বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ রাজধানীর রায়েরবাজার কবর স্থানের এই ব্লকটি নির্ধারণ করা হয়েছে করোনায় মৃত্যুবরণ করা রোগীদের জন্য। চারদিকে লাল মাটি। সারি বাঁধা কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে আগে থেকেই। গোর খোদকরা জানেন না কোন কবরে কখন কে শায়িত হবেন। তবে তারা নিশ্চিত দিনে অন্তত ২০ জনের লাশ আসবে। তাই আগে থেকেই তাদের দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন গোর খোদকরা। সকাল থেকেই একটির পর একটি লাশ দাফনে ব্যস্ত তারা।
সেইসঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটছে কবর পরিচর্যাকারীদেরও। একটি লাশের কাজ শেষ হতে না হতেই এসে হাজির আরেকটি লাশ। একটু স্বস্তি নেই তাদের। কোদাল চলছেই। গত কয়েকদিন ধরে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় ‘অগ্রিম’ কবর খুঁড়ে রাখতে হচ্ছে বলে জানান তারা। প্রতিটি কবরে রয়েছে সিরিয়াল নম্বর। কবর খোঁড়ার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা (গোর খোদক) জানান, এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ জনকে সমাহিত করতে হয়। কিছুদিন আগেও দিনে এক থেকে দুইজনের লাশ আসতো দাফনের জন্য।
সকাল সাড়ে ন’টার দিকে করোনা ব্লকের একটি কবরের পরিচর্চা করছিলেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বছরখানেক ধরে গোর খোদকের কাজও করছেন। তিনি বলেন, ইদানীং করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগী বেড়েছে। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত দাফন করা হয়। একদিন ২০ জনও দাফন করেছিলাম। প্রতিদিন আমরা ১২ থেকে ১৫টা কবর খুঁড়ে রাখি। কখন রোগীর চাপ বাড়ে তার ঠিক নাই। কিছুদিন আগেও রোগীর চাপ ছিল না। এখন অগ্রিম কবর খুঁড়ে রাখা লাগে।
তিনি বলেন, কখনো আগে খুঁড়ে রাখার পরেও আবার কবর খোঁড়া লাগে। আবার দু’-একদিন কবর ফাঁকাও থাকে। একটা কবর খুঁড়তে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। এরজন্য কবর খুঁড়ে রাখা হয়। তিনি বলেন, আগে কবর খোঁড়ার লোক ছিল কম। আমিই এক বছর ধরে কবর খুঁড়ি। এরজন্য কেউ ৫০০ টাকা আবার কেউ এক, দুই হাজার টাকাও দেয়।
ওই ব্লকেই দাঁড়িয়েছিল একটি এম্বুলেন্স। মোহাম্মদপুর নিবাসী আব্দুস সালামের লাশ দাফন করছিলেন স্বজনরা। একসঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছিলেন পাঁচ থেকে ছয়জন গোর খোদক। লাশ কবরে নামিয়ে মাটি দিচ্ছিলেন। এরই মাঝে আরো একটি এম্বুলেন্স আসে। কবরের দায়িত্বে থাকা মো. মতিন মিয়া এগিয়ে যান। দেখলেন কবরের অনুমতিপত্র। তারপর শুরু হয় ওই লাশটি দাফনের প্রস্তুতি। এক হাজার ১৪০ নম্বর কবরের কাজ শেষ হতেই গাছের ছায়ায় বসে পড়েন গোর খোদকরা। ছয়জন কোদাল পাশে রেখে বিশ্রাম নিতে থাকেন। মতিন মিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যান তিনজন। বাকি তিনজন সেখানেই বিশ্রাম নিতে থাকেন।
অপেক্ষা এক হাজার ১৪১ নম্বর কবরে দাফনের। লাশের সঙ্গে এসেছেন ছয় জন স্বজন। দাফন করা হয় হাবিবুর রহমান বাদলের লাশ। তার বোনের ছেলে বলেন, আমার মা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৪ দিন আগে। এখন মারা গেলেন মামা। করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে প্রথম ভর্তি হয়েছিলেন মার্চ মাসের ২৮ তারিখে। প্রথমে কুর্মিটোলায় ছিলেন। এরপর বাড়িতে আনার পরে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আইসিইউতে ছিলেন ১০দিন। শুক্রবার রাত ৩টার দিকে মারা যান।
বাদলের লাশ দাফনের জন্য এম্বুলেন্স থেকে নামানো হয়। নেয়া হয় কবরের পাশে। এরপর বিশ্রামে থাকা বাকি তিনজনও কোদাল হাতে কবরের পাশে দাঁড়ান। স্ট্রেচার থেকে কবরে নামানো হয় লাশ। বাঁশ চাটাই দেয়ার পর কোদাল হাতে অপেক্ষমাণরা লেগে পড়লেন কাজে। কবরে মাটি ভরা শুরু করলেন তারা। বেশ খানিক সময় ধরে চললো তাদের এই কর্মযজ্ঞ। পাশে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
গোর খোদক আলী হোসেন বলেন, রোজা রাইখা প্রতিদিন কাজ করা খুব কষ্ট। একটা লাশ তিনজনে খুঁড়তে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। প্রতিদিন টার্গেট নেই ১৫টা কবর রেডি রাখার। কোনোদিন কমও খোঁড়া লাগে। কবর সাধারণত রাইতে খুঁইড়া রাখি। এরপর সকাল ৮/৯টা থেকেই লাশ আসা শুরু হয়, সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। সন্ধ্যার পরেও কবর দেয়া লাগে অনেক সময়। এমনও হয় একটা লাশ দাফন করতে করতে দুই তিনটা লাশ আইসাও জমা হয়।
আরেকজন গোর খোদক মো. তারেক বলেন, প্রথমে আমরা করোনা আক্রান্ত লাশের পাশে যাইতাম না। তাদের লোকেরাই করোনার পোশাক (পিপিই) পরে লাশ মাটিতে নামায় দিতো। ওষুধ ছিটাই দিতো এরপর আমরা মাটি দিতাম। কিন্তু এরপর স্যারেরা আইসা আমাগো বুজাইলো লাশ থেকে করোনা হয় না। প্যাকেট করা লাশ দাফন করলে কোনো সমস্যা নাই। এরপর থেকে আমরাই লাশ দাফন করি। করোনার প্রথমদিকে দিনে দুই-তিনটা লাশ আইতো। এখনতো দম ফেলানের সময় পাই না।
কথা বলতে বলতেই বোরকা পরা মহিলা পাশে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে তার ছেলে। আতিকা রহমান স্বামীর কবরের পাশে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। চোখ ছলছল তার। তার স্বামী পাশা রহমান ইন্তেকাল করেন ডিসেম্বর মাসে। কবরের ওপরে ফুলের গাছে পানিও দিলেন তিনি। কবরে বেড়ে উঠেছে সবুজ ঘাস। কবর পরিচর্যাকারীর হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে পরিচর্যার অনুরোধ করেন তিনি। পাশেই রাখা সাদা প্রাইভেটকারে চলে গেলেন তিনি। যাওয়ার সময় স্বামীর কবর থেকে কিছুটা মাটি নিয়ে গেলেন।
কবরের পরিচর্যাকারী মো. সজীব বলেন, এসব কবরের ফুল গাছ, ঘাসের যত্ন নেয়া লাগে। সঙ্গে মাটি ঠিকঠাক রাখা, কবর গর্ত হইলে মাটি ভরা এসব কাজ করতে হয়। শুরুর দিকে আলগা ঘাস লাগানো হয়। এই ঘাস জন্ম না নেয়া পর্যন্ত পানি দিতে হয়। তিনি আরো বলেন, এসব কাজের জন্য তাদের কোনো বেতন দেয়া হয় না। স্বজনরাই খুশি হয়ে কিছু টাকা দেন।
তখন সময় প্রায় বেলা ১২টা। সাইকেলে করে এলেন আরেক গোর খোদক সাইফুল ইসলাম। তিনি শুক্রবার রাতে দু’টি কবর খোঁড়ার কাজ করেছেন। এখন এসেছেন দাফনের কাজে। তিনি বলেন, সারাদিন রাইত এই কাজই করণ লাগে। রাইতে কবর খুঁড়ি এখন দিনভর দাফনের কাজ করা লাগবো।
সিটি করপোরেশনের নিযুক্ত ড্রেসার মো. আলী বলেন, কবরস্থানে চাইলে আমরা জানাজার নামাজের ব্যবস্থা করি। তবে অধিকাংশ লাশই আগে থেকে জানাজা করে আসে। আমরা ডেথ সার্টিফিকেট দেখে তাদের কবরের ব্যবস্থা করে দেই। এখন মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটছে। হাসপাতাল থেকে প্যাকেট হয়ে না আসলে আমরা যথাযথ নিয়ম মেনে জীবাণুনাশক করেই লাশ দাফনের জন্য পাঠাই। তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫টার মতো কবর খুঁড়ে রাখা হয়। প্রতিদিনই তা পূরণ হয়ে যায়।