াল” বা ’দলাল’ নামে পরিচিত তারা তাদের পাথর ব্যবহার করে। অর্ডার দিয়ে নাকি তারা এ পাথর কিনে/ তৈরী করে আনে। এ পাথরের ছিদ্রে ঝালাই দিয়ে লোহা বা শীসা সংযুক্তি করে ওজন বাড়ানো হয়। এ নিক্তিটি একটি কাঠের তৈরী কাঠির ভিতর দিয়ে রশি বা দড়ি প্রবেশ করিয়ে পাল্লার সাথে বেঁধে তৈরী করা হয়। এ কাঠিটিকে ’ডান্ডা’ বলে। পাল্লায় সংযুক্ত রশির বা দড়ির ভিতর দিয়ে লোহার রিঙ পড়ানো থাকে। ধান মাপার সময় “কইয়াল” এ রিঙ বা রশি/দড়ি হাতের মুটিতে ধরে/চাপ দিয়ে ডান্ডা এদিক ওদিক করে অতি সহজেই মাপার ওজনে হের-ফের করতে পারে।

কইয়াল’রা ধান মাপতে এক ধরণের বিশেষ গণনা রীতি ব্যবহার করে। দেশের আর কোথাও এ ধরণের গণনা রীতির প্রচলন নাই। সাধারণ গণনা হতে এ গণনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাধারণ মানুষের পক্ষ্যে এ গণনা বুঝা বেশ কষ্টকর। নাক্কা সুরে/গলায় ঘ্যান ঘ্যান করে একই সংখ্যা/ কথা বার বার বলে, প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে একটা ধুম্র্যজালের আবহ সৃষ্টি করে। কোন সংখ্যাই তারা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে না। যেমন “লাভে রে লাভ” মানে এক, “নাইশা’ মানে উনিশ, “উইনচা” মানে উনচল্লিশ। প্রত্যেকটা সংখ্যার একটা বিকৃত রূপ সৃষ্টি করে নাক্কা সুরে জোরে জোরে বার বার তা উচ্চারণ/ধ্বনি, প্রতিধ্বনি করে। “উইনচা” থেকে সহজেই “নাইশা” তে ফিরে আসে। তাদের ভ্যালকি বাজিতে কার বাপের সাধ্য তার সবগুলো গণনা বুঝা। হাওরবাসি সহজ সরল মানুষদের পক্ষে তো নয়ই। বিশেষ ধরণের সুরের তালে তালে তারা পাল্লায় ঝাঁকি/ ধাক্কা দিয়ে ছন্দে ছন্দে ঢেউ তুলে ধান ভর্তি বেত বা বাঁশের তৈরী পাত্রটি বস্তায় ছুড়ে ফেলে। কোন কোন সময় এক পাল্লায় এক কেজি ধান অতিরিক্ত বেশী নেয়া তাদের পক্ষে কোন ব্যাপারই না। ওজনে বেশী পরিমাণ ধান নেয়ার জন্য তাঁরা বেশী দাম দেয়ার প্রলোভণও দেখায়। মণ করা ১০ টাকা বেশী দাম দিলেও অতিরিক্ত ধান নিয়ে যায় হয়তো ১০০ টাকার।

এক বস্তায় সাধারণত ৮ পাল্লা বা এক মণ ধান ভরা হয়। এক তালে “কইয়াল” চল্লিশ পাল্লা বা পাঁচ মণ ধান মাপে। একে এক “চাইল্লা” বলে। এক “চাইল্লা ধান” মাপার পর দৃশ্যমান ভাবেই তারা কেজি খানেক ধান অতিরিক্ত নিয়ে থাকে। অনেক সময় ’চাইল্লা’ ছেড়ে দেয়া তো তাদের জন্য ডাল ভাত। পাল্লার “আয় ফের” বা “ব্যয় ফের”  এর হাতিয়ার তারা সচেতনভাবে ব্যবহার করে। বেপারির সাথে ’কইয়াল’ এর দৃশ্যমান চুক্তি হচ্ছে-এক মণ ধান মাপ্লে বেপারি কইয়াল’কে দশ টাকা দেবেন। তবে শর্ত হচ্ছে ওজনে কারচুপি করে বা গনণায় ছলনা করে শতকরা কমপক্ষে ১০-১৫ মণ ধান বেশী দিতে হবে। বেশী পরিমাণ ধান দিতে পারলে ’কইয়ালি’র টাকার পরিমাণও বাড়ে। কোন বেপারিই “কইয়াল” এর সহায়তা ছাড়া সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে না। অনেক সময় কৃষকও ’কইয়াল’ কে উল্টো টাকা দিয়ে থাকে যেন সঠিক মাপটি মাপে। কিন্তু চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। দু’পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিলেও সে তো বেপারির স্বার্থটাই বড় করে দেখে। কারণ, বেপারি তার নিত্য কাষ্টমার। এ পদ্ধতিতে ’মইয়াল’ থেকে বেশী দামে ধান কিনে ’আড়ত’ এ কম দামে বিক্রি করলেও বেপারির লাভ থাকে, ওজণের মারপ্যাচে। সেলুক্যাস! বৈচিত্রে ভরা আমার এ স্বদেশ।

শত শত মণ ধান মাপলেও কইয়াল/বেপারিগণ বড় কোন কাটা নিক্তি/দাড়ি পাল্লা ব্যবহার করে না। কষ্ট ও বিরক্তিকর, সহজভাবে কারচুপি/ফাঁকি দেয়া পাঁচ সের ওজনের নিষিদ্ধ ঘোষিত পাল্লা ব্যবহার করে। কিন্তু বর্তমান প্রচলিত আইনে এ ধরণের নিক্তি ও সের ওজনের পাথর ব্যবহার করা দণ্ডণীয় অপরাধ। কে শুনে কার কথা। এ ধরণের ওজন ও নিক্তি ব্যবহার যে নিষিদ্ধ এ কথাটিও তাঁরা জানে না। কোনটি আইন, বা কি তাঁদের অধিকার সে সম্পর্কেও তারা অজ্ঞ। অবহেলায় জর্জরিত হয়ে তাঁরা বোধ শক্তি বা আমিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কোন প্রচারণা বা সচেতনামূলক কার্যক্রম হাওর এলাকায় পরিলক্ষিত হয় না। আল্লাহর ওয়াস্তে তাঁরা শুধু বেঁচে আছেন। হাওর এলাকার দোকান, বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। তারা দু’ধরণের ওজন পাথরই রাখে। সময় মতো অবস্থা বুঝে তা প্রয়োগ করে। অনেক দোকানে ওজন পাথর ঘষে ঘষে বা খুচিয়ে ক্ষয় করে, যাতে মাপে কম দেয়া যায়। এখন পাহাড়ি এলাকা থেকেও দুর্গম, বন্ধুর, অবহেলিত হচ্ছে আমার হাওর এলাকা। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষধ আর অনিয়ম, ফাকি দেয়ার স্বর্গ রাজ্যের বাগারে পরিণত হয়েছে হাওর এলাকা। ফলে সরকারের কোন সংস্থাই সেখানে যেতে উৎসাহবোধ করে না। কোন তদারকি নাই। পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে কর্মকর্তাগণ গড় হাজির নিত্যমৈত্তিক ঘটনা। পাহাড়ি এলাকা থেকেও বন্ধুর, অবহেলিত হাওর কর্মকর্তাদের জন্য ’হাওর ভাতা’ প্রচলন নাই। অধিকাংশ অফিস সাপ্তাহিক হাজিরা দিয়ে চলে। ভ্রাম্যমান আদাালত, বা অন্য কোন বিষয়ে নজরদারি ওখানে নাই। বিদেশী বিশেষ সংস্থার আলোকচ্ছ্বটা বা নেক নজর হাওরের উপর পড়ে নাই। বর্তমানে ধানের কম দামে এবং ওজনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে সর্বমূখী বঞ্চণায় পিষ্ট হচ্ছে আমার হাওর কৃষক। বড় কাটা নিক্তি ব্যবহার করলে কারচুপির পরিমাণ অনেক কমে আসবে। এটা বাধ্যতামূলক করা উচিত । আশায় রইলাম হাওরবাসির ’বঞ্চনার দিন শেষ, ঠকার দিন খতম’ এর ?

হাওর ভূমিপুত্র, কৃষি প্রকৌশলী। সার্ক কৃষি কেন্দ্র, ঢাকা।
ফোন: ০১৭২৭ ০৭৪ ৫৮৪
ইমেইলঃ niazpasha@yahoo.com

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরে ধান পরিমাপে শুভংকরের ফাঁকি : ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক

আপডেট টাইম : ০৭:২৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ জুন ২০১৬

পাহাড়ী জনপদকে তাঁদের সরলতার সুযোগে উৎপাদিত পণ্যে দামে ও ওজনে ঠকানো হতো বলে শুনেছি। সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ সহয়তায় তাঁরা শিক্ষা দীক্ষায় প্রভূত উন্নত হওয়ায় সেখানে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। পাহাড়ি জনতাকে এখন আর ঠকানো বা প্রতারণা করা সহজ নয়। সংগঠিত হয়ে তাঁরা পাই পাই করে হিসাব চেয়ে এখন অনেক কিছুই আদায় করে নিচ্ছে। কিন্তু হাওর এলাকায় বইছে উল্টো স্রোত। একবিংশ শতাব্দির আলোকিত সময়েও হাওর অঞ্চল তিমির থেকে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করছে।

অসংগঠিত হাওরবাসি ন্যায় সংগত অধিকার হতে বঞ্চিত; বহুমূখী সমস্যা, ভোগান্তি ও প্রতারণা তাঁদের নিত্য সঙ্গী । শুধু ধান, মৎস্য ও পাথর সম্পদ দিয়ে হাওর জাতীয় অর্থনীতিতে যে যোগান দেয় তার কিয়দাংশ হাওর উন্নয়নে ব্যবহার করলে এতো দিনে কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। এত দিনের বঞ্চণার গ্যাপ পূরণে বর্তমানে বেশী বরাদ্দের দাবী রাখে। বাংলার পাট সম্পদ দিয়ে যেমন ‘ইসলামাবাদ’ তৈরী বাঙালী মেনে নেয়নি, তেমনি হাওরকে বঞ্চিত করে হাওরের ধান, মৎস্য ও পাথর সম্পদ বেশী দিন ব্যবহার করা যাবে না । সকল দ্রোহের মূলে রয়েছে বঞ্চনা, অবজ্ঞা আর অবহেলা। আমাদের মনে রাখা উচিত শক্তির পরিমাপ হয় নেগেটিভ ধবংত্নক ক্ষমতা দিয়ে।

ছবিঃ বি: আলীমুজ্জামান রনী

বাংলার শস্য ভান্ডার হচ্ছে হাওর-ভাটি অঞ্চল। কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, মেীলভীবাজার, সিলেট ও বি.বাড়ীয়া জেলা নিয়ে গঠিত প্রায় পাঁচ হাজার বর্গ মাইল আয়তনের হাওর এলাকায় প্রায় দুই কোটি লোক বাস করে। হাওরে একটি মাত্র ফসল-ধান চাষ হয়। দেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ ধান এ হাওর এলাকায় উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত ধানের মাত্র এক দশমাংশ ধান হাওরে ব্যবহৃত হয়। বাকী সব ধান দেশের অন্যত্র, হাওর এলাকার বাহরে সরবরাহ হয়ে থাকে। শুকনা সময়ে উৎপাদিত ধান সারা বর্ষায় জুড়ে বেপারি নৌকায় করে দেশ ব্যাপী সরবরাহ হয়। হাওর অঞ্চলে নেই বড় কোন গুদাম ও চাতাল। ফলে, বড় বড় ধানের বেপারি নৌকা, আইত্ল্ল্যা নৌকা, লঞ্চ. কার্গো ভরে হাজার হাজার মন ধান আশুগঞ্জ, ভৈরব, মদনগঞ্জ, সিলেটে চলে যায়। এ ধান চাল হয়ে ছড়িয়ে পরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, কিছু অংশ ভ্যালু এড্ হয়ে হাওরে ফিরে আসে, আসা-যাওয়ার দ্বিমূখী খরচ যোগ হয়ে চাল বিক্রি হয় অধিক দামে। ধান বিক্রি ও চাল কেনা, এ দুই সময়ই কৃষক  ‘শাখের করাত’র মতো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দামে কম দেয়া এবং ওজনে বেশী নেয়া, হাওর এলাকার কৃষকের ললাটের লিখন, একটি নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাওর অঞ্চলে ধান ক্রয় বিক্রয়ে এখনো মান্ধাতার আমলের হাতে মাপা দাঁড়ি পাল্লা ব্যবহৃত হয়। কেনার সময় সের এবং বিক্রির সময় কেজি ওজনের পাথর ব্যবহর করা হয়। পাঁচ সের করে ওজনের পাথর দিয়ে হাতে মাপা বিশেষ ভাবে তৈরী নিক্তি দিয়ে ধান মাপা হয়। এ ধান ক্রয়ের সাথে জড়িত এক শ্রেণীর দালাল যারা, স্থানীয়ভাবে ”কইয়াল” বা ’দলাল’ নামে পরিচিত তারা তাদের পাথর ব্যবহার করে। অর্ডার দিয়ে নাকি তারা এ পাথর কিনে/ তৈরী করে আনে। এ পাথরের ছিদ্রে ঝালাই দিয়ে লোহা বা শীসা সংযুক্তি করে ওজন বাড়ানো হয়। এ নিক্তিটি একটি কাঠের তৈরী কাঠির ভিতর দিয়ে রশি বা দড়ি প্রবেশ করিয়ে পাল্লার সাথে বেঁধে তৈরী করা হয়। এ কাঠিটিকে ’ডান্ডা’ বলে। পাল্লায় সংযুক্ত রশির বা দড়ির ভিতর দিয়ে লোহার রিঙ পড়ানো থাকে। ধান মাপার সময় “কইয়াল” এ রিঙ বা রশি/দড়ি হাতের মুটিতে ধরে/চাপ দিয়ে ডান্ডা এদিক ওদিক করে অতি সহজেই মাপার ওজনে হের-ফের করতে পারে।

কইয়াল’রা ধান মাপতে এক ধরণের বিশেষ গণনা রীতি ব্যবহার করে। দেশের আর কোথাও এ ধরণের গণনা রীতির প্রচলন নাই। সাধারণ গণনা হতে এ গণনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাধারণ মানুষের পক্ষ্যে এ গণনা বুঝা বেশ কষ্টকর। নাক্কা সুরে/গলায় ঘ্যান ঘ্যান করে একই সংখ্যা/ কথা বার বার বলে, প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে একটা ধুম্র্যজালের আবহ সৃষ্টি করে। কোন সংখ্যাই তারা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে না। যেমন “লাভে রে লাভ” মানে এক, “নাইশা’ মানে উনিশ, “উইনচা” মানে উনচল্লিশ। প্রত্যেকটা সংখ্যার একটা বিকৃত রূপ সৃষ্টি করে নাক্কা সুরে জোরে জোরে বার বার তা উচ্চারণ/ধ্বনি, প্রতিধ্বনি করে। “উইনচা” থেকে সহজেই “নাইশা” তে ফিরে আসে। তাদের ভ্যালকি বাজিতে কার বাপের সাধ্য তার সবগুলো গণনা বুঝা। হাওরবাসি সহজ সরল মানুষদের পক্ষে তো নয়ই। বিশেষ ধরণের সুরের তালে তালে তারা পাল্লায় ঝাঁকি/ ধাক্কা দিয়ে ছন্দে ছন্দে ঢেউ তুলে ধান ভর্তি বেত বা বাঁশের তৈরী পাত্রটি বস্তায় ছুড়ে ফেলে। কোন কোন সময় এক পাল্লায় এক কেজি ধান অতিরিক্ত বেশী নেয়া তাদের পক্ষে কোন ব্যাপারই না। ওজনে বেশী পরিমাণ ধান নেয়ার জন্য তাঁরা বেশী দাম দেয়ার প্রলোভণও দেখায়। মণ করা ১০ টাকা বেশী দাম দিলেও অতিরিক্ত ধান নিয়ে যায় হয়তো ১০০ টাকার।

এক বস্তায় সাধারণত ৮ পাল্লা বা এক মণ ধান ভরা হয়। এক তালে “কইয়াল” চল্লিশ পাল্লা বা পাঁচ মণ ধান মাপে। একে এক “চাইল্লা” বলে। এক “চাইল্লা ধান” মাপার পর দৃশ্যমান ভাবেই তারা কেজি খানেক ধান অতিরিক্ত নিয়ে থাকে। অনেক সময় ’চাইল্লা’ ছেড়ে দেয়া তো তাদের জন্য ডাল ভাত। পাল্লার “আয় ফের” বা “ব্যয় ফের”  এর হাতিয়ার তারা সচেতনভাবে ব্যবহার করে। বেপারির সাথে ’কইয়াল’ এর দৃশ্যমান চুক্তি হচ্ছে-এক মণ ধান মাপ্লে বেপারি কইয়াল’কে দশ টাকা দেবেন। তবে শর্ত হচ্ছে ওজনে কারচুপি করে বা গনণায় ছলনা করে শতকরা কমপক্ষে ১০-১৫ মণ ধান বেশী দিতে হবে। বেশী পরিমাণ ধান দিতে পারলে ’কইয়ালি’র টাকার পরিমাণও বাড়ে। কোন বেপারিই “কইয়াল” এর সহায়তা ছাড়া সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে না। অনেক সময় কৃষকও ’কইয়াল’ কে উল্টো টাকা দিয়ে থাকে যেন সঠিক মাপটি মাপে। কিন্তু চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। দু’পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিলেও সে তো বেপারির স্বার্থটাই বড় করে দেখে। কারণ, বেপারি তার নিত্য কাষ্টমার। এ পদ্ধতিতে ’মইয়াল’ থেকে বেশী দামে ধান কিনে ’আড়ত’ এ কম দামে বিক্রি করলেও বেপারির লাভ থাকে, ওজণের মারপ্যাচে। সেলুক্যাস! বৈচিত্রে ভরা আমার এ স্বদেশ।

শত শত মণ ধান মাপলেও কইয়াল/বেপারিগণ বড় কোন কাটা নিক্তি/দাড়ি পাল্লা ব্যবহার করে না। কষ্ট ও বিরক্তিকর, সহজভাবে কারচুপি/ফাঁকি দেয়া পাঁচ সের ওজনের নিষিদ্ধ ঘোষিত পাল্লা ব্যবহার করে। কিন্তু বর্তমান প্রচলিত আইনে এ ধরণের নিক্তি ও সের ওজনের পাথর ব্যবহার করা দণ্ডণীয় অপরাধ। কে শুনে কার কথা। এ ধরণের ওজন ও নিক্তি ব্যবহার যে নিষিদ্ধ এ কথাটিও তাঁরা জানে না। কোনটি আইন, বা কি তাঁদের অধিকার সে সম্পর্কেও তারা অজ্ঞ। অবহেলায় জর্জরিত হয়ে তাঁরা বোধ শক্তি বা আমিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কোন প্রচারণা বা সচেতনামূলক কার্যক্রম হাওর এলাকায় পরিলক্ষিত হয় না। আল্লাহর ওয়াস্তে তাঁরা শুধু বেঁচে আছেন। হাওর এলাকার দোকান, বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। তারা দু’ধরণের ওজন পাথরই রাখে। সময় মতো অবস্থা বুঝে তা প্রয়োগ করে। অনেক দোকানে ওজন পাথর ঘষে ঘষে বা খুচিয়ে ক্ষয় করে, যাতে মাপে কম দেয়া যায়। এখন পাহাড়ি এলাকা থেকেও দুর্গম, বন্ধুর, অবহেলিত হচ্ছে আমার হাওর এলাকা। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষধ আর অনিয়ম, ফাকি দেয়ার স্বর্গ রাজ্যের বাগারে পরিণত হয়েছে হাওর এলাকা। ফলে সরকারের কোন সংস্থাই সেখানে যেতে উৎসাহবোধ করে না। কোন তদারকি নাই। পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে কর্মকর্তাগণ গড় হাজির নিত্যমৈত্তিক ঘটনা। পাহাড়ি এলাকা থেকেও বন্ধুর, অবহেলিত হাওর কর্মকর্তাদের জন্য ’হাওর ভাতা’ প্রচলন নাই। অধিকাংশ অফিস সাপ্তাহিক হাজিরা দিয়ে চলে। ভ্রাম্যমান আদাালত, বা অন্য কোন বিষয়ে নজরদারি ওখানে নাই। বিদেশী বিশেষ সংস্থার আলোকচ্ছ্বটা বা নেক নজর হাওরের উপর পড়ে নাই। বর্তমানে ধানের কম দামে এবং ওজনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে সর্বমূখী বঞ্চণায় পিষ্ট হচ্ছে আমার হাওর কৃষক। বড় কাটা নিক্তি ব্যবহার করলে কারচুপির পরিমাণ অনেক কমে আসবে। এটা বাধ্যতামূলক করা উচিত । আশায় রইলাম হাওরবাসির ’বঞ্চনার দিন শেষ, ঠকার দিন খতম’ এর ?

হাওর ভূমিপুত্র, কৃষি প্রকৌশলী। সার্ক কৃষি কেন্দ্র, ঢাকা।
ফোন: ০১৭২৭ ০৭৪ ৫৮৪
ইমেইলঃ niazpasha@yahoo.com